:: নাগরিক ক্রীড়া ডেস্ক ::
আর্জেন্টিনার মতো শক্তিশালী দলকে হারিয়ে অঘটন ঘটিয়ে দিল সৌদি আরব। মঙ্গলবার কাতারের আইকনিক লুসাইল স্টেডিয়ামে আর্জেন্টিনাকে ২-১ গোলের ব্যবধানে হারায় সৌদি আরব।
সৌদি আরবের চেয়ে যোজন-যোজন ব্যবধানে এগিয়ে ছিল আর্জেন্টিনা। ম্যাচের প্রথমার্ধে তাই মনে হয়েছে।
দ্বিতীয়ার্ধের শুরুর ৫ মিনিটের ব্যবধানে বিশ্বকে চমকে দেয় সৌদি আরব। মাত্র ৫ মিনিটের ব্যবধানে সালেহ আলসেহরি ও সালেম আল দাওসারির গোলে ২-১ গোলে এগিয়ে যায় সৌদি আরব। এরপর আর গোল দিতে না পারায় হার এড়ানো সম্ভব হয়নি লিওনেল মেসিদের।
মঙ্গলবার আইকনিক লুসাইল স্টেডিয়ামে খেলার ৯ম মিনিটে সৌদি আরব ডিফেন্ডার আল বুলায়হি নিজেদের বিপৎসীমায় ফেলে দেন লিয়ান্দ্রো পারেদেসকে। ভিএআর দেখে এসে পেনাল্টি দেন রেফারি।
পেনাল্টি থেকে গোলটা করতে এবার ভুল করেননি মেসি। গোলরক্ষককে ভুল পথে পাঠিয়ে গোলটা তুলে নেন অধিনায়ক।
এরপর ২৫ মিনিটের ব্যবধানে আরও ৩টি গোল করে আর্জেন্টিনা, কিন্তু অফসাইডের কারণে সেই ৩টি গোলই বাতিল হয়।
২২ মিনিটের মাথায় প্রায় মাঝমাঠ থেকে বল টেনে নিয়ে গিয়ে দুরন্ত শটে গোল করেন বিশ্বের অন্যতম সেরা ফুটবলার মেসি। কিন্তু সহকারী রেফারি অফসাইডের পতাকা তুললে গোলটি বাতিল হয়ে যায়।
খেলার ২৮ মিনিটে লাউতারো মার্টিনেজ সৌদি গোলকিপারকে কাটিয়ে বল জালে জড়ান। সেই গোলটিও শেষপর্যন্ত অফসাইডের কারণে বাতিল হয়।
এরপর ৩৫তম মিনিটে মেসির দুরন্ত পাস থেকে বল পেয়ে অসাধারণ শটে গোল করেন লাউতারো মার্টিনেজ। কিন্তু অফসাইডের কারণে সেই গোলটি বাতিল হয়।
প্রথমার্ধে ১-০ গোলে এগিয়ে থেকে বিরতিতে যায় আর্জেন্টিনা।
বিরতি থেকে ফিরেই গোল পরিশোধে মরিয়া হয়ে ওঠে সৌদি আরব। দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরুর তৃতীয় মিনিট তথা ৪৮তম মিনিটে আর্জেন্টিনার জালে সালেহ আলসেহরি গোল করলে সমতায় ফেরে সৌদি আরব।
এরপর ৫৩তম মিনিটে সেলিম আল দাওসারির গোলে ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে যায় সৌদি আরব।
প্রথমার্ধে এগিয়ে থেকেও দ্বিতীয়ার্ধের শুরুর ৫ মিনিটের মাথায় ২ গোল খেয়ে মানসিকভাবে চাপে পড়ে যায় লিওনেল মেসিদের আর্জেন্টিনা। সেই চাপ সামলে উঠতে না পারায় আর ম্যাচে ফেরা হয়নি মেসি-ডি মারিয়াদের।
দ্বিতীয়ার্ধে কোনো গোল দিতে না পারায় সৌদি আরবের বিপক্ষে ২-১ গোলের ব্যবধানে হেরে পরাজয়ে কাতার বিশ্বকাপ শুরু করল আর্জেন্টিনা।
ম্যারাডোনা-বাতিস্তুতাকে টপকে মেসির রেকর্ড
স্পট-কিক থেকে ঠান্ডা মাথায় এবারের বিশ্বকাপে গোলের সূচনা করেন লিওনেল মেসি। এই গোলে দুই কিংবদন্তি দিয়েগো ম্যারাডোনা ও গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতাকে টপকে আর্জেন্টিনার হয়ে চারটি আলাদা বিশ্বকাপে গোল করার রেকর্ড করেন এই ফরোয়ার্ড।
কাতারে এবার নিজের পঞ্চম বিশ্বকাপ খেলতে এসেছেন মেসি। সৌদি আরবের বিপক্ষে নেমে তিনি ঢুকে গেলেন সেই বিরল ক্লাবে। আন্তোনিও কারবাহাল, রাফায়েল মারকেস, জিয়ানলুইজি বুফন ও লোথার ম্যাথাউসের পর পঞ্চম খেলোয়াড় হিসেবে পাঁচটি বিশ্বকাপ খেলার কীর্তি গড়েন এই ফরোয়ার্ড। তারপরেই নাম লেখান গোলের খাতায়।
শুধুমাত্র ২০১০ বিশ্বকাপ বাদে বাকি সব আসরেই গোল করেছেন মেসি। ২০০৬ সালের জার্মানি বিশ্বকাপে একটি, ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপে ৪ টি, ২০১৮ সালের রাশিয়া বিশ্বকাপে ১টি ও ২০২২ সালের বিশ্বকাপে এখনো পর্যন্ত একটি গোল করেছেন তিনি। সবমিলিয়ে বিশ্বকাপে তার গোল সংখ্যা সাতটি।
আর্জেন্টিনার হয়ে এর আগে ১৯৮২, ১৯৮৬ ও ১৯৯৪ বিশ্বকাপে গোল করেছেন ম্যারাডোনা। বাতিস্তুতা ১৯৯৪, ১৯৯৮ ও ২০০২ বিশ্বকাপে গোল করেছেন।
ছয়বার পরাজয়ে বিশ্বকাপ শুরু আর্জেন্টিনার
প্রথম নয়। এ নিয়ে ছয়বার পরাজয়ে বিশ্বকাপ শুরু আর্জেন্টিনার। কাতার বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচেই লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা হেরে যায় তুলনামূলক দুর্বল প্রতিপক্ষ সৌদি আরবের বিপক্ষে।
মঙ্গলবার কাতারের আইকনিক লুসাইল স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত ম্যাচের শুরু থেকেই আধিপত্য বিস্তার করে খেলে আর্জেন্টিনা। খেলার ১০ম মিনিটে সৌদি আরবের ভুলে পেনাল্টি পেয়ে গোল নিশ্চিত করেন মেসি।
এরপর ২২, ২৮ ও ৩৫ মিনিটে আর্জেন্টিনার হয়ে ৩টি গোল করেন মেসি ও লাউতারো মার্টিনেজ। কিন্তু অফসাইডের কারণে শেষ তিনটি গোলই বাতিল হয়।
১-০ গোলের ব্যবধানে পিছিয়ে থেকে দ্বিতীয়ার্ধে খেলতে নেমেই বিশ্বকে চমকে দেয় সৌদি আরব। মাত্র ৫ মিনিটের ব্যবধানে ৪৮ ও ৫২ মিনিটে সালেহ আলসেহরি ও সেলিম আল দাওসারির করা গোলে ২-১ গোলে এগিয়ে যায় সৌদি আরব।
এরপর আর ম্যাচে ফিরতে পারেনি আর্জেন্টিনা। যে কারণে ২-১ গোলে হেরে মাঠ ত্যাগ করে লিওনেল মেসিরা।
এর আগেও বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চে পাঁচবার নিজেদের প্রথম ম্যাচে হেরে আসর শুরু করে আর্জেন্টিনা।
১৯৩৪ সালের বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই সুইডেনের কাছে ৩-২ গোলে হেরে বিদায় নেয় আর্জেন্টিনা।
১৯৫৮ সালেও পশ্চিম জার্মানির কাছে নিজেদের প্রথম ম্যাচে ৩-১ গোলে হারে আর্জেন্টিনা।
১৯৭৪ সালে প্রথম ম্যাচে পোল্যান্ডের কাছে ৩-২ গোলে হারে আর্জেন্টিনা।
১৯৮২ সালের বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে বেলজিয়ামের কাছে ১-০ গোলের ব্যবধানে হারে আর্জেন্টিনা।
১৯৮৬ সালে দিয়াগো ম্যারাডোনার সৌজন্যে বিশ্বকাপ জিতেছিল আর্জেন্টিনা। ১৯৯০ সালেও ট্রফি জয়ের দাবিদার ছিল তারা। কিন্তু নিজেদের প্রথম ম্যাচে ক্যামেরুনের বিপক্ষে ১-০ গোলের ব্যবধানে হারে আর্জেন্টিনা। সেই হারের ধাক্কা সামলে একের পর এক শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে হারিয়ে ফাইনালে পৌঁছে যায় ম্যারাডোনার দল। ফাইনালে জার্মানির কাছে হেরে বিদায় নেয় আর্জেন্টিনা।
সবচেয়ে বাজে খেলেছেন রোমেরো-ডি পল
সৌদি আরবের বিপক্ষে এই ম্যাচে প্রথমার্ধে বেশ কিছু আক্রমণ করেছিল আলবিসেলেস্তেরা। মেসি-মার্টিনেজদের তিনটি গোল অফসাইডে বাতিল হয়। দ্বিতীয়ার্ধে গোল খাওয়ার পরে গোছালো ফুটবলে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়নি ল্যাতিন দলটি। সংবাদ মাধ্যম ইভেনিং স্ট্যান্ডার্ড ও ৯০ মিনিট এর মতে, ম্যাচে আর্জেন্টাইনদের মধ্যে সবচেয়ে বাজে খেলেছেন টটেনহ্যামের সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার ক্রিস্টিয়ানো রোমেরো এবং অ্যাথলেটিকো মাদ্রিদের মিডফিল্ডার রদ্রিগো ডি পল।
এমি মার্টিনেজ: দুই শটের দুটিতেই গোল খেয়েছেন মার্টিনেজ। ইভেনিং স্ট্যান্ডার্ড-এর মতে ম্যাচে তার রেটিং ১০ এ ৫। ৯০ মিনিট-এর মতে, ৬/১০।
রক্ষণ: ইভেনিং স্ট্যান্ডার্ড অভিজ্ঞ ডিফেন্ডার নিকোলাস ওটামেন্ডিকে ১০ এ ৫ রেটিং করেছে। ৯০ মিনিট ১০ এ ৬ দিয়েছে। ক্রিস্টিয়ানো রোমেরোকে ইভেনিং স্ট্যান্ডার্ড দিয়েছে মাত্র ৩ নম্বর। ৯০ মিনিট দিয়েছে ৫। দুই ফুল ব্যাক নাহুয়েল মলিনা ও নিকোলাস ত্যাগলিয়াফিকোকে দুই সংবাদ মাধ্যমই যথাক্রমে ৫ ও ৬ নম্বর দিয়েছে।
মিডফিল্ড: আর্জেন্টিনা মিডফিল্ডে বড় ধাক্কা খেয়েছে। স্কালোনির সিস্টেমে ম্যাচ নিয়ন্ত্রণে রাখেন ডিফেন্ডার ও মিডফিল্ডাররা। ইভেনিং স্ট্যান্ডার্ড-এর ক্রীড়া সাংবাদিক মালিক ওজিয়া সেন্ট্রাল ডিফেন্ডার পারদেসকে ১০ এ ৪ এবং রদ্রিগে ডি পলকে দিয়েছে ৫ নম্বর। ৯০ মিনিট পারদেসকে ৪ ও ডি পলকে দিয়েছে ১০ এ ৩। পাপ্পু গোমেজের গড় নম্বর ৪।
আক্রমণ: লিওনেল মেসি দুই জায়গাতেই সর্বোচ্চ ৬ নম্বর পেয়েছেন। ডি মারিয়া ইভেনিং স্ট্যান্ডার্ডে পেয়েছেন ৫, অন্যটিতে ৪। অন্যদিকে লওতারো মার্টিনেজ দশের মধ্যে যথাক্রমে ৬ ও ৪ নম্বর পেয়েছেন। বদলি নামা আলভারেজ, লিয়ান্দ্রো মার্টিনেজও ছয় নম্বরের ঘরে আটকে থেকেছে।
সৌদি আরবের ঘুরে হারানোর পেছনের কারিগর
এসবের পেছনে কে আছেন? তার নাম হার্ভে রজার রেনার্ড (Hervé Roger Renard) । সৌদি আরবের এই কোচের জন্ম আফ্রিকার দেশ জাম্বিয়াতে। ক্যারিয়ারের বেশির ভাগ সময়ই ছোট ক্লাবগুলোতে কাজ করেছেন তিনি। ১৯৯৯ সালে নিজের কোচিং ক্যারিয়ার শুরু করেন তিনি ফরাসি ক্লাব এসসি দ্রাগোনিগানের হয়ে। তাদের টানা দুই মৌসুমে প্রমোশন এনে দিয়ে চলে যান ইংল্যান্ডের তৃতীয় বিভাগের দল ক্যামব্রিজ ইউনাইটেডের দায়িত্ব নিতে।
ওখানেও খুব বেশি দিন স্থায়ী হননি। ভিয়েতনামের ক্লাবে হয়ে ফিরে আসেন ফ্রান্সের পঞ্চম বিভাগের দল এএস চেরবুর্গের দায়িত্ব নিতে। এতগুলো ক্লাব বদলেও একটি জায়গায় ঠিক থেকেছেন তিনি- রেনার্ডের দলের খেলার ধরনে এসেছে উন্নতি। এগুলোর জন্য মাঠের সঙ্গে বাইরেও কিছু বদলের নিয়ম জারি করে থাকেন তিনি। খাবার থেকে শুরু করে ফিটনেস, ম্যাচের পর রিকোভারিতে গুরুত্ব দেন।
২০১৯ সালে সৌদি আরবের দায়িত্ব নেন তিনি। তবে ততদিনে তার ঝুলিতে আছে আন্তর্জাতিক সাফল্যও। ২০১২ সালে জাম্বিয়া ও ২০১৫ সালে আইভেরি কোস্টকে নিয়ে আফ্রিকান কাপ অব নেশন্স জেতান। এরপর ২০১৮ সালে ২০ বছর পর মরোক্কোকে বিশ্বকাপে তুলে আনেন রজার। এবার তো বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচেই আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে চমকে দিলো তার দল।