আমার জেলজীবন

:: আরিফ আহমেদ ::

আদালত থেকে কোর্টের গারদ এবং এরপর কারাগারে নেয়ার পর প্রথম রাতে যাবতীয় কাগুজে ফর্মালিটি শেষ করে আসামীদের আমদানি (কারাগারের ভেতর যেটাকে বলে আমদামি) নামক অস্থায়ী নরকে রাখা হয়, সেখানে চলে দর কষাকষি, পরদিন দর এবং সামর্থ্য অনুযায়ী এক একজনকে এক এক বিল্ডিং এবং ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা হয়। যেখানে কারাবন্দীদের নিরাপদ রাখা সরকারের এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রনালয়ের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এবং তাদের খাবার দাবারের জন্য বিভিন্ন সংস্থা থেকে শতো শতো কোটি টাকা আসে, সেখানে কারাগারে কেবল ২ফিট X ৫ফিট জায়গা নিয়ে থাকার জন্য এবং কারাগারের প্রাপ্য খাবারটাই পাবার জন্য প্রতি সপ্তাহে কারাবন্দীদের সর্বনিম্ন ৩৫০০ টাকা করে গুনতে হতো। আরো ভিআইপি প্যাকেজও ছিলো। (এখনও এ নিয়ম বলবৎ আছে কিনা জানি না)

শুনেছি এই টাকার ভাগ কয়েদী, জেলার থেকে শুরু করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত যায়, এবং এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কারাগারের জীবন এমনিতেই নির্মম, তার মধ্যে যারা এ টাকা দিতে পারতো না তাদের জন্য কারাগার হাবিয়া দোজখের চেয়েও নিম্ন শ্রেণীর জায়গা। আমরা যারা রাজনৈতিক মামলার আসামী ছিলাম তারা পদবী, অ্যারোগ্যান্স এবং ভাব অনুযায়ী কিছুটা সম্মান/সমীহ পেতাম যদিও, তবে দিনশেষে কারাগার তো কারাগারই।

জেলখানার মূল ফটক থেকে শুরু করে জেলের ভেতরে অসংখ্য জায়গায় বড় বড় করে লেখা আছে “রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ”, অথচ জেলখানা থেকে জামিনে বের হবার পর থেকে গতো সাড়ে ৮ বছর ধরে ভেতরে-বাহিরে আমি কেন যেন ভীষণ আলো-শূণ্যতায় ভুগছি, দু-চোখে টিমটিমে যে অস্তমিত আলোটুকু ছিলো সেটুকুও প্রায় মৃতপ্রায়। আমার দুনিয়াজোড়া এক অদ্ভূতুড়ে অন্ধকার, সে অন্ধকারে আমি হাতড়ে হাতড়ে পথের নিশানা বের করার এক প্রাণান্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি, তবুও প্রতিনিয়ত আমি কেবলই সে অন্ধকারের চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছি একটু একটু করে।
আমি জানি না আদৌ এক চিলতে আলো আমার মৃত অন্তঃপুরের অলিন্দে কখনো ধরা দেবে কিনা ? নাকি অচিরেই আমি তলিয়ে যাবো অন্ধকারের অনন্ত সমুদ্রে?

আদালতের রায় হবার পর কোর্টের গারদ হয়ে প্রিজন ভ্যানে নাজিমউদ্দীন রোডের পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আমাকে নিয়ে যেতে যেতে সন্ধ্যা হয়ে গেছিলো। জেলের ভেতরের কাগজপত্রের ফর্মালিটি শেষ করে যখন আমদানিতে নেয় তখন রাত প্রায় ১০টা বাজে, কোন এক অজ্ঞাত কারনে কিংবা বয়স বেজায় কম হওয়ায় আমাকে আমদানিতে না রেখে সুরমা ভবনের নিচতলার ওয়ার্ডে রাতে থাকতে দেয়া হয়। (তাছাড়া জেলখানায় দীর্ঘদিন থাকতে থাকতে সমকামীতে পরিণত হওয়া আসামীদের প্রধান ও সহজ টার্গেট হয় শিশু-কিশোররা, সেটাও আমাকে আমদানিতে না রাখার একটা বড় কারণ)।

সুরমা ভবনের নিচতলায় গিয়ে দেখি ৮০ জনের ওয়ার্ডে প্রায় ৪০০ এর কাছাকাছি আসামী রীতিমতো গুবরে পোকার মতো কিলবিল করছে, যাদের অধিকাংশের বয়স ৯-১৫, এবং এদের অধিকাংশই মাদক পাচারের সহযোগী হবার কারণে কিংবা ছিনতাই করে জেলখানায় এসেছে, যদিও এদের রাখার কথা ছিলো কিশোর সংশোধনীতে।

এদের প্রায় সবাই বেজায় হতদরিদ্র পরিবারের সন্তান এবং বয়সের তুলনায় বড্ড ভীষণ পাকা। আমি আশ্চর্য হয়ে জীবনে প্রথমবারের মতো উপলব্ধি করলাম দারিদ্রতা কিভাবে মানুষকে ছোট বয়সেই বড় বানিয়ে দেয়। এরা প্রকাশ্যে সমকামীতা নিয়ে কথা বলছে এবং রাতে কে কার সাথে কি করবে সেসব নিয়ে হাস্য রসিকতা করছে। আমার রীতিমতো ঘেন্না লাগতে শুরু করলো, খানিকটা ভয়ও যে লাগছিলো না তা কিন্তু নয়, তবে সেটুক চেপে রেখে যথেষ্ট পরিমাণ স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করছিলাম। তবে বার বার আব্বু আর আম্মুর কথা মনে পড়ছিলো, তারা কি করছে , ঠিক মতো খেয়েছে কিনা ইত্যাদি ভাবতে ভাবতে খানিকটা কান্নাও পাচ্ছিলো।

ইতোমধ্যে রাজনৈতিক মামলার আসামী শুনে আশেপাশে অনেকে ভীড় করতে লাগলো এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শুনে তারা আরো সমীহ করতে লাগলো, যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কি বা এর কাজ কি এসব সম্পর্কে তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই তবুও ওয়ার্ডের নেতা গোছের কয়েকজনের সমীহ দেখে বাকিরাও খানিকটা ভয় আর শ্রদ্ধার চোখেই দেখতে লাগলো, এবং বার বার এসে নানাভাবে সমাদর করার চেষ্টা করতে লাগলো। আমি যেহেতু হাফ প্যান্ট পরার বয়স থেকেই নেতৃত্ব দিয়ে অভ্যস্ত আমিও আস্তে আস্তে তাদের সাথে মিশে যেতে লাগলাম এবং আমার স্বাভাবিক ছেলেভুলানো বাচন ভঙ্গিতে তাদের মধ্যে ভয়, দ্বিধা, এবং সমীহের একটা আবহ সৃষ্টি করে তাদের মোটামুটি হিপনোটাইজ করে ফেললাম বলে চলে।

কারারক্ষীর চেঁচামেচিতে রাত প্রায় ১২টার দিকে ঘুমাতে যখন গেলাম তখন হুট করে সিগারেটের নেশাটা জেগে উঠলো। যেহেতু প্রথমবার জেলে যাওয়া তাই বুঝে উঠতে পারিনি, এজন্য কোর্টের গারদ থেকে জেলে যাবার সময় টুকটাক খাবার নিয়ে গেলেও সাথে কোন সিগারেট নেয়া হয়ে ওঠেনি। অবশ্য জেলে ঢোকার পর থেকে আমাকে সিগারেট খাওয়ানোর লোকেরও অভাব হয়নি, আধশোয়া অবস্থায় বিছানা থেকে চোখ দিয়ে ইশারা দিতেই একটা ছেলে (নাম বললাম না) এসে ঠোঁটে একটা বেনসন সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে গেলো। এই ছেলেটা এবং তার আরেক বন্ধু এরা দুজনেই ছাত্রলীগের রাজনীতি করতো, এবং আওয়ামী লীগের তৎকালীন এমপি আসলামুল হক ( মৃত) এর রাজনীতি করতো, এরা দুজনেই মাদক বিক্রির টাকার ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে আরেক বন্ধুকে খুন করে জেলে এসেছে। মাত্র ১-১.৫ ঘন্টায় এরা আমাকে বড় ভাই বলে ডাকা শুরু করলো এবং ওই এক রাতেই আমাকে ৮টা বেনসন সিগারেট খাইয়েছে। জেলখানায় যে কটা ছেলেকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে তাদের মধ্যে এরা অন্যতম। বলিউডের বিভিন্ন সিরিজের ভিলেনের মতোই লোমহর্ষক এদের জীবন এবং কাজকর্ম, অথচ রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকায় কেউ এদের কিচ্ছু করতে পারেনি/ পারে না কখনো। (এদের জামিনও হয়েছিলো আমার বহু আগে এবং ২০১৫ পর্যন্ত আমার সাথে যোগাযোগও ছিলো, পরবর্তীতে ইচ্ছে করেই আর যোগাযোগ রাখিনি)।

ওয়ার্ডের সবাই যখন ঘুমিয়ে গেছে তখন আমি শুয়ে শুয়ে সিগারেট ফুঁকছি এবং উল্টো পাশে ওয়ার্ডের রাইটার কনভ ভাই লো ভলিউমে রেডিও ছেড়ে ঘুমিয়ে গিয়েছে। এতো রাতে সে কিভাবে কোন চ্যানেল শুনছিলো আমার জানা নেই, কিন্তু হুট করে যখন রেডিওতে প্রিন্স মাহমুদের কম্পোজিশন আর লিমনের সুরে “থার্ড পার্সন সিঙ্গুলার নাম্বার” মুভির “জেলখানার চিঠি” গানটা বেজে উঠলোঃ

“দেয়ালের ওপারে আছে আকাশ, খেয়ালের নানা রঙ আছে বাতাস –

সে আকাশ দেখা হয় না, সে বাতাস এসে ছোঁয় না-

কেঁদে যাই, কেঁদে যাই, কেঁদে যাই,

না, কেমন করে বলো ওইখানে যাই,

যেখানে তুমি আর তোমরা আছো সবাই।”

প্রথম ক’টা লাইন শোনার পরেই বুকের মধ্যে কোথায় যেন হু হু করে উঠলো, মূহুর্তেই অদ্ভূত এক শূণ্যতা এসে ভেতর/বাহির পুরোটা গ্রাস করে নিলো। হঠাৎ টের পেলাম আমার দু-চোখের কোণ বেয়ে বাঁধভাঙ্গা জলরাশি গড়িয়ে চলছে, আমি কোনমতেই নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসীরা আমাকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে যাবার পর থেকে ক্রসফায়ারের নামে খুনের কাছাকাছি চলে যাওয়া, গুম করে রাখা, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, থানা,গারদ,কোর্ট , জেল পর্যন্ত এক মূহুর্তের জন্য যে আমি সামান্যতম বিচলিত হইনি, সে আমি উদভ্রান্তের মতো নীরবে, নিঃশব্দ কাঁদছি। আমি যদি সেদিন চিৎকার করে কাঁদতে পারতাম তবে হয়তো বাংলাদেশ নামক ৫৫ হাজার বর্গমাইলের ওই নরক সেদিনই জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যেতো।

আজ সাড়ে ৮ বছর পর যখন আমি সাড়ে ৮ হাজার মাইল দূরে বসে আমার বিগত জীবনের বিস্মৃতি লিখছি তখনও আমার প্লে-লিস্টে “জেলখানার চিঠি” গানটা একটানা বেজে চলছে গতো ২-৩ ঘন্টা ধরে, ঠোঁটে পুড়ছে বেহিসাবী সিগারেট, আর চোখের কোণ বেয়ে নেমেছে রুধির ধারা। পার্থক্য কেবল সেদিনের চোখের জলে ছিলো হাহাকার, আর আজকের চোখের জলে কেবলই হেরে যাবার গ্লানি, নিজের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত পালিয়ে বেড়ানোর অন্তর্দহন।

জেলখানার মূল ফটক থেকে শুরু করে জেলের ভেতরে অসংখ্য জায়গায় বড় বড় করে লেখা আছে “রাখিব নিরাপদ, দেখাব আলোর পথ”, অথচ জেলখানা থেকে জামিনে বের হবার পর থেকে গতো সাড়ে ৮ বছর ধরে ভেতরে-বাহিরে আমি কেন যেন ভীষণ আলো-শূণ্যতায় ভুগছি, দু-চোখে টিমটিমে যে অস্তমিত আলোটুকু ছিলো সেটুকুও প্রায় মৃতপ্রায়। আমার দুনিয়াজোড়া এক অদ্ভূতুড়ে অন্ধকার, সে অন্ধকারে আমি হাতড়ে হাতড়ে পথের নিশানা বের করার এক প্রাণান্ত সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছি, তবুও প্রতিনিয়ত আমি কেবলই সে অন্ধকারের চোরাবালিতে ডুবে যাচ্ছি একটু একটু করে।

আমি জানি না আদৌ এক চিলতে আলো আমার মৃত অন্তঃপুরের অলিন্দে কখনো ধরা দেবে কিনা ? নাকি অচিরেই আমি তলিয়ে যাবো অন্ধকারের অনন্ত সমুদ্রে?

ফেয়ারবর্ন, ওহাইও থেকে

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *