বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার

:: নাগরিক প্রতিবেদন ::

অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আব্দুর রউফ তালুকদারকে আগামী চার বছরের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগ দিয়েছে সরকার। শনিবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপসচিব মো. জেহাদ উদ্দীন স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সঙ্গে কর্ম-সম্পর্ক পরিত্যাগের শর্তে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আগামী ৪ জুলাই অথবা তাঁর যোগদানের তারিখ থেকে চার বছরের জন্য তাঁকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, আবদুর রউফ তালুকদার গভর্নর পদে নিয়োজিত থাকাকালীন সরকারের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে গ্রহণ করবেন।

বর্তমান গভর্নর ফজলে কবিরের মেয়াদ শেষে দায়িত্ব নেবেন আব্দুর রউফ তালুকদার। বিসিএস ১৯৮৫ ব্যাচের কর্মকর্তা রউফ সরকারি চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন সচিবালয় ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে। দেড় যুগ আগে সচিবালয় ক্যাডার বিলুপ্ত করে তাকে প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে একীভূত করা হয়। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি শিল্প মন্ত্রণালয়, খাদ্য মন্ত্রণালয় এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলাদেশ হাইকমিশন কুয়ালালামপুরে প্রথম সচিব (বাণিজ্যিক) হিসেবেও কাজ করেছেন এই কর্মকর্তা। তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে অর্থনীতির ওপর কর্মশালায় অংশ নিয়ে দক্ষতা অর্জন করেন।

২০১৮ সালের ১৭ জুলাই অর্থসচিব হিসেবে নিয়োগ পান রউফ তালুকদার। এর আগে ২০১৭ সালের অক্টোবরে অর্থ বিভাগের অতিরিক্ত সচিবের দায়িত্বে আসেন। তার আগে তিনি এই বিভাগের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব, উপসচিব ও যুগ্ম সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। অর্থ বিভাগের বিভিন্ন পদ ছাড়াও রউফ শিল্প মন্ত্রণালয়ের পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তরের উপ-রেজিস্ট্রার এবং মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সচিবের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা আছে আব্দুর রউফের। এছাড়া খাদ্য মন্ত্রণালয় ও তথ্য মন্ত্রণালয়ে সহকারী সচিব ছিলেন তিনি।

আব্দুর রউফ তালুকদার ১৯৬৪ সালে সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর উপজেলাধীন তারাকান্দি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর তিনি যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটি থেকে এমএসসি ডিগ্রি নেন।

সরকারি চাকরি থেকে তাঁর স্বাভাবিকভাবে অবসরে যাওয়ার কথা ২০২৩ সালের আগস্টে।

উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ চুরির ঘটনায় সাবেক বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আতিউর রহমান পদত্যাগ করেন। এর পরদিন ১৬ মার্চ সাবেক অর্থসচিব ফজলে কবিরকে চার বছরের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পদে নিয়োগ দেয় সরকার। পরে ২০ মার্চ বাংলাদেশ ব্যাংকে ১১তম গভর্নর হিসেবে যোগদান করেন ফজলে কবির। সে হিসেবে তার মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালের ১৯ মার্চ। কিন্তু মেয়াদ শেষ হওয়ার ৩৪ দিন আগে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি গভর্নর হিসেবে তার মেয়াদ ৩ মাস ১৩ দিনের জন্য বাড়িয়ে দেয় সরকার।

ওই সময় এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ৬৫ বছর পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত তিনি গভর্নর থাকবেন। বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডারে চার বছরের জন্য কাউকে গভর্নর পদে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা থাকলেও সরকার এ মেয়াদ আরেক দফা বাড়াতে পারে। যা ওই বছর ৩ জুলাই শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এরপর গভর্নর পদের মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়িয়ে ৬৭ বছর বয়স করে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার সংশোধন করা হয়। সেই হিসাবে ২০২২ সালের ৩ জুলাই তার মেয়াদ শেষ হবে।

প্রথম দফায় ৪ বছর, দ্বিতীয় দফায় ৩ মাস ১৩ দিন এবং তৃতীয় দফায় ১ বছর ১১ মাস ১৫ দিন অর্থাৎ মোট ৬ বছর ৩ মাস গভর্নর হিসেবে ইতিহাসের পাতায় নাম লিখেছেন ফজলে কবির।

সাবেক ১১ গভর্নর

স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত ১১ জন গভর্নর নিয়োগ দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে প্রথম গভর্নর আ ন ম হামিদুল্লাহ (১৯৭২-৭৪) ছিলেন একজন ব্যাংকার। বর্তমান উত্তরা ব্যাংক (তৎকালীন পাকিস্তানের ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপোরেশন)। এই ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন হামিদুল্লাহ।

দ্বিতীয় গভর্নর এ কে নাজিরউদ্দীন আহমেদ (১৯৭৪-৭৬) ছিলেন স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তানের নির্বাহী পরিচালক, ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব পাকিস্তানের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সোনালী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও এমডি । এ কে এন আহমেদ নামে পরিচিত এই ব্যাংকার বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলেও (আইএমএফ) কাজ করেছেন।

দেশে সবচেয়ে বেশি সময় গভর্নর ছিলেন এম নূরুল ইসলাম (১৯৭৬-৮৭)। তিনিই দেশের প্রথম আমলা গভর্নর। পাকিস্তান সেন্ট্রাল সার্ভিস কমিশনের (সিএসপি) সাবেক কর্মকর্তা ছিলেন তিনি। তার পরের গভর্নরও আরেক আমলা শেগুফ্তা বখ্ত চৌধুরী (১৯৮৭-৯২) ছিলেন কর ক্যাডারের কর্মকর্তা। এর পরের গভর্নর এম খোরশেদ আলমও (৯২-৯৬) ছিলেন সাবেক সিএসপি কর্মকর্তা।

আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে আমলা নির্ভরতা ভেঙে গভর্নর করেন দেশের বিশিষ্ট ব্যাংকার লুৎফর রহমান সরকারকে (১৯৯৬-৯৮)। এরপরের গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন (১৯৯৮-২০০১) একাধারে অর্থনীতির শিক্ষক ও সাবেক আমলা। গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমদ (২০০১-২০০৫) ছিলেন অর্থনীতির শিক্ষক, আমলা এবং বিশ্বব্যাংকের কর্মকর্তা। সালেহউদ্দিন আহমেদও (২০০৫-২০০৯) তাই ছিলেন। আতিউর রহমান (২০০৯-১৬) একজন অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষক। আর ফজলে কবির (২০১৬-২০২২) সাবেক আমলা, একসময় অর্থসচিব ছিলেন। ফজলে কবিরের স্থলাভিষিক্ত রউফ তালুকদারও আমলা ও অর্থসচিব। তিনি দেশের ১২ তম গভর্নর হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন।  

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *