ঈদে মিলাদুন্নবীর গুরুত্ব ও তাৎপর্য

:: :: মারুফ মল্লিক ::

পাস্পরিক দ্বন্দ সংঘাতে লিপ্ত আরবের মক্কা নগরীর কোরাইশ বংশের বানু হাশিম গোত্রে জন্ম নেওয়া এক এতিম বালক পরবর্তীতে আরবীয় প্রলেতারিয়েত, অভিজাত, ব্যবসায়ী, যোদ্ধা, শিকারি, নারী, পুরুষ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বদলে দিলেন মানব সভ্যতার ইতিহাস। ইসলাম ধর্মমতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব হজরত মুহাম্মদ (সা.) এই দিনে আরবের মরু প্রান্তরে জন্ম নিয়েছিলেন। আরব ভূখণ্ডে এমন একসময়ে মহানবী (সা.) এসেছিলেন, যখন পুরো অঞ্চলটি ছিল কুসংস্কার, অশিক্ষা, গোষ্ঠীগত হানাহানি, ক্রীতদাস প্রথা, নারীর প্রতি চরম বৈষম্যসহ নানা রকম সামাজিক অনাচারে নিমজ্জিত। গোত্রে গোত্রে বিবাদ ও প্রাণঘাতী লড়াই চলছিল বহু বছর ধরে।

আল্লাহ প্রেরিত ইসলামের পূর্ববর্তী অনেক নবী ও রাসুলের মতই তিনিও ছিলেন রাখাল। শৈশব থেকেই তার মধ্যে নেতৃত্বগুন পরিলক্ষিত হয়। এ নেতৃত্বগুনের কারণেই তিনি আল আমীন বা বিশ্বাসী উপাধি লাভ করেন। এই রাখাল বালকই পরিনত বয়সে তার ধর্ম, দর্শন দিয়ে বহুধারায় বিভক্ত আরবের রাজনৈতিক ও সামাজিক কাঠামো আমুল বদলে দিয়েছিলেন।। পরবর্তীতে এর প্রভাব সারা বিশ্বেই পরিলক্ষিত হয়।

আজীবন এক সংগ্রামী জীবন যাপন করেছেন হযরত মুহাম্মদ (সা:)। মানবের মুক্তি ও কল্যাণ সাধনায় তিনি গোটা জীবন লড়াই করেছেন। মহানবী (সা.) সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, পরস্পরের মধ্যে ভ্রাতৃত্ববোধ ও ভালোবাসা জাগানোর শিক্ষা দিয়েছেন। তিনি মানুষকে শুধু মহৎ গুণাবলি শিক্ষাই দেননি, নিজের জীবনেও তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। সমাজসংস্কারক হিসেবে মুহাম্মদ (সা.) সর্বকালের আদর্শ। যে সমাজে কন্যাশিশুকে জীবিত কবর দেওয়া হতো, সেই সমাজে তিনি নারীর শিক্ষাকে উৎসাহিত করেছেন, তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। শত্রুর প্রতি ক্ষমা ছিল তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।

ইসলামের দর্শন প্রচার করতে গিয়ে স্বাভাবতই মুহাম্মদ (সা:) বিরোধীতা ও প্রতিরোধের সম্মুখীণ হন। নিজ আত্মীয়, পরিজনদের কাছ থেকে বাধা পেয়েছেন। তাকে হত্যার জন্য হামলাও হয়েছে। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সা:) তো হত্যার শিকার হতে জন্ম নেননি। ইসলামের প্রথম দিকে তিনি তরুনদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেন। এর কারণে আরব সমাজের অভিজাততন্ত্রের দ্বারা সমালোচিত হন। অভিজাতরা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল, তিনি আরব তরুনদের বিভ্রান্ত করছেন বলে। তার বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ ছিল তিনি আরবের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে দিচ্ছেণ। বিশেষ করে দাসদের তিনি যখন মুক্ত করে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন আরবদের প্রতি।

বেশিরভাগ মানুষই হযরত মুহাম্মদ(সা:)কে ইসলামের প্রবর্তক হিসাবে বিবেচনা করেন। কিন্তু আল্লাহ প্রেরিত রাসুল হযরত মুহাম্মদ (সা:) কে সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে। তিনি সমগ্র মানবজাতির জন্য রহমত হিসাবে এ ধরায় এসেছিলেন। নানা ধারায় বিভক্ত, নানা মত ও পথের আরবকে একটি একক ধারায় আনার পথে হযরত মুহাম্মদ (সা:)কে একজন দুরদর্শী রাজনীতিক, দক্ষ সমরবিদ ও চিন্তাশীল সমাজ সংস্কারক হিসেবেও বিবেচনা করতে হবে।

ইসলাম শুধু পরলৌকিক জীবনে মোক্ষম লাভের কথা বলে না। বরং একই সঙ্গে ইহকালে মানবজাতির রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক দর্শনকেও গুরুত্ব দেয়। এ কারণেই ইসলামী সভ্যতা রোমান সভ্যতাকে প্রতিস্থাপিত করেছিল। বিশ্ব ক্ষমতার ভরকেন্দ্র রোম থেকে আরবে স্থানান্তরিত হয়। হয়রত মুহাম্মদ (সা:) যখন জন্মগ্রহণ করেন তখন ইতিমধ্যে পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে। পূর্ব রোমান সাম্রাজ্য বায়জান্টানে চলে এসেছে। ওই সময়ে যখন ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে এক ধরনের বিভেদ ও দ্বন্দ উপস্থিত হয়, বিশেষ করে রোমান সাম্রাজ্যে।

ঠিক এই জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে হযরত মুহাম্মদ (সা:) দেখান ধর্ম কেবল রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ বা রাষ্ট্র থেকে নেওয়ার জন্যই নয়। বরং ধর্মেরও রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্ব আছে। নিরাকার সৃষ্টিকর্তার ইবাদতের পাশাপাশি ধর্মেরও রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মসূচি থাকতে পারে। ধর্ম কর সংগ্রহই কেবল মাত্র ধর্মের কাজ হতে পারে না। মানব সভ্যতার উষালগ্ন থেকে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর ধরে চলে আসা ধর্মীয় চিন্তা ও চর্চাকে তিনি একটি সুনির্দিষ্ট জায়গায় নিয়ে আসেন। এবং এক্ষেত্রে তিনি অবশ্যই আরবের পূর্ববর্তী নবী রাসুলদের প্রচারিত বানী ও দর্শনের আলোকেই ওই সময়ের আরব সমাজের বিদ্যমান কাঠামো ও রাজনৈতিক চর্চার নিরিখেই ইসলামের আদর্শ ও মত প্রচারে অগ্রসর হন।

অনেকে ইসলামের এই অংশকে বলেন পলিটিক্যাল ইসলাম। বরং বলা ভালো ইসলাম হচ্ছে পলিটিক্যাল রিলিজিয়ন । ইসলাম পূর্ববর্তী ধর্মগুলো কখনই রাজনৈতিক ক্ষমতার দিক্ষে খুব একটা এগুতে পারেনি। রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বারাই বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এই বাধাকে অতিক্রম করে রাষ্ট্র ক্ষমতা পর্যন্ত ইসলাম পৌঁছাতে পেরেছে। এবং ততকালীন সময়ে বিকল্প রাজনৈতিক চিন্তা উপস্থিত করেছে। বিশেষ করে পবিত্র পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর যখন এক ধরনের রাজনৈতিক দর্শনের জগতে এক ধরনের শূন্যতা বিরাজ করছিল।

ইসলামের দর্শন প্রচার করতে গিয়ে স্বাভাবতই মুহাম্মদ (সা:) বিরোধীতা ও প্রতিরোধের সম্মুখীণ হন। নিজ আত্মীয়, পরিজনদের কাছ থেকে বাধা পেয়েছেন। তাকে হত্যার জন্য হামলাও হয়েছে। কিন্তু হযরত মুহাম্মদ (সা:) হত্যার শিকার হতে জন্ম নেননি। ইসলামের প্রথম দিকে তিনি তরুনদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলেন। এর কারণে আরব সমাজের অভিজাততন্ত্রের দ্বারা সমালোচিত হন। অভিজাতরা তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছিল, তিনি আরব তরুনদের বিভ্রান্ত করছেন বলে। তার বিরুদ্ধে আরো অভিযোগ ছিল তিনি আরবের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে দিচ্ছেণ। বিশেষ করে দাসদের তিনি যখন মুক্ত করে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন আরবদের প্রতি।

যাই হোক, যে কোনও তত্ত্ব ও দর্শনের পক্ষ-বিপক্ষ থাকবে। এটাই স্বাভাবিক। ইসলামেরও বিরোধীতা করা হয়েছিল। এখনো করা হয়। তবে এরপরও তিনি মানবসভ্যতায় স্বমহিমায় ভাস্বর থাকবেন নিজস্ব রাজনৈতিক চেতনা, কৌশলী কূটনৈতিক দক্ষতা ও সমাজকে উদ্বুদ্ধ করার যোগ্যতা দিয়েই। সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে সমাজ গঠনের নেতৃত্বের জন্যই। হযরত ইব্রাহিম (আ:) এর সময় থেকে শাসক বর্গের সঙ্গে আদিম প্রলেতারিয়েতদের যে ক্ষমতার দ্বন্দ তার অবসান ঘটে হয়রত মুহাম্মদ (সা:) এর মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে। তিনিও হযরত ইব্রাহিম (আ:), হযরত ইউসুফ (আ:), হযরত মুসা (আ:) ও হযরত ঈসা (আ:) এর মতই দেশান্তরী হয়েছিলেন মজলুমের পক্ষে কথা কলে ইনসাফের সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে। বিদায় হজ্বের ভাষনে হযরত মুহাম্মদ (সা:) বলেছিলেন অত্যাচারিত না হতে। অত্যাচার না করতে।

ড. মারুফ মল্লিকআন্তর্জাতিক রাজনীতি ও দেশের স্বনামধন্য রাজনৈতিক বিশ্লেষক। 

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *