:: ফজলে এলাহী ::
ওয়ারফেইজ ও বাংলা হার্ড রক ব্যান্ড সঙ্গীত নিয়ে এই লেখাটি। বাবনা, রাসেল, সঞ্জয়, কমল ও টিপু নামের ৫ কিশোর সবাই তখন স্কুলের ছাত্র। তারা অবসরে তাদের গঠিত ব্যান্ডদল নিয়ে অনুশীলন করতো। তখনো বাংলাদেশ এর মানুষরা তাদের চিনে নাই। তারা প্রথম থেকেই সবসময় ইংরেজি গান গাইতো। তখন স্টেজ এর পারফর্ম বেশি চলতো। তাই যারা স্টেজ শো গুলো দেখত তাদের সবাইকে তাক লাগিয়ে দিতো সেই কিশোর রা। এমন কি তখনকার নামিদামি ব্যান্ড ফিডব্যাক, সোলস, অবসকিউর সহ সবাইকে তারা চমকে দিয়েছিলো তাদের অসাধারণ পারফরমেন্স এর কারনে। এইভাবেই চলছিল কিশোরগুলোর ব্যান্ড ওয়ারফেইজ যারা তখনো কোন বাংলা গান গাইতে জানতো না। ১৯৯০ সালের এক বিকেলে বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীত এর অন্যতম পুরাধা, জনপ্রিয় মাকসুদ ভাই একদিন মিরপুর পল্লবীতে সেই কিশোরদের নিয়ে বসলেন। আলোচনার বিষয় ‘কেন সেই কিশোররা শুধু ইংরেজি গান গাইছে? সেই কিশোরদের সাথে প্রিয় মাকসুদ ভাই টানা ৪ ঘণ্টা একা তর্কযুদ্ধ করে গেলেন। একসময় সেই কিশোররা বাংলা ব্যান্ড এর এই পুরাধার কথা মেনে নিয়ে রাজি হলো ইংরেজি গান বাদ দিয়ে পুরোপুরি বাংলা গান করার এবং পুরো বাংলায় একটি হার্ডরক অ্যালবাম বের করবে শ্রোতাদের জন্য। প্রিয় বন্ধুরা এতক্ষণ খুব সংক্ষিপ্ত করে বললাম ‘ওয়ারফেইজ’ এর বাংলা গান গাওয়া শুরু করার গল্পটি বলছিলাম যা একটি ইতিহাস। আজকের ‘ওয়ারফেইজ’ কে পাওয়ার পেছনে যে মানুষটার সবচেয়ে বড় অবদান তিনি আর কেউ নন একমাত্র আমাদের সবার প্রিয় এবং ব্যান্ড ব্যান্ড সঙ্গীত এর কিংবদন্তি মাকসুদুল হক মাকসুদ ভাই। আমি ‘ওয়ারফেইজ’ এর একজন পাগল ভক্ত হয়ে প্রিয় মাকসুদ ভাইকে এর জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই, কারন তাঁর জন্যই আমরা আজকের এই ওয়ারফেইজকে পেয়েছি। যারা আজ হার্ড রক ব্যান্ড এর বাংলাদেশের প্রতিকৃতি হয়ে আছে। এই হার্ডরক/ হেভিমেটাল ধারায় কত ব্যান্ড এসে হারিয়ে গিয়েছে এবং যাচ্ছে, কিন্তু ‘ওয়ারফেইজ’ শত ভাঙা গড়ার মাঝেও মাথা উঁচু করে আজো টিকে আছে এবং বাংলাদেশ এর ১ম সারির ব্যান্ড হিসেবে গত ৩ দশক ধরে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছে।
১৯৯১ সালে বের হয় ওয়ারফেইজ এর প্রথম অ্যালবাম যা বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের ইতিহাসে ঠাই করে নেয় অসাধারণ সব হার্ডরক গানের জন্য। সেদিন বাংলাদেশের শ্রোতারাও বুঝতে পারলো যে আমাদের ছেলেরাও পারে হার্ডরক/হেভি মেটাল গান গাইতে। অবশ্য এর আগে রকস্ট্রাটা তাদের অ্যালবাম বের করে কিন্তু ওয়ারফেইজ এর মত এতো আলোড়ন তুলতে পারেনি।তবুও রকস্ট্রাটা বেশ ভালোই গেয়েছিল। প্রথম অ্যালবাম এর ‘একটি ছেলে’ ‘বসে আছি’ ‘কৈশোর ‘ ‘স্বাধিকার’ গানগুলো আজো ২৯ বছর পরেও একইরকম নাড়া দেয়। আজো শ্রোতারা ভুলতে পারেনি।
‘ওয়ারফেইজ’ নামটি নূতন করে পরিচয় করিয়ে দিবার দুঃসাহস আমার নেই! গত প্রায় তিন দশক ধরে সমানতালে সব দশকের শ্রোতাদের মাতিয়ে রেখেছে বাংলা হার্ড রক যে ব্যান্ডটি তার নাম ‘ওয়ারফেইজ’। ৮০’র দশকে যখন সারা বিশ্বে ইউরোপ ও অ্যামেরিকার হার্ড রক ব্যান্ডগুলোর জয়জয়কার তখন বাংলাদেশের ব্যান্ড সঙ্গীতে মেলোডি গানের বন্যা চলছিল। শুধু মাঝে মাঝে হোটেল পূর্বানী, শেরাটনে স্টেজ পারফর্মে ‘মাইলস’ ইংরেজি গান পরিবেশন করতো তাতেও শ্রোতাদের তৃপ্তি পুরোপুরি মেটানো সম্ভব হতো না।
সালটা আনুমানিক ১৯৮৪ হবে সেই সময়ে বাংলার কিছু কিশোর সেই ইংরেজি হার্ড রক গেয়ে শোনানোর জন্য নিজেরা একটি ব্যান্ড গঠন করে যার নাম ‘ওয়ারফেইজ’।
১৯৮৪ সালে ওয়ারফেইজ গঠনের সময় যারা ছিলেন তাঁরা হলেন কমল- বেজগিটার ,ড্রামস- হেলাল, মীর- লিড গিটার, নাইমুল- লিড গিটার, বাপ্পি- ভোকাল । পরবর্তীতে মির,হেলাল ও বাপ্পি ব্যক্তিগত কারনে ব্যান্ড ছেড়ে চলে গেলে কমল লিড গিটারের দায়িত্ব নেয়, বাবনা বেজ গিটার ,টিপু ড্রামস ও রাসেদ ভোকাল এর দায়িত্ব নিয়ে ব্যান্ড এ যোগ দেয়। পরবর্তীতে নাইমুল ও রাসেদ চলে গেলে রাসেল কিবোর্ড ও সঞ্জয় ভোকাল এর দায়িত্ব নেয়। অবশ্য তাঁরা দুজন আসার আগে ইন ঢাকা ব্যান্ড এর মাসুক ও ফুয়াদ অতিথি হিসেবে বিভিন্ন শোতে অংশগ্রহন করে।
১৯৯১ সালে বের হয় ওয়ারফেইজ এর প্রথম অ্যালবাম যা বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতের ইতিহাসে ঠাই করে নেয় অসাধারণ সব হার্ডরক গানের জন্য। সেদিন বাংলাদেশের শ্রোতারাও বুঝতে পারলো যে আমাদের ছেলেরাও পারে হার্ডরক/হেভি মেটাল গান গাইতে। অবশ্য এর আগে রকস্ট্রাটা তাদের অ্যালবাম বের করে কিন্তু ওয়ারফেইজ এর মত এতো আলোড়ন তুলতে পারেনি।তবুও রকস্ট্রাটা বেশ ভালোই গেয়েছিল। প্রথম অ্যালবাম এর ‘একটি ছেলে’ ‘বসে আছি’ ‘কৈশোর ‘ ‘স্বাধিকার’ গানগুলো আজো ২৯ বছর পরেও একইরকম নাড়া দেয়। আজো শ্রোতারা ভুলতে পারেনি। সেই অ্যালবাম এ শ্রোতারা সঞ্জয় এর সাথে পায় বাবনা (বর্তমানে আমেরিকায় প্রবাসী) নামের আরেক বিস্ময় কে। যে ‘বৃষ্টি’ গান দিয়ে শ্রোতাদের হৃদয়ে ঠাই করে নেয়। যার গান শুনলে মনে হয় ওয়ারফেইজ এর কেউ না, উদাসী কোন এক শিল্পী নিজের মনে গেয়ে চলেছেন।
আজ ২৯ বছর পরেও বাংলা হার্ডরক গানের কথা উঠলেই ‘বসে আছি একা’ ‘একটি ছেলে’ গান দুটোর নাম চলে আসে সবার আগে। ২০ বছরেও এই গান দুইটির বিকল্প কোন গান কেউ করতে পারেনি। ১৯৯২ ও ১৯৯৩ সালে ‘কোকাকোলা ব্যান্ড এ্যাওয়ার্ড’ এর শ্রেষ্ঠ ব্যান্ড এর পুরস্কার লাভ করে ওয়ারফেইজ যা পরপর ২বার তা লাভ করে তারা। ১৯৯৪ সালে বের হয় ওয়ারফেইজ এর ২য় অ্যালবাম ‘অবাক ভালোবাসা’। প্রথমটার মত এটিও শ্রোতারা লুফে নেয় এবং ওয়ারফেইজ আবারো তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করে। এই অ্যালবাম এর কভার ডিজাইনের জন্য ‘কোকাকোলা ব্যান্ড এ্যাওয়ার্ড ‘’ এর শ্রেষ্ঠ কভার পুরস্কার লাভ করে ওয়ারফেইজ এবং শ্রেষ্ঠ ড্রামার হিসেবে পুরস্কৃত হয় টিপু। যিনি আজো বাংলাদেশ এর একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ ড্রামার হিসেবেই আছেন। ‘অবাক ভালোবাসা’ অ্যালবাম এর টাইটেল গানটি গায় সেই বিস্ময় ও উদাসীন শিল্পী বাবনা। যা তারে সারাজীবনের জন্য শ্রোতাদের মনে ঠাই করে দিয়েছে। এই অ্যালবাম এর অন্যতম হিট গানগুলো ছিল ‘ অন্ধ জীবন’ ‘অন্য ভুবন’ ‘যখন মেঘের চাদর ‘ ‘বন্দী নিয়তি’, ‘এক+এক=দুই’ ‘শেখানো বর্ণনা’ গানগুলি আজো শ্রোতাদের মনে পড়ে। এদিকে বাবনা মিক্সড অ্যালবাম এ (প্রিন্স মাহমুদ এর) নিজের আলাদা একটা জনপ্রিয়তা তৈরি করে ফেলেছে। মিক্সড অ্যালবাম এর মাঝে বাবনার ‘মেঘাচ্ছন্ন আকাশ (শক্তি)” “ছিলে তুমি জীবনে আমার (শক্তি)” “একা হয়ে যাই (ঘৃণা)” “ কোথায় হারালে (ক্ষমা) “ গানগুলো আজো শ্রোতাদের কাঁদায়! বাবনা আজো শ্রোতাদের কাছে এক বিস্ময় রয়ে গেলো। ১৯৯৬ সালের ঈদে বের হয় ওয়ারফেইজ এর ৩য় অ্যালবাম ‘জীবনধারা’ । যেখানে পুরনো সবার সাথে যোগ দেয় নতুন একজন যার নাম ফুয়াদ ইবনে রাব্বি । এই অ্যালবাম এ ওয়ারফেইজ সম্পূর্ণ হার্ডরক থেকে বের হয়ে একটু সফট রক গান বেশি করেছিলো। শুধু ‘জীবনধারা” গানটি ছিল বরাবরের মত একটি জটিল গান। যা শ্রোতারা তাদের প্রিয় তালিকায় নিয়ে নেয়। এছাড়া বিস্ময় কণ্ঠের বাবনা ‘ মৌনতা’ ‘মা’ গান দুটি ছিল অসাধারণ। আর সঞ্জয়ের ‘ধুপছায়া’ গানটি ছিল মেঘ না চাইতে বৃষ্টির মত একটি গান। যা আজো শ্রোতাদের সেই দিনগুলোতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এই অ্যালবাম বের হওয়ার আগেই বাবনা ও রাসেল আমেরিকায় চলে যায়। শুধু মাঝে মাঝে বাবনা এসে অ্যালবাম এর কাজে নিজেকে জড়াতে পারলেও রাসেল এর তা সম্ভব হয়নি। ‘জীবনধারা’ অ্যালবামটিই বলতে গেলে ওয়ারফেইজ এর সাথে বাবনার শেষ অ্যালবাম। এরপর বাবনা পুরোপুরি প্রবাসী হয়ে যায়। ১৯৯৮ সালের রোজার ঈদে মুক্তি পায় ওয়ারফেইজ এর ৪র্থ অ্যালবাম ‘অসামাজিক’ যা হার্ডরক অ্যালবাম গুলোর ইতিহাসে ওয়ারফেইজ এর আরেকটি চমৎকার সংযোজন। যেখানে ওয়ারফেইজ এর সাথে যোগ দেয় বাংলাদেশের সেরা বেইজ গিটারিস্ট সুমন (অর্থহীন) ও অন্যতম প্রতিভাবান লিড গিটারিস্ট ইকবাল আসিফ জুয়েল (লিজেন্ড) । এই অ্যালবাম এ ‘অসামাজিক’ ‘নেই প্রয়োজন’ ‘বন্ধু’ অশনি সংকেত ‘’ ‘ধুসর মানচিত্র’ ‘প্রতিচ্ছবি (সুমন)’ ‘মহানগর’ ও ‘ এমন দিনে’ গানগুলো তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। বিশেষ করে ‘অসামাজিক’ ‘নেই প্রয়োজন’ ‘ধুসর মানচিত্র’ ‘’ এমন দিনে’ গানগুলো আমাদের বাংলা ব্যান্ড সঙ্গীতে স্থায়ী আসন নিয়ে নিয়েছে। এই অ্যালবাম এর পরপরই ব্যক্তিগত ব্যস্ততার কারনে মূল ভোকাল সাঞ্জয় ব্যান্ড ছেড়ে চলে যায় যা ছিল শুধু ওয়ারফেইজ এর জন্য নয় পুরো ব্যান্ড সঙ্গীত ও শ্রোতাদের জন্য বিরাট একটি ধাক্কা। এই অ্যালবাম এর একটি চমৎকার ব্যাপার ছিল যে কমল, সুমন ও জুয়েল এর একসাথে চমৎকার দুর্দান্ত পারফর্ম। যা শ্রোতাদের মুগ্ধ করে। এতো সুন্দর গিটার ও ড্রামের সংমিশ্রণ এখনকার অনেক হার্ডরক ব্যান্ড গুলো করতে পারেনি। এটাই ওয়ারফেইজ কে অন্য সব হার্ড রক ব্যান্ড এর কাছ থেকে আলাদা করে রেখেছে। যে দলে আছে বাংলাদেশ এর শ্রেষ্ঠ এক ড্রামার (টিপু) ও বাংলাদেশ এর শ্রেষ্ঠ একজন গিটারিস্ট (কমল) তাঁরা তো সবার আলাদা হবেই এটাই স্বাভাবিক। ওরাফেইজ এর সবচেয়ে মূল শক্তি তাদের অসাধারণ সব কম্পোজিশন। তাঁরা খুব ভাল করেই জানে যে কোন কথার গানে কেমন কম্পোজিশন করতে হবে। এরপর হলো গানের কথার গভীরতা। যার কারনে এতো ভাঙ্গাগড়ার মাঝেও ওয়ারফেইজ আজো সবার সেরা। অন্য সব হার্ডরক ব্যান্ড গুলোর অনুপ্রেরণা। ‘ওয়ারফেইজ’ এর গিটারিস্ট কমল ও ভোকাল সাঞ্জয় এই ২ জন মানুষ সম্পর্কে আলাদাভাবে না বললেই নয়।
সঞ্জয়- ওয়ারফেইজ এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও ভোকাল সঞ্জয় কে নিয়ে আলাদা করে না লিখাটা খুব অন্যায় হয়ে যাবে। আমাদের ৯০ দশকের ব্যান্ড সঙ্গীতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পাওয়া সঞ্জয়। যা বিকল্প আজো বাংলা হার্ডরক/ হেভি মেটাল গানে পাওয়া যায়নি। হার্ডরক গান কিভাবে গাইতে হয় সাঞ্জয় তা ভালভাবে দেখিয়ে দিয়ে গেছে। সাঞ্জয় এমনি এক উচ্চু মানের শিল্পী যার গান অন্য কোন ব্যান্ড তাদের স্টেজ শো গুলোতে গাইতে চায়না এবং গাইতে পারে না। এমনকি আমি নিজেও অনেক বড় বড় কনসার্ট দেখেছি যেখানে বাচ্চু, মাকসুদ, জেমস এর গানগুলো অনায়াসে গাইতে পারছে অন্য ব্যান্ডগুলো সেখানে তাদের ওয়ারফেইজ তথা সঞ্জয়ের কোন গান গাইতে অনুরোধ করলে তাঁরা খুব লজ্জা পায়। কেউ সাহস দেখায় না সঞ্জয় এর গান গাওয়ার। কারন সাঞ্জয় যে স্কেলে গান শুরু করে সেই স্কেলে অনেক শিল্পী যেতে পারে না। সঞ্জয় এমন এক শিল্পী যার স্কেলে নিচে নামানো খুব কঠিন একটা কাজ। সঞ্জয় নিজের কণ্ঠে কোন গান একেবারে নিচু স্কেলে রাখলেও সেটা অন্য শিল্পীর জন্য উঁচু স্কেলে পড়ে। সঞ্জয়ের গানের গতি, লয়,তাল এতো নিখুঁত ছিল যেন গিতার, ড্রাম এবং সাঞ্জয় একসাথে মিশে এক অপূর্ব সুর সৃষ্টি করেছে। এখানেই সঞ্জয় এর আসল যাদু। পুরোপুরি বাদ্যযন্ত্রের সাথে মিশে গিয়ে কণ্ঠ দিয়ে তাদের কে দমিয়ে নিজের কণ্ঠকে স্পষ্ট করে তূলে ধরা সঞ্জয় এর মত আর কেউ পারে না। সঞ্জয় তাঁর কণ্ঠ দিয়ে দুর্দান্ত বাজতে থাকা বাদ্যযন্ত্রকে তাঁর কণ্ঠ দিয়ে তাদের চেয়েও জোরে ও স্পষ্ট করে সবাইকে গানের কথা বুঝিয়ে দিতো অতি সুন্দর ভাবে। আজো বাংলাদেশের বিশ্বমানের হার্ডরক ব্যান্ড বলতে সবাই যে নামটি উচ্চারন করবে তা হলো ওয়ারফেইজ ও সঞ্জয়। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে একটি হার্ডরক ব্যান্ড এর প্রায় ৩ দশক টিকে থাকা ওয়ারফেইজ এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান করে। এই রেকর্ড অন্য কোন হার্ড রক ব্যান্ড ভাঙতে পারবে বলে আমি ব্যক্তিগত ভাবে বিশ্বাস করি না। বাংলাদেশ এর হার্ডরক ব্যান্ড এর ইতিহাসে ওয়ারফেইজ কে ১ নং আসন থেকে সরিয়ে ফেলা কোনদিন সম্ভব নয়।
১৯৯৮ সালের অসামাজিক অ্যালবাম দিয়ে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নেন অদ্ভুত সুন্দর ও রকগানের সর্বসেরা শিল্পী সঞ্জয়। সঞ্জয় এর চলে যাওয়া আমাদের মতো হতভাগা শ্রোতাদের জন্য ছিল এক বিরাট ধাক্কা ও ক্ষতি। যে ক্ষতি আমরা আজো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। সঞ্জয়, সুমন, জুয়েল, ফুয়াদ চলে যাবার পর ওয়ারফেইজ এ বিরাট এক শুন্যতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু দলনেতা কমল এর আন্তরিক চেষ্টায় ও টিপুর পরিশ্রম ফলে তা কাটিয়ে উঠে। মাঝে কিছুদিন পেনটাগন এর রুমেল অতিথি গিটারিস্ট হিসেবে বিভিন্ন শোতে অংশগ্রহন করে। তখন ব্যান্ড এ যোগ দেয় কীবোর্ডিসট –শামস, গিটার ও ভোকাল- বালাম (বাবনার মামাতো ভাই) , বেজ গিটার – বিজু, ভোকাল- মিজান । আর পুরনো দুই যোদ্ধা কমল ও টিপু তো আছেনই। এই লাইনআপ নিয়ে ২০০১ সালের কুরবানির ঈদে মুক্তি পায় আলো অ্যালবামটি। যেটার কভার ছিল খুব চমৎকার। নতুন এই লাইনআপ নিয়েও ‘আলো’ অ্যালবাম বাজারে শ্রোতাদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। বলা যায় ‘আলো’ ওয়ারফেইজ এর আরেকটি সফল অ্যালবাম। যেখানে শুরুতেই মিজান এর ‘হতাশা’ গানটি দিয়ে শুরু করেই বালাম এর ‘যত দুরেই থাকো’ গানটি শুনে শ্রোতারা চমকে উঠে। বালাম এর আগেও তার ব্যান্ড নিয়ে থাকলেও মুলত ‘আলো’ অ্যালবাম দিয়ে এই দশকের শ্রোতারা সহ পুরনো শ্রোতাদের কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা ও জনপ্রিয়তা পায়। ‘আলো’ অ্যালবাম এ শ্রোতারা সঞ্জয় এর ঝাঁঝালো বারুদ না পেলেও বেশ কয়েকটি চমৎকার গান পায়। যার কারনে ‘আলো’ অ্যালবামটি ব্যবসাসফল হয়। এই অ্যালবাম এর সবচেয়ে আলোচিত ও জনপ্রিয় গানটির নাম ‘বেওয়ারিশ’ যা মিজান কে বিপুল জনপ্রিয়তা এনে দেয়। এছাড়াও বালাম এর ‘ সেই সৃতিগুলো’ , ‘সময়ের ছলনায়’ ‘ মিজান এর ‘আলো’, ‘বৃষ্টি’, গানগুলোও বেশ চমৎকার ও শ্রোতাপ্রিয় হয়। এই অ্যালবাম এর হিট গান এর সংখ্যা ৮টি। গানগুলো। যা এই অ্যালবামটিকে সাঞ্জয় ও বাবনার পরবর্তী যুগের সবচেয়ে ব্যাবসাসফল অ্যালবাম বলা হয়। এই অ্যালবাম টি উৎসর্গ করা হয় অ্যালবাম এর কাজ চলাকালীন সময়ে প্রিয় কমল ভাইয়ের আপন ছোট ভাই কনক (নামটার ব্যাপারে একটু সন্দেহ আছে) আমেরিকার এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয় তাকে,এই অ্যালবাম এ হার্ডরক এর পাশাপাশি বেশকিছু সফট রক ও মেলোডি গান ছিল যা সত্যিই চমৎকার। আর সব গানেই অসাধারণ কমল ভাইয়ের গীটারের কথা নাইবা বললাম।
কমল- কমল কে নিয়ে কিছু না বললেই নয়। কমল সেই ১৯৮৪ থেকে আজ অবধি ওয়ারফেইজে আছেন। যিনি বাংলাদেশ এর একজন বিশ্বমানের গিটারিস্ট। একাধারে বেজ ও লিড দুটো গিটারেই যিনি পারদর্শী। আমি নিজে এক আর্মি স্টেডিয়াম এর এক কনসার্টে তাঁরে গিটার বাজিয়ে কিভাবে হাজার হাজার মানুষকে উম্মাদ করে দিতে পারেন তা দেখেছি। সেই কনসার্টে দেখেছি গিটার বাজাতে বাজাতে তাড় ছিঁড়ে ফেলেছেন অথচ সেই ছিরা তাড়ে অবিরাম ভয়ঙ্কর সুন্দর ভাবে বাজিয়ে চলেছেন। যা ভাষায় প্রকাশ করে বুঝানো সম্ভব নয়। এই মানুষটা সারাজীবন মিডিয়া থেকে দূরে থেকেছেন। তাকে তেমন ভাবে মিডিয়ায় কোনদিন প্রকাশ হতে দেখিনি। অথচ তাঁর অনেক ছাত্র আজ বাংলাদেশ এর বিভিন্ন হার্ডরক ব্যান্ড এ গিটার বাজাচ্ছে। যারা নিয়মিত ওয়ারফেইজ এর গান শুনেন তাঁরা নিশ্চয়ই কমল এর গিটার এর সম্পর্কে জানেন। একজন উঁচু মানের ,বিশ্বমানের গিটারিস্ট আমাদের সবার অজান্তে রয়ে গেছেন তারে আমরা সম্মান করতে পারিনি যা ভাবলে খুব কষ্ট হয়। অথচ এই কমল যদি বাংলাদেশ এ না জন্মে আমেরিকায় জন্ম গ্রহন করতো তাহলে সারা বিশ্ব তাঁরে চিনতো এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তাঁর মতো একজন গিটারিস্ট লাখে একটা পাওয়া কষ্ট আছে। যে গিটার কে খেলনা মনে করে যেমন ইচ্ছা তেমন বাজাতে পারে। কমল ভাই আমার দেখা এক অদ্ভুত প্রতিভা । যিনি শুধু একজন দুর্দান্ত গিটারিস্ট নন একজন দুর্দান্ত গীতিকার ও সুরকারও বটে। ওয়ারফেইজ এর অধিকাংশ জনপ্রিয় গানের গীতিকার ও সুরকার এই কমল ভাই। যিনি আমেরিকা থেকে ব্যবসায় স্নাতকোত্তর করে এসেও এই দেশেই শুধু গান এবং গিটার নিয়ে সারাজীবন কাটিয়ে দিয়েছেন। একবারও সেই বিদেশ তাঁরে ধরে রাখতে পারেনি। আমি বাংলাদেশ এর গিটারিস্টদের মধ্য তাকে ১ নং ধরে তারপর বাকীদের গুনবো। আমি একবার নয় কয়েকবার তাঁর সেই যাদুর গিটার বাজানো দেখেছি যা আমার কাছে সবসময় স্মরণীয় হয়ে থাকবে। আমার মনের সব শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা রইলো কমল ভাইয়ের জন্য। তিনি বাংলাদেশ এর ব্যান্ড সঙ্গীত এর জন্য যে ত্যাগ করেছেন তা কোনদিন ভুলার নয়। সালাম কমল ভাই ! সালাম !
আলো অ্যালবাম এর পর ভোকাল মিজান এর সাথে অন্য সদস্যদের বনিবনা না হওয়ায় মিজান ব্যান্ড ছেড়ে চলে যায়। তখন মূল ভোকাল হিসেবে বালাম ব্যান্ড এর দায়িত্ব নেয়। বালামকে মূল ভোকাল করেই ২০০৩ সালে বের হয় ওয়ারফেইজ এর অ্যালবাম ‘মহারাজ’ যার অ্যালবাম এর কভার সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে । তবুও ‘আলো’র মত এই অ্যালবাম এতো ব্যবসাসফল হয়নি। মহারাজ অ্যালবাম এর ‘মহারাজ’ গানটি ওয়ারফেইজ এর এই দশকের একটি জনপ্রিয় ও সফল গান। যা সব কনসার্টে ওয়ারফেইজ কে বসে আছি, একটি ছেলে’র মত নিয়মিত এখনও গাইতেই হয়। মহারাজ অ্যালবাম এর অন্য গানগুলো ছিল ‘বাঙ্গালিরা আর কত দেখবে’ ‘যে পথে সুখ তুমি খুঁজেছ’ ‘সন্ধ্যার আলো ‘ সহ আরও কিছু গান । মহারাজ অ্যালবাম এ শ্রোতারা বালাম এর হার্ডরক গানে বেশ পারদর্শীতা আছে তা বুঝতে পারে। মহারাজ অ্যালবাম এর পর বালাম দল ছেড়ে একক অ্যালবাম নিয়ে নিজেকে গড়তে যায়। অথচ আজকের এই বালাম এর জনপ্রিয়তার পেছনে ওয়ারফেইজ এর অবদান সবচেয়ে বেশি। বালাম কিশোর বেলা থেকে গান করলেও তাকে শ্রোতারা ওয়ারফেইজ এর মাধ্যমেই বেশি গ্রহন করে নেয়। যা তার পরবর্তী একক অ্যালবাম এর সফলতার পেছনেও ব্যাপক প্রভাব ফেলে। এখনও শ্রোতারা বালাম কে ওয়ারফেইজ এর বালাম হিসেবে সহজে চিনে নেয়।
বর্তমানে ওয়ারফেইজ এ আবার মিজান ফিরে এসেছে এবং মূল ভোকাল এর দায়িত্ব পালন করছে। গত রোজার ঈদে (২০১১) মিক্সড অ্যালবাম সমর্পণে ওয়ারফেইজ লালনের তিনটা চমৎকার গান অতি চমৎকার ভাবে পরিবেশন করে। সমর্পণ অ্যালবাম এ মুলত ওয়ারফেইজ এর সবগুলি গানেই একমাত্র দুর্দান্ত হয়েছে যা তাদের শ্রেষ্ঠত্ব আবারো প্রমান করলো। ২০১২ সালে ‘ওয়ারফেইজ’ তাদের সর্বশেষ অ্যালবাম ‘সত্য’ প্রকাশ করে।
ওয়ারফেইজ এর প্রকাশিত অ্যালবামগুলো
১ম অ্যালবাম –ওয়ারফেইজ (সেলফ টাইটেলড)
২য় অ্যালবাম –অবাক ভালোবাসা
৩য় অ্যালবাম – জীবনধারা
৪র্থ অ্যালবাম – অসামাজিক
৫ম অ্যালবাম- আলো
৬ষ্ঠ অ্যালবাম- মহারাজ
৭ম অ্যালবাম – পথচলা (আনপ্লাগড)
৮ম অ্যালবাম- সত্য
মিক্সড – ধুন ও সমর্পণ ।
জনপ্রিয় গান
- বসে আছি (Warfaze)
- একটি ছেলে (Warfaze)
- স্বাধিকার (Warfaze)
- অবাক ভালোবাসা (অবাক ভালোবাসা)
- ধূপছায়া (জীবনধারা)
- জননী (জীবনধারা)
- নেই প্রয়োজন (অসামাজিক)
- অসামাজিক (অসামাজিক)
- প্রতিচ্ছবি (অসামাজিক)
- ধূসর মানচিত্র (অসামাজিক)
- মুক্তি চাই (মিশ্র অ্যালবাম-ধূন)
- মনে পড়ে (মিশ্র অ্যালবাম-ধূন)
- আলো (আলো)
- যত দূরে (আলো)
- সময় (আলো)
- বেওয়ারিশ (আলো)
- মহারাজ (মহারাজ)
- তোমাকে (পথচলা)
- পূর্ণতা (সত্য)
- সত্য (সত্য)
- না (সত্য)
- রূপকথা (সত্য)
শোক নামে একটি অপ্রকাশিত গান রয়েছে।