:: আলী রীয়াজ ::
প্রথম আলো’র সংবাদদাতা শামসুজ্জামান শামসকে তাঁর বাসা থেকে বুধবার ভোর চারটার দিকে সিআইডির পরিচয়ে সাদা পোশাকধারী ব্যক্তি কর্তৃক তুলে নেয়ার ঘটনা বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কতটা ভয়াবহ অবস্থায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তার সর্বশেষ উদাহরণ। আটক করার পর প্রায় ১৩ ঘন্টা পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁর আটকের ঘটনার স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। পরে পুলিশ, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্য অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে শামসুজ্জামানকে আটক করা হয়েছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী রাজধানীর তেজগাঁও থানায় যুবলীগ নেতা সৈয়দ মো. গোলাম কিবরিয়া (৩৬) নামের এক ব্যক্তি কর্তৃক ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্টের আওতায় করা মামলায় শামসুজ্জামানকে আটক করা হয়েছে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা দেশের গণমাধ্যমের সংখ্যার হিসেব দেখিয়ে যতই বলার চেষ্টা করুন না কেন যে দেশের গণমাধ্যমগুলো ‘স্বাধীন’ সেগুলোর প্রকৃত অবস্থা কি তা বোঝার জন্যে এই ধরণের ঘটনাই যথেষ্ট। এর সঙ্গে সংবাদপত্র বন্ধ করে দেয়া এবং অনলাইন নিউজ পোর্টালের ডোমেইন বরাদ্দ বাতিল করার সিদ্ধান্ত যুক্ত করলে একটি চিত্র পাওয়া যায়।
২০২২ সালের মে মাসে প্রকাশিত রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস (আরএসএফ)-এর প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশ ২০২১ সালের তুলনায় ১০ ধাপ পিছিয়েছে। সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো ১৬২তম, স্কোর ছিলো ৩৬ দশমিক ৬৩। মে মাসে প্রকাশিতব্য এই বছরের প্রতিবেদনে এই অবস্থার উন্নতির লক্ষণ থাকবে তা মনে করার কারন নেই। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর কর্তৃক প্রকাশিত মানবাধিকার রিপোর্টে ইন্টারনেটে ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধার যেসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে তা থেকে এই অনুমান করা যায়। এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার ও আওয়ামী লীগের সমালোচক হিসেবে পরিচিত সংবাদমাধ্যমগুলো হয়রানির শিকার হয়েছে। ওই সংবাদমাধ্যমগুলোতে বিজ্ঞাপন কাটছাঁট করা হয়েছে। এ কারণে অনেক মাধ্যম স্বেচ্ছায় সরকারের সমালোচনা এড়িয়ে গেছে।
স্বাধীনতা দিবসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকরা, যাদের মধ্যে ‘সাংবাদিক’, ‘সম্পাদক’ এবং ‘গণমাধ্যম’ও রয়েছে, যে ভয়াবহ প্রচারণা চালিয়ে এসেছে এই আটকের ঘটনা তাঁদের মধ্যেকার সম্পর্ককে খোলাসা করে দিয়েছে। এই বেআইনি আটককে তাঁরা তাঁদের প্রচারণার ‘সাফল্য’ বলেই দাবি করতে পারেন। কিন্ত এই সাফল্যের কারণে ব্যক্তি হিসেবে শামসুজ্জামানের নিরাপত্তাই কেবল বিঘ্নিত হয়নি, বাংলাদেশেরও ক্ষতি সাধন করা হয়েছে। যারা মনে করেন যে এগুলো তাঁরা যেভাবে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন সকলের কাছেই তা গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে তাঁরা আসলে নিজেদের কন্ঠের প্রতিধ্বনি ছাড়া আর কিছুই শুনতে পাননা।
প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে আদ্যোপান্ত ইতিমধ্যেই সকলের জানা। প্রথম আলো সূত্রে আমরা জানি যে, “গত রোববার প্রথম আলো অনলাইনের একটি প্রতিবেদন ফেসবুকে প্রকাশের সময় দিনমজুর জাকির হোসেনের উদ্ধৃতি দিয়ে একটি ‘কার্ড’ তৈরি করা হয়। সেখানে উদ্ধৃতিদাতা হিসেবে দিনমজুর জাকির হোসেনের নাম থাকলেও ভুল করে ছবি দেওয়া হয় একটি শিশুর। পোস্ট দেওয়ার ১৭ মিনিটের মাথায় অসংগতিটি নজরে আসে এবং দ্রুত তা প্রত্যাহার করা হয়। পাশাপাশি প্রতিবেদন সংশোধন করে সংশোধনীর বিষয়টি উল্লেখসহ পরে আবার অনলাইনে প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনের কোথাও বলা হয়নি যে উক্তিটি ওই শিশুর। বরং স্পষ্টভাবেই বলা হয়েছে, উক্তিটি দিনমজুর জাকির হোসেনের”। প্রথম আলো’র এই প্রতিবেদনে তথ্যগত ভুল ছিলোনা, উপস্থাপনাজনিত ত্রুটি কর্তৃপক্ষ স্বীকার করে নিয়ে সংশোধন করেছে স্বল্প সময়েই।
গত এক দশকের বেশি সময় ধরে আইনি ও আইন-বহির্ভূত ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে মতপ্রকাশের ওপরে কঠোর নিয়ন্ত্রণই শুধু আরোপিত হয়েছে তা নয়, নাগরিকরা সামান্যতম ভিন্নমত প্রকাশ করলে তাঁদের ওপরে নেমে আসছে নিপীড়ন। সাংবাদিকদের আত্মীয়স্বজনকে আটক, তাঁদের ওপরে হামলা চালানো এবং তাঁদের হয়রানি করা হচ্ছে। এ জন্যে সাদা পোশাকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করা হচ্ছে, পাশাপাশি সেন্সরশিপকে ‘আউট-সোর্সিং’ বা ফ্রাঞ্চাইজ করে দেয়া হয়েছে ক্ষমতাসীনদের সমর্থক বাহিনীর হাতে। অফলাইন-অনলাইন উভয় ভাবেই ভিন্ন মতাবলম্বীদের হেনস্থা করা, তাঁদের ওপরে চড়াও হওয়ার কাজে এই সব বাহিনী নিয়োজিত আছে। এগুলো যে সরকার এবং ক্ষমতাসীনদের অজ্ঞাতসারে হয়না তা সহজেই বোধগম্য ছিলো, শামসুজ্জামানের আটকের ঘটনা সেটাকে দিবালোকের মতো স্পষ্ট করেছে।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির একটি দিক মাত্র। রাজশাহী ভূমি কার্যালয়ের অফিস সহকারী সুলতানা জেসমিনকে কোনও ধরণের মামলা ছাড়াই আটক এবং র্যাবের হেফাজতে থাকা অবস্থায় তাঁর ‘মৃত্যুর’ ঘটনা হচ্ছে এই অবস্থার আরেকটি দিক। উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনাকে অবজ্ঞা করে হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনা এখন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। সুলতানা জেসমিনের আটক এবং ‘মৃত্যু’র ঘটনা বিরাজমান শাসন ব্যবস্থা কোন ধরণের তা আবারও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে। সরকারের একজন কর্মকর্তার ‘মুখের কথা’ই এখন একটি বাহিনীকে সক্রিয় করে তুলতে পারে এবং একজন ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে যথেষ্ট হয়ে ওঠে। এটাও লক্ষ্যনীয় যে, আটকের পরে এই আটকের বৈধতার মোড়ক দেয়া হয়েছে এমন এক আইনের মাধ্যমে যা বাতিলের জন্যে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে বারবার বলা হয়েছে। ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্ট- এর মাধ্যমে যে আপনাকে-আমাকে পথের মধ্য থেকে আটক করার ক্ষমতা যে কোনও বাহিনীকে দেয়া হয়েছে তার সাম্প্রতিকতম আক্ষরিক প্রমাণ হচ্ছে এই ঘটনা।
সাদা পোশাকে তুলে নেয়া, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ করা, হেফাজতে থাকা অবস্থায় নির্যাতন এবং মৃত্যু’র ঘটনাগুলো বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুমের ঘটনাবলি থেকে মর্মবস্তর বিবেচনায় আলাদা কিছু নয়। এগুলো ঘটছে কেননা ভয় দেখিয়ে শাসন করার এই ব্যবস্থায় এগুলোই স্বাভাবিক। ভয় দেখিয়ে, শক্তি প্রয়োগ করেই শাসন জারি রাখা হয়েছে। গণতন্ত্র বিষয়ে বিশ্বের অন্যতম গবেষণা প্রতিষ্ঠান ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্রেসি (ভি-ডেম)-এর ২০২৩ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে আবারও বাংলাদেশকে ‘নির্বাচনভিত্তিক স্বৈরতন্ত্র’ (ইলেকটোরাল অটোক্রেসি) বলে বলা হয়েছে। ভি-ডেম যে সমস্ত সূচক ব্যবহার করে একটি দেশের গণতন্ত্রের মান নির্ধারন করা তার প্রতিটিতে বাংলাদেশের অবস্থা গত বছরের তুলনায় খারাপ হয়েছে। আরেকটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল আইডিইএ (ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি এ্যান্ড ইলেক্টোরাল এসিসটেন্স) দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থাকে ‘অটোক্রেসি’ বা স্বৈরতন্ত্র বলেই চিহ্নিত করে আসছে। এই রকম শাসন টিকেই থাকে মতপ্রকাশের, সমাবেশের, ভোটদানের অধিকার হরণের মধ্য দিয়ে।
সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে আটক করার বিষয়ে স্থানীয় পুলিশ ও সিআইডির ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা প্রায় ১৩ ঘন্টা অস্বীকার করেছেন। এমন কি যখন প্রত্যক্ষদর্শী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের কাছে আটককারীরা নিজেদের সিআইডি বলে পরিচয় দিয়েছেন এবং তাঁরা বাড়ির মালিককে বলেছেন, শামসুজ্জামানের করা একটি প্রতিবেদনের বিষয়ে রাষ্ট্রের আপত্তি আছে। তাই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাঁকে নেওয়া হচ্ছে। কোনও প্রতিবেদনের ব্যাপারে ‘রাষ্ট্রের আপত্তি’ থাকার বিষয়টি কি? ‘রাষ্ট্র’ কোনও বিষয়ে কী করে আপত্তি করতে পারে মোটেই স্পষ্ট নয়। সরকারের আপত্তি থাকলে তার প্রতিবাদ করার বিভিন্ন ধরণের উপায় আছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এই বিষয়ে প্রথম আলো কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে পারতেন, এই মর্মে প্রেস কাউন্সিলে অভিযোগ করতে পারতেন, কিন্ত এ সবের কিছুই করেন নি। শুধু তাই নয়, এখন জানা গেলো যে, একজন সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির করা মামলায় তাকে আটক করা হয়েছে। শুধু তাই নয় জিজ্ঞাসাবাদের নামে সাদা পোশাকে আটক আইন-বহির্ভূত আচরণ কিনা সেটা যে কোনও আইনজীবিই বলতে পারবেন।
শামসুজ্জামানকে আটকের নিন্দা করা এবং অবিলম্বে মুক্তির দাবি জানানো আমাদের নৈতিক কর্তব্য। এর পাশাপাশি আমাদের মনে রাখতে হবে যে, যে আইনে তাকে আটক করা হয়েছে সেই আইন বাতিলের আর কোনও বিকল্প নেই। এটাও সুস্পষ্টভাবে বলা দরকার যে, কেবল তাঁর মুক্তিই যথেষ্ট নয়; যে শাসন ব্যবস্থা এই নিপীড়নকে স্বাভাবিক করে তুলেছে তাকে মোকাবেলা না করে এর পুনরাবৃত্তি রোধ করা যাবেনা।
লেখক: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো