:: মাহবুব মোর্শেদ ::
আদর্শ প্রকাশনীর কর্ণধার মাহাবুব রাহমান যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে পড়েন তখন থেকে তাকে চিনি। আমি তখন দৈনিক যায়যায়দিনে কাজ করি। মাঝে মাঝে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আড্ডা দিতে যেতাম। মাহাবুব ছাত্র ইউনিয়ন করতেন। কবিতা লিখতেন। কমন বন্ধুদের মাধ্যমে পরিচয়। সেই পরিচয়টা নানাভাবে গভীর হয়েছে। মাহাবুব সব সময় কম কথা বলেন। বলতে গেলে প্রায় কোনো কথাই বলেন না। খুবই লাজুক ইন্ট্রোভার্ট টাইপের মানুষ। পড়াশোনা শেষ করে কিছুদিন সাংবাদিকতা করেছেন। পরে একদিন বললেন, উদ্যোক্তা হবেন, নিজের প্রকাশনা সংস্থা দেবেন। ধীরে ধীরে আমার চোখের সামনে মাহাবুব একটা প্রকাশনা সংস্থা বড় করে তুললেন। নতুন আইডিয়া নতুন বই নতুন লেখক দিয়ে বাজার মাত করে ফেললেন। আমি দেখি আর অবাক হয়ে যাই। এত চুপচাপ একটা লোক এতকিছু কিভাবে করছেন।
মাহাবুবের এই উত্থানে অনেকেই তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয়েছেন। শত্রু তৈরি হয়েছে। মাহাবুব এগুলোকে খুব বেশি পাত্তা দিতেন না। কিন্তু শত্রুরা যখন আক্রমণ শুরু করে তখন আর চুপ থাকার কোনো উপায় থাকে না। ২০১৯ সালে জানানো হলো কে বা কারা মাহাবুবের নামে বাংলা একাডেমিতে অভিযোগ জানিয়েছে তাই তাকে স্টল দেওয়া হবে না। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করলাম। শেষ পর্যন্ত স্টল পাওয়া গেল।
২০২৩ সালে এসে আবার সেই ঘটনা। এবার প্রথমে তিনটি বই নিয়ে অভিযোগ উঠলো। পরে জানানো হলো একটি বই নিয়ে মূল অভিযোগ। মাহাবুব তার বইগুলোর পক্ষে দাঁড়ালেন। এটাই একজন প্রকাশকের প্রকৃত অবস্থান হওয়া উচিত। যদিও আমাদের দেশে এমন নজির পাওয়া যায় না। সাধারণত সরকার বা শক্তিশালী কারও পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠলে প্রকাশকরা বইটি বাজার থেকে তুলে নেন। আর রিপ্রিন্ট করেন না। অনেক বইয়ের ভাগ্যেই এমন ঘটনা ঘটেছে। অনেক সময় এগুলো কেউ জানতেও পারেনা। সরকারকে কষ্ট করে কোনো বই নিষিদ্ধ করতে হয় না। মিডিয়ায় আলোচনা তৈরি হয় না। চুপচাপ সমাধান হয়ে যায় সবকিছুর। মাহাবুব এই কাজটি করতে পারতেন। নিরবে একটি বা তিনটি বই সরিয়ে নিয়ে নিজের স্টল নিশ্চিত করতে পারতেন। কিন্তু তিনি যখন বললেন ওই তিনটি বই ছাড়া তিনি মেলায় যাবেন না তখন আমার মনে হলো তাকে সমর্থন দেওয়া দরকার। আমার মতো অনেকেই তার প্রতি সমর্থন জানালেন। তিনিও দৃঢ় অবস্থান ধরে রাখলেন। কিন্তু সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যখন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বলতে কোনো ধারণায় বিশ্বাস করে না তখন সমালোচনা বা প্রতিবাদ তাদের অবস্থান টলাতে পারে না। বাংলা একাডেমির মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে যারা বসে আছেন, মেলা আয়োজনের দায়িত্বে যারা আছেন তারা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, লেখকের স্বাধীনতা, বই, প্রকাশনী এগুলোকে থোড়াই কেয়ার করেন। সরকারকে তোয়াজ করাই তাদের মূল দায়িত্ব। মাহাবুব যখন নিজের প্রকাশিত বইয়ের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে দাঁড়িয়ে তখন তারা মাহাবুবকে সাইজ করে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করতে ব্যস্ত। তারা জানিয়ে দিলেন আদর্শকে কোনভাবে স্টল দেওয়া হবে না।
তখন অনেকেই বলতে শুরু করলেন, আদর্শ কেন বিপ্লবী ভূমিকা গ্রহণ করলো, কেন প্রতিবাদী হল? তারা কি আপোষ করে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে পারত না?
এদেশে এখন একজন প্রকাশক ও লেখকের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াই বিপ্লব বিদ্রোহ প্রতিবাদ হিসেবে গণ্য হয়। সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের অন্যায় চাওয়া-পাওয়া মেনে নেওয়াটাই প্রত্যাশিত স্বাভাবিক আচরণ।
লেখকদের সাথে কথাবার্তা বলে মনে হলো আদর্শ মেলায় যাবে না এটা অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না। তাদের অবশ্যই যুক্তি আছে। তিন জন লেখকের জন্য ৩০০ লেখকের ৬০০ বই মেলায় ঢুকতে দিচ্ছে না বাংলা একাডেমি। এই বইগুলো কিভাবে বিক্রি হবে? লেখকরা কিভাবে পাঠকদের সাথে মিট করবেন? আমরা তখন মাহাবুবকে অনুরোধ করলাম, তিনি যেন ফাহাম আব্দুস সালামের বইটি ছাড়াই মেলায় অংশগ্রহণের কথা ভাবেন। তিনি রাজি হলেন। বাংলা একাডেমিতে আবেদন জমা দিলেন। লোকে বলতে শুরু করলো, আদর্শ মুচলেকা দিয়ে মেলায় যেতে চায়। এই সমালোচক লোকগুলো ঠিক যে কী চায় বোঝা যায় না। প্রতিবাদ করলে বলে এত বিপ্লবী হওয়ার দরকার কী? সরকারের আবদার মেনে নিলে বলে এত আপোষ করার দরকার কী? এদের চোখে সব অবস্থান ভুল। যাই হোক মাহবুবের আবেদনপত্রে মুচলেকার মতো কোন ব্যাপার ছিল না। তাই বাংলা একাডেমির কর্তাব্যক্তিরা সেটি পছন্দ করেননি। ফাহামের বই ছাড়া মেলায় অংশগ্রহণের আগ্রহ জানালেও তারা মাহাবুবের আবেদনপত্র নাকচ করে দিয়েছে। খুবই অদ্ভুত ব্যাপার। বাংলা একাডেমি যে শর্ত দিয়েছিল সেই শর্ত মেনেই তো মাহাবুব বইটি ছাড়া মেলায় অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। তবুও তারা তাকে স্টল দিতে পারলো না। কেন পারলো না সেটিও জানাতে পারলো না। কোনো যুক্তি কি তাদের আছে?
প্রমাণিত হয়ে গেল, বাংলা একাডেমি কোনো যুক্তির ধার ধারে না। স্বার্থান্বেষী মহলের উস্কানিতে তারা একজন প্রকাশককে নাজেহাল করার উদ্দেশ্যেই ঘটনাগুলো ঘটিয়েছে।
ফাইনালি, তারা জানিয়ে দিয়েছে আদর্শ বইমেলায় অংশ নিতে পারবে না।
ব্রাত্য রাইসু আনন্দে আত্মহারা। রকমারি তিনটি বই বিক্রি বন্ধ করায় তার আনন্দের শেষ নেই। বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, রকমারি এবার বলুক কেন তাদের তিনটি বই নামিয়ে ফেলতে হলো। আদর্শ জবাব দিই কেন রকমারি থেকে তিনটি বই নেমে গেল। অবুঝ শিশুর মত নানা প্রশ্ন করে যাচ্ছেন আমাদের লেখক বুদ্ধিজীবীরা। প্রতিবাদ তারা করবেন না। তারওপর নতুন এক থিওরি আবিষ্কার করেছেন, প্রতিবাদ করলে ভালো লেখক হওয়া যায় না।
আদর্শের সঙ্গে যা হলো, এরপর লেখকরা লিখতে পারবেন? বই প্রকাশ করতে পারবেন? সরকার মনঃক্ষুণ হতে পারে এমন কথা বলতে পারবেন?
শেষ পর্যন্ত, ব্রাত্য রাইসুর পন্থাই ঠিক বলে প্রমাণিত হবে। ক্ষমতাধরদের পক্ষে কৌশলী তেলবাজি আর বিপক্ষের লোকদের বিরুদ্ধে নির্মম সমালোচনা করে করে আইকন হওয়ার চেষ্টা সকলেই আত্মস্থ করার চেষ্টা করবেন।
এই তো আমাদের দেশ।
এর চেয়ে ভাল আর কী হবে?
এর চেয়ে খারাপই বা কী হতে পারতো?
লেখক: সাংবাদিক