সানাউল্লাহ মিয়ার দুয়ার সবার জন্য খোলা ছিল

:: কাফি কামাল ::

বাংলাদেশের কাঁধে যখন ওয়ান ইলেভেনের দানব চেপে বসেছিল তখন আমি সংবাদকর্মী হিসেবে আনকোরা ছিলাম। কিন্তু আমাকে অনেক ঋদ্ধ করেছে সে দুটি বছর। রাজনীতির নানা রঙ্গলীলা, রাজনীতিবিদদের চরিত্র ও কর্মকান্ড খুব ঘনিষ্ঠভাবে দেখার, জানার ও বুঝার সুযোগ করে দিয়েছে সে সময়কাল। ওয়ান ইলেভেনের পর পদ্মায় গড়িয়েছে বহুজল। ইস্যুর পর ইস্যুতে ভেসে গেছে বাংলাদেশের রাজনীতি। সংকুচিত হয়েছে গণতন্ত্র, ভোটাধিকার হারিয়েছে জনগন, নিয়ন্ত্রিত হয়েছে গণমাধ্যম, স্বাধীনতা হারিয়েছে বিচারবিভাগ। ঘটনার ঘনঘটায় বিগত একযুগ মুখরিত ছিল বাংলাদেশ। সাংবাদিকতায় আমার স্বল্পদৈর্ঘ্যের ক্যারিয়ারটা বিকশিত হয়েছে রাজনীতির অঙ্গণে। রাজনৈতিক বিটের সংবাদকর্মী হিসেবে রাজনীতিই ছিল আমার সার্বক্ষণিক ধ্যানজ্ঞান। বিশেষত বিএনপি তথা বিরোধী জোটের রাজনীতি।

বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত অনেক আইনজীবীর সাথে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয়েছে ওয়ান ইলেভেনের সময়। কালের পরিক্রমায় তার কোনটি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে দৃঢ়তায়, কোনটি গেছে হারিয়ে। সে সময় পরিচয় হয়েছিল সানাউল্লাহ মিয়ার সাথে। তখন বিএনপির সুবিধাভোগী বড় বড় অ্যাডভোকেট-ব্যারিস্টারদের অনেকেই নিজেদের রক্ষায় ব্যস্ত ছিলেন বা ঝামেলা এড়াতে দূরে সরে ছিলেন। চার দলীয় জোট সরকারের সুবিধাভোগী, রাষ্ট্রীয় পদবী (কোর্টে পিপি-জিপি) ভোগকারীরা যখন লাপাত্তা। বাঘা বাঘা আইনজীবীরা যখন আপসের চোরাবালিতে হারিয়ে গিয়েছিলেন, তখন ছোটখাটো সানাউল্লা মিয়া লড়েছেন অসীম সাহসে। কাউকে গ্রেফতার করা হলেই সানাউল্লাহ মিয়ার নেতৃত্বে একদল আইনজীবী আদালতে হাজির। ওয়ান ইলেভেনের পরও বিএনপির দুঃসময়ে লড়ে গেছেন সবসময় পুরোমাত্রায় সক্রিয় একজন। দেশের গণতন্ত্র ফেরানোর আন্দোলনে তার পেশাগত ভূমিকা নি:সন্দেহে ইতিহাসে উজ্জ্বলতা ছড়াবে।

বিএনপি চেয়ারপারসনসহ দলের বেশিরভাগ মামলায় আইনি লড়াই করেছেন তিনি। চেয়ারপারসন থেকে সাধারন কর্মী, বিএনপির সবার জন্য খোলা ছিল তার দুয়ার। তার সক্রিয় ভূমিকার কারনে দেশের অনেক বড় বড় আইনজ্ঞের চেয়ে গণমানুষের কাছে বেশি পরিচিত মুখ ছিলেন তিনি। জনপ্রিয়তার কথা উহ্য রাখলাম। কখনো কখনো মনে হতো বিএনপির সবচেয়ে বড় আইনজীবীই বোধয় সানাউল্লাহ মিয়া। বিএনপি এমন নিবেদিতপ্রাণ একজন নেতাকে হারিয়েছে, যার অভাব তারা নিশ্চিতভাবেই বোধ করবে বহুদিন। বিশেষ করে দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরা। যাদের ঘাড়ে মামলার বোঝা কিন্তু পকেটে শূন্য প্রায়। প্রায় সময় সিনিয়র নেতাদের দেখতাম সানাউল্লাহ মিয়াকে ফোন করে কর্মীদের জামিন করানোর জন্য বলে দিচ্ছেন। সারাদিন তার চেম্বারের ব্যস্ততা দেখলে যে কারো মনে হবে দেশের সবচেয়ে ব্যস্ত আইনজীবী তিনি। কিন্তু তার মক্কেলদের আশিভাগই ছিলেন দলের নেতাকর্মী, বিনেপয়সার মক্কেল। রাজনৈতিক মামলায় জামিন করানোর সময় তার কাছে ব্যক্তিগত পরিচয় কিংবা এলাকা গুরুত্ব পেতো না।

ওয়ান ইলেভেনের পর থেকে রাজনৈতিকভাবে অব্যাহতভাবে বিপর্যয়ের মধ্যদিয়ে এগোচ্ছে বিএনপি। দলের চেয়ারপারসনসহ নানাস্তরের নেতাকর্মীদের মামলা নিয়ে প্রায় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লেখার তাগিদ ছিল অফিসের। মামলার তথ্য ও আইনি বিষয়ে ব্যাখ্যার প্রয়োজনে আইন পেশায় খ্যাতিমান বিএনপির নেতাদের সাথে যোগাযোগ করতে হতো। কারো কারো কাছে ফোন করার পর তাদের আচরণ আমার মন ও মেজাজ খারাপ করে দিতো। কোনো এক সময় সে অভিজ্ঞতা লিখবো। কিন্তু সানাউল্লাহ মিয়া ছিলেন আশ্চর্যরকম এক ব্যতিক্রম। মামলার তথ্য প্রদান, তথ্য সংগ্রহ করে দেয়া, আইনগত ব্যাখ্যা প্রদানে কোনোদিন বিরক্ত হননি, ব্যস্ততা দেখিয়ে এড়িয়ে যাননি। তিনি ছিলেন আমার অন্যতম তথ্য উৎস। আমার নামটি তিনি সুন্দরভাবে এবং আন্তরিকতার সাথে উচ্চারণ করতেন। সবার সাথেই তিনি এমন সুন্দর আচরণ করতেন। প্রকৃত অর্থেই তিনি ছিলেন একজন জাত ভদ্রলোক, কোমলমনা ও বিনয়ী মানুষ। আচরনে নরম স্বভাবের হলেও সানাউল্লা মিয়া ছিলেন একজন সত্যিকারের সাহসী মানুষ। সেটা তিনি আওয়ামী লীগ আমল, ওয়ান ইলেভেন ও মহাজোট আমলে নিরবিচ্ছিন্নভাবে প্রমান করেছেন। মনে একটি প্রশ্ন জাগলো- সানাউল্লাহ মিয়ার বিকল্প কি পাবে বিএনপি?

ছাত্রদলের রাজনীতির মাধ্যমে রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছেন সানাউল্লাহ মিয়া। সে ধারাবাহিকতায় পেশাজীবী রাজনীতি করে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ঢাকা বার এসোসিয়েশনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। আওয়ামী লীগ আমলে আইনজীবী হ্যার প্রতিবাদে আন্দোলন গড়ে তোলে জননিরাপত্তা আইনের মামলায় দীর্ঘকারাভোগ করেছেন। বর্তমান সরকারের আমলেও বহু মামলার আসামী হয়েছেন। কিন্তু বিএনপির আমলে তাকে সরকারি কোন পদে দেখা যায়নি। দলের প্রতি তার আনুগত্য, আদর্শের প্রতি দৃঢ়তা আর অপরিসীম সাহস রীতিমতো উদাহরণযোগ্য। কিন্তু সানাউল্লাহ মিয়ার সাথে অবিচার করেছেন তারই উপকারভোগীর দলটির সিনিয়র নেতারা। সানাউল্লাহ মিয়া বারবার অবমূল্যায়িত হয়েছেন। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনেও তিনি মনোনয়ন চেয়েছিলেন, পাননি। পরবর্তীতে পাবেন এমন একটি প্রত্যাশা ছিল তাঁর। ২০১৪ সালে দল বর্জন করায় প্রস্তুতি নিয়েও নির্বাচন করতে পারেননি। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে মনোনয়ন তাঁর কপালে ঝুটেনি। কেন ঝুটেনি সে উত্তরের সান্ত্বনাও পাননি। দুনিয়ায় লোভী মানুষদের কাছে পরাজিত হয়েছে অপরিসীম শ্রম, ত্যাগ ও নিষ্ঠা। সানা ভাইয়ে মত দুর্দিনের কান্ডারী একজন জাতীয় নেতাকে নমিনেশন না দেয়াটা কেবল দল নয়, সারা জাতির কাছেই ছিল বিস্ময়। তিনি জাতীয় নির্বাচনে দলের প্রতিনিধিত্ব করার সম্মান বঞ্চিত হলেও অর্জন করেছেন দলমত নির্বিশেষে গণমানুষের ভালোবাসা ও অকৃত্রিম শ্রদ্ধা।

আবেগী আর ভালো মানুষদের কষ্ট যেমন বেশী, আয়ু ও তেমন কম। কারণ, ভালো কাজের প্রতিদান এরা আশা না করলেও প্রতিঘাতকে এরা সহ্য করতে পারেন না। দীর্ঘদিন ক্লান্তিহীন, নিরবিচ্ছিন্নভাবে দল ও জিয়া পরিবারকে সার্ভিস দেওয়া এই সানাউল্লাহ মিয়া নির্বাচনে মনোয়ন না পাবার মানসিক আঘাত সহ্য করতে পারেননি। ব্রেইনস্ট্রোকে তার শরীরের একপাশ পঙ্গু হয়ে যায়। স্বল্প খরচের গণস্বাস্থ্য হাসপাতালই ছিল তাঁর একমাত্র ভরসা। সেখানেই শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করলেন। বিশ্বাস রাখি, পরম করুনাময় আল্লাহ, পরকালে নি:সন্দেহে পরোপকারী এই মানুষটিকে যথাযথ মূল্যায়ন করবেন।

লেখকঃ সাংবাদিক

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *