একজন তৃতীয় লিঙ্গ জীবন

:: ওয়ালিদ ইসলাম ::

ধরুন আপনার খুব কাছের বন্ধু/বড়ভাই বা ছোটভাই যে তৃতীয় লিঙ্গের ছিলো আপনি তা জানতেন না। অথচ, লেখাপড়া করার সময় আপনি একই হলের, একই রুমে এমনকি একই বেডে শুয়েছেন। যখন জানবেন, তখন আপনি নিজেকে নিজে ঘৃণা করবেন এবং মুখরোচক গল্প বলা শুরু করবেন যে, “এজন্যই ও আমাকে ব্যাড টাচ করার চেষ্টা করছিলো, রাতের বেলায় গায়ে হাত-পা তুলে দিতো, চুমা দিয়েছে কয়েকবার” যার কোনটাই সত্য নয়। আপনাদের কাছে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ মানেই হচ্ছে সম্পূর্ণ কামুক ও ব্যক্তিত্বহীন মানুষ, কেবলই হাসির খোরাক এবং যাকে ইচ্ছে করলেই সেক্সুয়াল ইন্সট্রুমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা যায়। যা ও দুই একজন পরিচয় গোপন করে আপনাদের সাধারণ মানুষের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে তারা হয় আপনাদের হাসির খোরাক হয় নাহয় হয় আপনাদের বুলিং করার বস্তু। আর এই বুলিং এর জন্য তারা ক্লাসবিমুখ হয়ে পড়ে, রেজাল্ট খারাপ করে। আমার খাতিরেও এমনটাই ঘটেছিলো। আর আমি একারণেই নিজের লিঙ্গপরিচয় গোপন রেখেছিলাম এতোদিন। আজকের পর থেকে আমাকে নিয়ে অনেক মুখরোচক গল্প ছড়াবে, অনেকেই আমাকে এড়িয়ে চলবে, যারা এতোদিন বলে এসেছে আমাকে শ্রদ্ধা করে তারা শ্রদ্ধাবোধ হারাবে। চায়ের দোকানে মুখরোচক গল্প বসবে। এটা জানার পরে যেমনটি করেছিলেন জাহাঙ্গীরনগরের জার্নালিজমের শিক্ষক শেখ আদনান ফাহাদ। এসব কিছু সয়ে গেলেও কষ্ট পেয়েছিলাম এটা ভেবে যে শেখ আদনান ফাহাদ একজন শিক্ষক, তিনি আসলে কি শিক্ষা দিচ্ছেন তার শিক্ষার্থীদের আমার প্রশ্ন জাগে। এবং তার পোস্টে কমেন্ট করেছে, হাসাহাসি করেছে আমারই ক্যাম্পাসের কাছের সিনিয়র এবং জুনিয়র।

নিজেদের এ্যাপেক্স দাবী করা এক ট্রেনিং সেন্টারে ট্রেনিং করার সময় সেখানকার ইনস্ট্রাকটররা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করতেন। দয়া হতো তাদের প্রতি। একজন ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টর আমার এক ব্যাচমেটের কাছে দাবি করেছিলেন যে আমি তার সাথে সেক্সুয়াল রিলেশনে যেতে ইনিয়ে বিনিয়ে তাকে প্রস্তাব করেছিলাম। আবার এই প্রতিষ্ঠানের কিছু অপকর্ম নিয়ে কথা বললে আমাকে গে দাবি করে আমার হাটাচলা, কথা বলার ধরন নিয়ে ৪০ মিনিটের একটা ক্লাস নেয়া হয়েছিলো আমাকে নিয়ে সি সেকশনে। বলা হয়েছে আমি নাকি ট্রেইনি ছেলেদেরকে হ্যারাস করতাম। দু:খ হয় তারা বিসিএস ক্যাডারদের প্রশিক্ষণ দেয় ভেবে।

আমি বাংলাদেশের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের ক্যাডার অফিসার এবং বিশ্বের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের কূটনীতিক। নিজের সাথে নিজে লুকোচুরি খেলতে খেলতে ক্লান্ত আমি। তাই ঢাকঢাক গুড়গুড় ভাব নিয়ে আর কতো দিন? হয়তো আমাকে এখানে মানায় না, আমার অবস্থান হওয়ার কথা ছিলো হিজড়া ডেড়ায়। কেউ থুকে দেবে, কেউ আবসালা দেবে এর ভেতরই জীবনটা হয়তো সীমাবদ্ধ থাকা উচিৎ ছিলো। হয়তো এই ভদ্র মানুষের সমাজ আমার জন্য নয়। এই পোস্টটা পড়ে হয়তো সরকারের নির্দিষ্ট কিছু লোক বা সরকার আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, হয়তো চাকরিটাই আর থাকবেনা।

একে তো ছেলে মানুষের ভান ধরে থাকা হিজড়া, তারপর আবার একটা প্রেমও হয়েছিলো আমার। দুই পরিবারের সিদ্ধান্ত ছিলো যে, আমি অপারেশন করিয়ে মেয়ে হয়ে যাবো এবং আমরা বিয়ে করবো। ডেট ঠিক হয়েছিলো গত বছরের জানুয়ারি মাসে। ৮ বছরের সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে যখন আমি ছুড়ি-কাচির নিচে গেলাম, অসহ্য যন্ত্রণার শিকার হলাম এবং সেই অপারেশনের কারণে আমার কোলন ক্যান্সার হলো ঠিক তখনই একজন হিজড়া ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে কিভাবে সংসার করবে, লোকে কি বলবে সেটা ভেবে তিনি অন্যত্র বিয়ে করলেন। কিন্তু, বিয়ের পূর্বে আমারতো একটা অলিখিত সেক্সুয়্যাল আইডেন্টিটি যা ছিলো তাও তিনি মুছে দিয়ে গেলেন। সবখানে আমার আইডেন্টিটি “মেইল” উল্লেখ করা থাকলেও এখন আমি নিজেই ডিফাইন করতে পারিনা আমি আসলে কি। কারণ, ব্রেস্ট, ভোকাল আর ফেস ফেমিনাইজেশন (ফিলার দিয়ে) সার্জারি বাকি আছে আমার।

আমার সাথে যখন কোন জুনিয়র দৌড়ে এসে ছবি তুলতে চাই আমি তখন বুঝতে পারি যে আমার ছবিটা দেখিয়ে সে বা তার গ্রুপে সবাই মিলে হাসিঠাট্টা করার জন্যই তুলেছে। আমি কষ্ট পাইনা। কাউকে হাসাতেতো পারলাম, এটা ভেবেই আনন্দিত হই।

গতবার যখন সারা শরীর ফুলে গেলে বড় তিনটা অপারেশন করতে হলো পেছন খোলা নর্মাল একটা কাপড় পরে ঘুমের ওষুধ নিয়ে আমাকে শুয়ে থাকতে হয়েছিলো ৩৬ টা দিন। এসময় আমাকে দেখভাল করতে থাকা একজন আমার নগ্ন শরীরের ছবি তুলেছিলো এবং সেই ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে আমাকে কয়েকবার ধর্ষণ করেছিলো। ব্যাপার না, আমি যেহেতু তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ আমাকে যেভাবে খুশি সমাজের মানুষ ব্যবহার করতেই পারে।

আমি বাংলাদেশের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের ক্যাডার অফিসার এবং বিশ্বের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের কূটনীতিক। নিজের সাথে নিজে লুকোচুরি খেলতে খেলতে ক্লান্ত আমি। তাই ঢাকঢাক গুড়গুড় ভাব নিয়ে আর কতো দিন? হয়তো আমাকে এখানে মানায় না, আমার অবস্থান হওয়ার কথা ছিলো হিজড়া ডেড়ায়। কেউ থুকে দেবে, কেউ আবসালা দেবে এর ভেতরই জীবনটা হয়তো সীমাবদ্ধ থাকা উচিৎ ছিলো। হয়তো এই ভদ্র মানুষের সমাজ আমার জন্য নয়। এই পোস্টটা পড়ে হয়তো সরকারের নির্দিষ্ট কিছু লোক বা সরকার আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে, হয়তো চাকরিটাই আর থাকবেনা।

একে তো ছেলে মানুষের ভান ধরে থাকা হিজড়া, তারপর আবার একটা প্রেমও হয়েছিলো আমার। দুই পরিবারের সিদ্ধান্ত ছিলো যে, আমি অপারেশন করিয়ে মেয়ে হয়ে যাবো এবং আমরা বিয়ে করবো। ডেট ঠিক হয়েছিলো গত বছরের জানুয়ারি মাসে। ৮ বছরের সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে যখন আমি ছুড়ি-কাচির নিচে গেলাম, অসহ্য যন্ত্রণার শিকার হলাম এবং সেই অপারেশনের কারণে আমার কোলন ক্যান্সার হলো ঠিক তখনই একজন হিজড়া ট্রান্সজেন্ডার নিয়ে কিভাবে সংসার করবে, লোকে কি বলবে সেটা ভেবে তিনি অন্যত্র বিয়ে করলেন। কিন্তু, বিয়ের পূর্বে আমারতো একটা অলিখিত সেক্সুয়্যাল আইডেন্টিটি যা ছিলো তাও তিনি মুছে দিয়ে গেলেন। সবখানে আমার আইডেন্টিটি “মেইল” উল্লেখ করা থাকলেও এখন আমি নিজেই ডিফাইন করতে পারিনা আমি আসলে কি। কারণ, ব্রেস্ট, ভোকাল আর ফেস ফেমিনাইজেশন (ফিলার দিয়ে) সার্জারি বাকি আছে আমার।

কিন্তু, নিজের সাথে যুদ্ধ করতে করতে আমি ক্লান্ত। তৃতীয় লিঙ্গের সবাই মানুষ। তাদের সাথে কুকুরের মতো ব্যবহার আপনারাই করেন। ব্যক্তিত্ব আমাদেরও আছে। আমাদেরকে ব্যক্তিত্বহীন করেন আপনারা।

নিজের পরিচয় গোপন করেও যে নোংরামির শিকার হয়েছি ডিপার্টমেন্টের বন্ধু মুন্না গং এবং হলের ৩৯ এর তাজ গং’র কাছে এবং ক্যাডার সার্ভিসে আমার কজন ব্যাচমেটের (নাম বলতে চাইনা) কাছে! পরিচয় জানার পর না জানি ক্যামনটা হয় আমার সাথে! আমি শংকিত নই, আমি ব্যথিত। মানুষের সমাজে আমাদেরকে কুকুরের মতো করে দেখা মানুষগুলোর জন্য ব্যথিত, দয়া হয় তাদের প্রতি।

এবার যারা আমাকে আনফ্রেন্ড করতে চান করতে পারেন, গালি দিতে চান দিতে পারেন, অপমান করতে চায়লে তাও পারেন। আমি অভ্যস্ত। তবে, তোমার/আপনার প্রতি আমার সিমপ্যাথি কাজ করে কথাটা বলবেন না। আপনার সিমপ্যাথি বা দয়ার কোন দরকার আমার নেই। আপনি যে পথ পাড়ি দিয়েছেন আমিও সেই একই পথ পাড়ি দিয়েছি। তবে, আপনার পথে ফুল বিছানো থাকলেও আমার পথে বিছানো ছিলো জ্বলন্ত কয়লা। কাজেই আমি মিউচুয়াল রেস্পেক্ট আশা করবো, সিম্প্যাথি নয়। আর একারণেই সবসময়ই একটা ফেইক হাসি মুখে রেখে দু:খ কিছু আছে কিনা তা কাউকে বুঝতে দিইনা।

লেখক: বাংলাদেশের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের ক্যাডার অফিসার এবং বিশ্বের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের কূটনীতিক

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *