ওয়ারফেইজের সঞ্জয় ও বাংলা হার্ডরক গান

:: ফজলে এলাহী ::

৯০ দশকে ভারতের চলচ্চিত্রে ‘সঞ্জয় দত্ত’ নামে একজন পর্দা কাঁপাতেন আর বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতে ‘সঞ্জয়’ নামে আরেকজন শ্রোতাদের হৃদয় কাঁপাতেন। সঞ্জয় ছিলো আমাদের বিস্ময় ও গর্ব করা একটি নাম। কারন বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতে যখন মেলোডি গানের জয়জয়কার তখনই ‘ওয়ারফেইজ’ নামক ব্যান্ডের মাধ্যমে তিনি প্রমান করেছিলেন বাংলার ছেলেরা বিদেশি হেভি মেটাল বা রক গানের ধারাতেও সমান পারদর্শী । শুধু পারদর্শী বললে ভুল হবে , বাংলার ছেলেরা আন্ত্রজাতিক মানের হেভি মেটাল গান গাইতে পারে যা উপমহাদেশের আরও কারো নেই । হ্যাঁ, এই আমাদের প্রিয় সঞ্জয়। যিনি সেই ১৯৯৮ সালে ‘ওয়ারফেইজ’ এর ‘অসামাজিক’ অ্যালবামের পর আর নিয়মিত নেই বা গান থেকে দূরে চলে গেছেন। তবুও আজো শ্রোতারা সঞ্জয়কে ভুলতে পারেনি , আগামীতেও পারবে না। আমাকে যদি বাংলা হার্ডরক ব্যান্ড মিউজিকের শ্রেষ্ঠ কোন কণ্ঠ বেছে নিতে বলা হয় আমি সঞ্জয় রাখবো সবসময় ১ নাম্বারে। যিনি শুধু একজন পরিপূর্ণ গায়কই নন , মানুষ হিসেবেও চমৎকার , অসাধারন যার মাঝে কোন অহমিকা কোনদিন দেখিনি ।

আজ প্রায় দুই যুগ পরেও বাংলা হার্ডরক গানের কথা উঠলেই ‘বসে আছি একা’ ‘একটি ছেলে’ গান দুটোর নাম চলে আসে সবার আগে। আজো এই প্রজন্মের নতুন ব্যান্ড শ্রোতারা সঞ্জয়ের কণ্ঠের গানগুলো শুনে বিস্মিত হয় এই ভেবে যে আজ থেকে ২ যুগ আগে আমাদের হেভি মেটাল গান কত দুর্দান্ত ছিল ,কত অসাধারন ছিল । আজ থেকে ১০০ বছর পরের শ্রোতারাও সঞ্জয়ের কণ্ঠের গানগুলো শুনে বিস্মিত হবে যে প্রযুক্তির ছোঁয়া ব্যতীত আমাদের দেশের ছেলেরা এতো দুর্দান্ত ভাবে হেভি মেটাল ধারা শুরু করেছিল যা অবিশ্বাস্য ।

১৯৮৪ সালে ওয়ারফেইজ গঠনের সময় যারা ছিলেন তাঁরা হলেন কমল- বেজগিটার ,ড্রামস- হেলাল, মীর- লিড গিটার, নাইমুল- লিড গিটার, বাপ্পি- ভোকাল । পরবর্তীতে মির, হেলাল ও বাপ্পি ব্যক্তিগত কারনে ব্যান্ড ছেড়ে চলে গেলে কমল লিড গিটারের দায়িত্ব নেয়, বাবনা বেজ গিটার ,টিপু ড্রামস ও রাসেদ ভোকাল এর দায়িত্ব নিয়ে ব্যান্ড এ যোগ দেয়। পরবর্তীতে নাইমুল ও রাসেদ চলে গেলে রাসেল কিবোর্ড ও সাঞ্জয় ভোকাল এর দায়িত্ব নেয়। অবশ্য তাঁরা দুজন আসার আগে ইন ঢাকা ব্যান্ড এর মাসুক ও ফুয়াদ অথিতি হিসেবে বিভিন্ন শোতে অংশগ্রহন করে। সেই কিশোর বেলা থেকে এভাবেই সঞ্জয়ের ‘ওয়ারফেইজ’ ব্যান্ডে যোগদান । যার কণ্ঠে তখন ছিল ইংরেজি গান ।

এরপর ১৯৯১ সালে বের হয় ওয়ারফেইজ এর প্রথম অ্যালবাম যা বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের ইতিহাসে ঠাই করে নেয় অসাধারণ সব হার্ডরক গানের জন্য। সেদিন বাংলাদেশের শ্রোতারাও বুঝতে পারলো যে আমাদের ছেলেরাও পারে হার্ডরক/হেভি মেটাল গান গাইতে। অবশ্য এর আগে রকস্টারটা তাদের অ্যালবাম বের করে কিন্তু ওয়ারফেইজ এর মত এতো আলোড়ন তুলতে পারেনি।তবুও রকস্টারটা বেশ ভালোই গেয়েছিল। প্রথম অ্যালবাম এর ‘একটি ছেলে’ ‘বসে আছি’ ‘কৈশোর ‘ ‘স্বাধিকার’ , ‘স্বাধিকার’ ‘ কৈশোর’ , ‘বিচ্ছিন্ন আবেগ’, ‘সন্ধ্যা’ গানগুলো আজো ২৫ বছর পরেও একইরকম নাড়া দেয়। আজো শ্রোতারা ভুলতে পারেনি।


১৯৯৪ সালে বের হয় ওয়ারফেইজ এর ২য় অ্যালবাম ‘অবাক ভালোবাসা’। প্রথমটার মত এটিও শ্রোতারা লুফে নেয় এবং ওয়ারফেইজ আবারো তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করে। এই অ্যালবাম এর অন্যতম হিট গানগুলো ছিল সঞ্জয়ের কণ্ঠের ‘ অন্ধ জীবন’ ‘অন্য ভুবন’ ‘বন্দী নিয়তি’, ‘’শেখানো বর্ণনা ‘’ গানগুলি আজো শ্রোতাদের মনে পড়ে। ১৯৯৬ সালের ঈদে বের হয় ওয়ারফেইজ এর ৩য় অ্যালবাম ‘জীবনধারা’ । এই অ্যালবাম এ ওয়ারফেইজ সম্পূর্ণ হার্ডরক থেকে বের হয়ে একটু সফট রক গান বেশি করেছিলো। শুধু ‘জীবনধারা” গানটি ছিল বরাবরের মত একটি জটিল গান। যা শ্রোতারা তাদের প্রিয় তালিকায় নিয়ে নেয়। সঞ্জয়ের ‘ধুপছায়া’ গানটি ছিল মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মত একটি গান। যা আজো শ্রোতাদের সেই দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। ‘’জীবনধারা’ গানটি তো আজো শ্রোতাদের কাছে উম্মাদনার নাম।

১৯৯৮ সালের রোজার ঈদে মুক্তি পায় ওয়ারফেইজ এর ৪র্থ অ্যালবাম ‘অসামাজিক’ যা হার্ডরক অ্যালবাম গুলোর ইতিহাসে ওয়ারফেইজ এর আরেকটি চমৎকার সংযোজন। যেখানে ওয়ারফেইজ এর সাথে যোগ দেয় বাংলাদেশের সেরা বেইজ গিটারিস্ট সুমন (অর্থহীন) ও অন্যতম প্রতিভাবান লিড গিটারিস্ট ইকবাল আসিফ জুয়েল (লিজেন্ড) । এই অ্যালবাম এ সঞ্জয়ের কণ্ঠে ‘অসামাজিক’ ‘নেই প্রয়োজন’ অশনি সংকেত ‘’ ‘ধুসর মানচিত্র’ ‘মহানগর’ ও ‘ এমন দিনে’ গানগুলো তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। বিশেষ করে ‘অসামাজিক’ ‘নেই প্রয়োজন’ ‘ধুসর মানচিত্র’ ‘’ এমন দিনে’ গানগুলো আমাদের বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতে স্থায়ী আসন নিয়ে নিয়েছে। এই অ্যালবাম এর পরপরই ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারনে মূল ভোকাল সাঞ্জয় ব্যান্ড ছেড়ে চলে যায় যা ছিল শুধু ওয়ারফেইজ এর জন্য নয় পুরো ব্যান্ড সঙ্গীত ও শ্রোতাদের জন্য বিরাট একটি ধাক্কা।

আমাদের ৯০ দশকের ব্যান্ড সঙ্গীতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পাওয়া সাঞ্জয়। যা বিকল্প আজো বাংলা হার্ডরক/ হেভি মেটাল গানে পাওয়া যায়নি। হার্ডরক গান কিভাবে গাইতে হয় সাঞ্জয় তা ভালভাবে দেখিয়ে দিয়ে গেছে। সাঞ্জয় এমনি এক উচ্চু মানের শিল্পী যার গান অন্য কোন ব্যান্ড তাদের স্টেজ শো গুলোতে গাইতে চায়না এবং গাইতে পারে না। এমনকি আমি নিজেও অনেক বড় বড় কন্সার্ট দেখেছি যেখানে বাচ্চু, মাকসুদ, জেমস এর গানগুলো অনায়াসে গাইতে পারছে অন্য ব্যান্ডগুলো সেখানে তাদের ওয়ারফেইজ তথা সাঞ্জয়ের কোন গান গাইতে অনুরোধ করলে তাঁরা খুব লজ্জা পায়। কেউ সাহস দেখায় না সাঞ্জয় এর গান গাওয়ার। কারন সঞ্জয় যে স্কেলে গান শুরু করে সেই স্কেলে অনেক শিল্পী যেতে পারে না। সাঞ্জয় এমন এক শিল্পী যার স্কেলে নিচে নামানো খুব কঠিন একটা কাজ। সাঞ্জয় নিজের কণ্ঠে কোন গান একেবারে নিচু স্কেলে রাখলেও সেটা অন্য শিল্পীর জন্য উঁচু স্কেলে পড়ে। সাঞ্জয়ের গানের গতি, লয়,তাল এতো নিখুঁত ছিল যেন গিটার, ড্রাম এবং সঞ্জয়ে র কণ্ঠ একসাথে মিশে এক অপূর্ব সুর সৃষ্টি করেছে। এখানেই সঞ্জয় এর আসল যাদু। পুরোপুরি বাদ্যযন্ত্রের সাথে মিশে গিয়ে কণ্ঠ দিয়ে তাদের কে দমিয়ে নিজের কণ্ঠকে স্পষ্ট করে তূলে ধরা সাঞ্জয় এর মত আর কেউ পারে না। সাঞ্জয় তাঁর কণ্ঠ দিয়ে দুর্দান্ত বাজতে থাকা বাদ্যযন্ত্রকে তাঁর কণ্ঠ দিয়ে তাদের চেয়েও জোরে ও স্পষ্ট করে সবাইকে গানের কথা বুঝিয়ে দিতো অতি সুন্দর ভাবে। আজো বাংলাদেশের বিশ্বমানের হার্ডরক ব্যান্ড বলতে সবাই যে নামটি উচ্চারন করবে তা হলো ওয়ারফেইজ ও সঞ্জয়। আজ বাংলাদেশের হার্ড রক ধারার ব্যান্ডগুলির শিল্পীরা নাক মুখ খিচিয়ে , বিকৃতভাবে বাংলা উচ্চারন করে গান গায় যা দেখে অবাক হতে হয় । এসব শিল্পীদের গান শুনলে মনে হয় এদের বাংলা শব্দ উচ্চারন করতে কষ্ট হয়। অথচ এর চেয়েও কঠিন কঠিন শব্দ কত দুর্দান্তভাবে সঞ্জয় উচ্চারন করেছে । সঞ্জয় কখনও কোন শব্দ ভুল উচ্চারন করেছে বলে আমাদের জানা নেই। সঞ্জয়ের কাছ থেকে আজকের হার্ডরক ব্যান্ডগুলোর শিল্পীদের অনেক কিছু শেখার আছে। ১৯৯৮ সালের ‘অসামাজিক’ অ্যালবাম দিয়ে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেন অদ্ভুত সুন্দর ও রকগানের সর্বসেরা শিল্পী সঞ্জয়। সঞ্জয় এর চলে যাওয়া আমাদের মতো হতভাগা শ্রোতাদের জন্য ছিল এক বিরাট ধাক্কা ও ক্ষতি। যে ক্ষতি আমরা আজো কাটিয়ে উঠতে পারিনি । আজো ‘ওয়ারফেইজ’ ও সঞ্জয় কে ১ নাম্বারে রেখে বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের হেভিমেটাল ধারার হিসাব শুরু করতে হয় । ৯০ দশকে সঞ্জয় ও ওয়ারফেইজ ছিল তুমুল জনপ্রিয় ও দেশসেরা ব্যান্ডগুলোর একটি। সঞ্জয়ের জনপ্রিয়তা ছিল আকাশছোঁয়া অথচ কোনদিন কোন পত্রিকা , মাগাজিন কিংবা টেলিভিশন চ্যানেলে দেখলাম একটি সাক্ষাৎকার দিতে , কখনও শুনিনি নিজের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য স্রোতে গাঁ ভাসাতে। সবসময় নিজেকে রেখেছিলেন প্রচারের বাহিরে । সত্যি সঞ্জয় আমাদের বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের ‘বিস্ময়’ ও ‘গর্ব’ করা একটি নাম যে নাম ব্যান্ড ইতিহাসে চিরদিন স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে।।

সঞ্জয়ের কণ্ঠের কিছু গানের লিংক –
বসে আছি- https://app.box.com/s/1b5c6ec407be0b00a4ad
শতাব্দীর চেনা পথে চলি- https://app.box.com/s/7a92345247f69303e7a4
জীবনধারা – https://app.box.com/s/e394df3dfea8f732ca3b
ধূপছায়া – https://app.box.com/s/bae61d9f3993cf3b126d
মনে পড়ে – https://app.box.com/s/9sfln3925gaoccm9jd6b
ধূসর মানচিত্র – https://app.box.com/s/9f61b0c07753976e2012

শেয়ার করতে

২ thoughts on “ওয়ারফেইজের সঞ্জয় ও বাংলা হার্ডরক গান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *