মি: জ্যাকির ডলার সংকট

:: ফেনী বুলবুল ::

না,  তিনি হুমায়ুন আহমেদের রহস্যভিত্তিক চরিত্রের মিসির আলি কিংবা হিমুর মতো কেউ নন। একেবারেই সাধারণ একজন মানুষ, কিন্তু পুরো এলাকায় বেশ আলোচিত চরিত্র ও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন নিজের কিছু স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যের জন্য।

আমি যার কথা বলছি তিনি নিজেকে জ্যাকি নামে পরিচয় দেন, তবে আমরা আগেই জেনেছি যে অন্যরা তাকে ডাকতে হলে মিঃ জ্যাকি বলে ডাকতে হয়। আপনি যদি শুধু জ্যাকি বলে ডাকেন তাহলে তিনি আপনাকে বলবেন, এটা কেমন সম্বোধন ? নামের আগে মিস্টার টিষ্টার কিছু নাই কেন? অন্যের নাম সম্বোধন করতে হলে অবশ্যই নামের আগে মিঃ বলতে হয় সেটাও কি জানেন না? যাহোক মিঃ জ্যাকির বর্তমান পেশা হলো নারিকেল গাছ থেকে নারিকেল হারভেস্ট করা। আমরা যখন মিঃ জ্যাকিকে ফোন করলাম কচি নারিকেল সংগ্রহের জন্য, তখন তিনি জানালেন তাকে বুকিং করার সিরিয়াল অনুযায়ী তিনি হাজির হয়ে যাবেন। সিরিয়াল অনুযায়ী আমাদের সময় কখন সেটা আমরা জানিনা, তবে আমরা লোকমুখে শুনেছি তিনি কখনোই সিরিয়াল ব্রেক করেন না, তাই আমরা মিঃ জ্যাকির অপেক্ষায় থাকলাম। দুপুর বারোটার কাছাকাছি সময়ে তিনি নিজের গাড়ি ড্রাইভ করে এলেন। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। ভদ্রলোকের মাথায় হ্যাট, চোখে সানগ্লাস, মুখে মাস্ক, কানে হেডফোন এবং পরনে জিন্স। একেবারেই ওয়েস্টার্ন কাউবয়ের সাজে। এসে হ্যালো বলেই প্রথমে বললেন, আগে গাড়িটা পার্ক করি। গাড়িটা পার্ক করে দুইটা তালা দিয়ে লক করলেন। তারপর জিজ্ঞাস করলেন, কি করতে হবে? এখানে বলে রাখা ভালো, আমরা আগেই জেনেছি তিনি তার সাইকেলকে গাড়ি, নারিকেলকে ফল এবং টাকাকে ডলার বলেন। আমাদেরকেও তাই বলতে হবে নতুবা তিনি কাজ না করে ফেরতও যেতে পারেন। আমি বললাম, কচি নারিকেল পাড়তে হবে। তিনি জানালে একগাছে চড়ার জন্য ত্রিশ ডলার আর নারিকেল রশি দিয়ে নামালে পঞ্চাশ ডলার। আমি বললাম, ওকে।

তারপর তিনি তার পার্ক করা গাড়ির সামনে গেলেন। গাড়ির স্টিয়ারি এর সাথে দুই তিনটা ব্যাগ ঝোলানে।একটা ব্যাগে রাখা আছে বিভিন্ন ধরনের দা, একটিতে ছাতা ও অন্যান্য জিনিস আর অন্য একটি ব্যাগে বিভিন্ন মাপের রশি। ব্যাগ থেকে একটা দা রশি মোবাইল নিয়ে হ্যাট সানগ্লাস হেডফোন পরিহিত অবস্থায়ই সম্পুর্ন বৈজ্ঞানিক উপায়ে শতভাগ নিরাপদে নারকেল গাছ চড়লেন এবং অত্যন্ত যত্ন সহকারে কচি নারিকেল রশি দিয়ে নামিয়ে দিলেন। সবশেষে পেমেন্ট দিতে গিয়ে আমি দুষ্টুমি করে যখন জিজ্ঞাসা করলাম, মিঃ জ্যাকি কোন ডিসকাউন্ট নেই ? তখন ভীষণ মন খারাপ করে বললেন, ডলার সংকটের কারনে এইবার কোরবানী দিতে পারেননি।তার এমন উত্তরে আমি সত্যি ব্যাথিত হয়েছি।

মিস্টার জ্যাকির সাথে যোগাযোগের জন্য মুঠোফোন নম্বর: ০১৮৩০৩৪৫৪৫৪

মিঃ জ্যাকির ওয়েস্টার্ন  পোশাক-আশাক এবং ভাষার জন্য আকর্ষনীয় হবার পাশাপশি আমাদের এলাকার অন্যদের তুলনায় অল্প পারিশ্রমিকে এবং সবার জন্য একই রেটে নারিকেল গাছ চড়া, সিরিয়াল মেনটেইন করা, রশি দিয়ে যত্ন করে নারিকেল নামানো, নারিকেল নষ্ট না করা, সর্বোপরি তার ভদ্র আচরণ তাকে বেশ জনপ্রিয় করে তোলে। তাই এই পেশার অন্যরা এখন তাকে ইর্ষা করা শুরু করেছে এবং তাকে হটাতে এলাকায় নতুন এক মিথ্যা রিউমার ছড়িয়েছে যা হলো- মিঃ জ্যাকি যে গাছের ফল কাটে সে গাছে আর ফল হয়না। এ যেন কুসংস্কার দিয়ে সভ্যতা ঠেকানোর সেই গতানুগতিক পুরাতন যুদ্ধ।

মিঃ জ্যাকি চলে যাওয়ার আগে আমাকে তার মোবাইল নাম্বার সম্বিলিত একটি ভিজিটিং কার্ড দিলেন এবং বললেন, এখন টেকনোলজির যুগ তাই টেকনোলজির সুবিধা নিতে হবে। দেশ বিদেশ যেখানেই থাকেন আমাকে ফোন দিয়ে বুকিং করে সিরিয়াল নাম্বার নিবেন আমি যথাসময়ে আপনার দেয়া ঠিকানায় গিয়ে ফল পেড়ে দিবো। গাড়ি স্টার্ট করে যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলছিলেন- আমার ভীষণ ডলার সংকট, আমি ডলার সংকটে আছি, ডলার সংকটে আমি কোরবানী দিতে পারিনি।

এতক্ষণ যে মিঃ জ্যাকির কথা বলেছি তিনি হলেন মোঃ জাকির হোসেন। আমাদের পাশের ৪নং রামনগর ইউনিয়নের উত্তর সেকান্দরপুর গ্রামের একটি বনেদি পরিবারের সন্তান। ওয়েস্টার্ন মুভি এবং গানের ভীষণ ভক্ত ছিলেন জাকির। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করার আগেই হঠাৎ করে কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়েন এবং কেন জানি এত সবকিছুর মাঝে তিনি নারিকেল গাছ চড়াটাকেই বেছে নিলেন। আপনারা যারা দাগনভূইয়া এলাকার লোকজন তারা নারিকেল গাছে উঠার জন্য মিঃ জ্যাকির সাথে অনায়াসে যোগাযোগ করতে পারেন। আপনাদের সুবিধার্থে তার সরবরাহকৃত ভিজিটিং কার্ডের ছবি আপলোড করে দিলাম।

পরিশেষে দোয়া করি, আল্লাহ জাকিরকে সুস্থ করে দিক, কাটিয়ে দিক তার ডলার সংকট।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *