শবে বরাতের করনীয় ও বর্জনীয় আমল

শাবান মাসের ১৪ তারিখের দিবাগত রাতকে ফার্সি ভাষায় শবে বরাত বলে। শব অর্থ রাত। আর বরাত অর্থ মুক্তি। এক কথায় শবে বরাত অর্থ মুক্তির রজনী। এই রাতে মহান আল্লাহতায়ালা মুক্তি ও মাগফিরাতের দ্বার উন্মুক্ত করেছেন। তাই এর নাম মুক্তির রজনী। মুফাসসিরীনদের মতে, কুরআন কারিমে এই রাতকে ‘লায়লাতুল মুবারাকা’ বা ভাগ্যরজনী বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কুরআনের ভাষায় মহান আল্লাহতায়ালা প্রতিবছর এই রাতে সৃষ্টি জগতের ভাগ্য বণ্টন করেন। তাই এর নাম ভাগ্যরজনী বলা হয়েছে। হাদিসে এই রাতকে ‘লায়লাতুন নিসফি মিন শাবান’ বলা হয়।

হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, শবে বরাতের রাতে সারা বছরের হায়াত, মওত, রিজিক ও দৌলত লেখা হয় এবং বান্দাদের আমল ঐ রাতে আল্লাহর দরবারে পেশ করা হয়।

রাসূল (সাঃ) উম্মতদের উপদেশ দিয়েছেন যে, “শাবান মাসের ১৫ তারিখ রাতে তোমরা জাগ্রত থেকে আল্লাহর ইবাদত করো এবং দিনে রোজা রেখো।”

শবে বরাতের গুরুত্ব
শবে বরাতের মাহাত্ম অপরিসীম। এ রাতে বান্দার প্রতি আল্লাহর বিশেষ রহমত বর্ষিত হয়। আল্লাহর দরবারে বান্দার আমলসমূহ পেশ করা হয়। এ রাতে বিশেষ ধরনের অপরাধী ছাড়া বাকী সবাইকে মাফ করে দেয়া হয়। কিন্তু মন-প্রাণ থেকে তওবা না করা পর্যন্ত কিছু অপরাধীকে কখনই মাফ করা হয় না। তারা হলো-মুশরিক, জাদুকর, গণক, ইর্ষাপরায়ণ, অন্যের হক নষ্টকারী, গায়ক, বাদক, আত্মীয়তার সম্পর্ক ছেদকারী, পরস্পরে শত্রুতা পোষণকারী, অত্যাচারী শাসক ও তাদের সহযোগী, মিথ্যা শপথ করে পন্য বিক্রয়কারী, গর্ব সহকারে পায়ের গিরার নীচে কাপড় পরিধানকারী, মদ্যপ, পরস্ত্রীগামী, মা-বাবার অবাধ্য সন্তান, কৃপন পরনিন্দাকারী, জুয়া খেলোয়ার ইত্যাদি।

অর্থাৎ কবীরা গোনাহ সমূহ বিনা তওবায় মাফ হয় না আর ছোট-খাট বা সগীরা গোনাহ সমূহ শবে-বরাত, শবে-কদর প্রভৃতি মহিমান্বিত রাতের বরকতে মাফ হয়।

শবে বরাতের রাতে করণীয়
১. শবে বরাত একটি মহিমান্বিত রজনী। এই রজনীতে আল্লাহ তায়ালা তার রহমতের দ্বার উন্মুক্ত করে দেন। পাপীদেরকে উদারচিত্তে ক্ষমা করেন। হাদিসের ভিতরে এসেছে- হজরত মুয়ায ইবন জাবাল (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন- আল্লাহতায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে সৃষ্টিকুলের প্রতি (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক, হিংসুক ও বিদ্বেষী ব্যতীত সবাইকে মাফ করে দেন। [সূত্র: ইবনে হিব্বান, খণ্ড:১২, হাদিস নং ৪৮১; বায়হাকী, খণ্ড: ৫, হাদিস নং ২৭২ ইত্যাদি]

২. শবে বরাতের অন্যতম একটা ফজিলত হচ্ছে, এই রাতে সৃষ্টিজগতের ভাগ্যবণ্টন করা হয়। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে- নিশ্চয়ই আমি কুরআন নাজিল করেছি মুবারক রাতে। নিশ্চয় আমি সতর্ককারী, এই রাতে হিকমতপূর্ণ সব বিষয় সিদ্ধান্ত করা হয়। [সূত্র: সুরা দুখান, আয়াত:২-৩]

এই রাতে হিকমতপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ের ভাগ্য বা নির্ধারণ করা হয়। তাই এই রাতকে ভাগ্য রজনী বা মুবারক রাত বলা হয়। মুবারক রাতের ব্যপারে মুফাসসিরগণের নিকট দুইমত; কেউ বলেন যে, মুবারক রাত অর্থ শবে কদর। আবার কেউ বলেন, মুবারক রাত অর্থ শবে বরাত। এ বিষয়ে উপমহাদেশের বিশিষ্ট আলেমে দ্বীন আল্লামা আশরাফ আলী থানভী (র.), যাকে হাকিমুল উম্মাত বলা হয়; তিনি বলেছেন, মূলত কুরআন দুইবার নাজিল হয়েছে। এক রাতে কুরআন নাজিলের সিদ্ধান্ত হয়েছে, দ্বিতীয় রাতে সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন হয়েছে। অর্থাৎ শবে বরাতে সিদ্ধান্ত হয়েছে, আর শবে কদরে সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন হয়েছে। [সূত্র: ওয়াজ ও তাবলীগ, পৃ: ৮]

মুফাসসিরদের সর্দার আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.)-এর এরকমই মত পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা শবে বরাতে যাবতীয় সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত ফয়সালা করেন, আর শবে কদরে তা নির্দিষ্ট দায়িত্বশীলদের নিকট অর্পণ করেন।’ [সূত্র: লুবাব, খণ্ড:১৭, পৃ: ৩১১; তাফসীরে রাজি, খণ্ড: ২৭, পৃ: ২৩৯; তাফসীরে কুরতুবী, খণ্ড:১৬, পৃ:১২৬] উল্লিখিত ব্যাখ্যা দ্বারা বুঝা যায় যে, শবে বরাত ও শবে কদর উভয় রাতেই কুরআন নাজিল হয়েছে। তবে শবে বরাতের অন্যতম বৈশিষ্ট হচ্ছে-এতে সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভাগ্য বণ্টন করা হয়। তাই এর নাম মুবারবক রাত বা ভাগ্যরজনী। [সূত্র: তাফসীরে কাশশাফ, খণ্ড:৪, পৃ:২৬৪; রুহুল মাআনী, খণ্ড: ৯ পৃ: ১১২]

৩. পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, শবে বরাতে মহান আল্লাহতায়ালা রহমতের দ্বার উন্মুক্ত করে দেন। এই রাতে উদার চিত্তে ক্ষমা করে দেন। অতএব এই রাতে এমনই কাজ করা উচিত হবে, যা আল্লাহ্‌র রহমত ও ক্ষমা পাওয়ার ক্ষেত্রে সহযোগী হবে। আর এমন সব কর্ম থেকে বিরত থাকতে হবে, যা রহমত ও ক্ষমা পাওয়ার অন্তরায় হবে। আল্লাহ্‌র রহমত লাভে সহযোগী হয় এমন কাজের মধ্যে শ্রেষ্ঠ কয়েকটি কাজ হলো- একাগ্রচিত্তে নফল নামাজ পড়া, মনোযোগসহ বিশুদ্ধভাবে কুরআন তেলাওয়াত করা, রাত জেগে অশ্রুবিজড়িত অবস্থায় আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা, মঙ্গল কামনা ও দিনে রোজা রাখা ইত্যাদি। এ সম্পর্কে কয়েকটি হাদিস- হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত এক রাতে রাসূল (সা.)নামাজের জন্য দাঁড়িয়ে গেলেন… হাদিসের শেষাংশ হচ্ছে- এই রাতটি হলো শবে বরাত। এই রাতে আল্লাহতায়ালা তাঁর বান্দাদের প্রতি বিশেষ করুণার দৃষ্টি দেন, অনুগ্রহপ্রার্থীদের দয়া করেন। তবে হিংসুক ব্যক্তিদের স্বীয় অবস্থার উপর ছেড়ে দেন। [সূত্র: বায়হাকী, খণ্ড-৩, পৃ:৩৮৩; আততারগিব, খণ্ড: ২ পৃ: ৭৩-৭৪]

হজরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, শবে বরাত যখন আসে তোমরা এই রাতটি ইবাদত বন্দেগীতে পালন কর এবং দিনের বেলায় রোজা রাখ। কেননা এই রাতে সূর্যাস্তের পর আল্লাহতায়ালা প্রথম আসমানে আসেন আর বলেন, কোনো প্রার্থী আছে কি আমি তাকে ক্ষমা করে দিব, কোনো অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি আছে কি আমি তার অভাব দূর করে দিব, কোনো রোগাক্রান্ত ব্যক্তি আছে কি আমি তার রোগ দূর করে দিব। এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত আল্লাহতায়ালা ডাকতে থাকেন। [সূত্র: ইবনে মাজাহ, পৃ-৯৯; বায়হাকী, খণ্ড-৩, পৃ:৩৭৮]

হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) কে রমজান ব্যতীত পূর্ণ মাস রোজা রাখতে কখনো দেখিনি, আর (রমজান মাস ব্যতীত) শাবান মাসের তুলনায় বেশি রোজা অন্যকোনো মাসে রাখতে দেখিনি। [সূত্র: বুখারী, খণ্ড-১পৃ:২৬৪; মুসলিম, খণ্ড-১, পৃ:৩৬৫]
মোদ্দা কথা শাবানের পনের তারিখে রোজা রাখার কথা হাদিসে নির্দিষ্টভাবে উল্লেখ আছে।

শবে বরাতে বর্জনীয়
এই রাতে নির্দিষ্ট কোনো আমল বা নির্দিষ্ট সংখ্যায় কোনো কাজকর্ম কুরআন হাদিসে বর্ণিত নেই, নেই নামাজের কোনো নির্দিষ্ট রাকাত সংখ্যা, ভিন্ন কোনো পদ্ধতি। এই রাতে নামাজ দুআ ও কুরআন তেলাওয়াত ইত্যাদি নফল আমলের অন্তর্ভুক্ত আর যাবতীয় নফল আমল আপন আপন ঘরে একাগ্রচিত্তে পড়া উত্তম। তাই এই রাতে নফল নামাজ আদায়ের জন্য মসজিদে জমকালো আনুষ্ঠানিকতা করা ঠিক নয়। তবে কোনো ধরনের আয়োজন ও আনুষ্ঠানিকতা ব্যতীত মসজিদ নামাজের স্থান হিসেবে এতে সমবেত হয়ে গেলে কোনো আপত্তির কারণ নেই।

অনুরূপভাবে হালুয়া, রুটি, মিষ্টি বিতরণ এবং বাসাবাড়ি মসজিদ, দোকান, অফিস ইত্যাদিতে আলোকসজ্জা করা, পটকাবাজি, আতশবাজি, কবরস্থানে পুষ্প অর্পণ, আলোকসজ্জা করা ইত্যাদির কোনো ভিত্তি নেই। সাহাবায়ে কেরাম ও নির্ভরযোগ্য আলেমদের অনুসৃত আমলে এর কোনো ভিত্তি বা প্রমাণ মিলেনি। তাই সব কুসংস্কার পরিপূর্ণরূপে পরিহার করা অত্যন্ত জরুরি।

তবে কবরস্থানে যাওয়ার ব্যপারে হজরত আয়শা (রা.) থেকে যে হাদিস বর্ণিত আছে, সেটা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়- রাসূল (সা.) জান্নাতুল বাকীতে একাকী গিয়েছিলেন, দলবদ্ধভাবে নয়। তাই কবর জিয়ারতের নামে দলবদ্ধ হওয়া, সংঘবদ্ধ হওয়ার জন্য আহ্বান করা, জশনে জুলুসের জমকালো অনুষ্ঠানে পরিণত করা, কবরে আলোকসজ্জা করা, বিনোদন ও নারী পুরুষের মিলনমেলায় পরিণত করা ইত্যাদি শবে বরাতের নামে বাড়াবাড়ি ও ধর্ম বিকৃতির নামান্তর। এসবই ইসলামী আদর্শ বিবর্জিত রাসূল (সা.) ও সাহাবাদের আমল থেকে অনেক দূরে।

তাই শরিয়তের যাবতীয় ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি ও চরমপন্থা পরিহার করে শরিয়তকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করা একান্ত কর্তব্য। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সকলকে বোঝার ও সেই অনুযায়ী আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *