কাজী শাহেদ আহমেদের আলো-আঁধার

:: মারুফ কামাল খান ::

মানবজীবনে ছোট-বড় কতো রকমের বিষ্ময়কর ঘটনাই না ঘটে! সব কিছুর হেতু ও ব্যাখ্যাও খুঁজে পাওয়া যায়-না।

বাংলাদেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে আমেরিকার ছোট্ট এক নিসর্গ-শহরে গত রাতে ঘুমিয়ে পড়ার আগে শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম নানান কথা। হঠাৎ কেন জানি-না মনে এলো কাজী শাহেদ আহমেদের কথা। অনেক দিন ধরেই তার কোনও খোঁজখবর বা সাড়াশব্দ নেই। করোনার ছোবলে অনেকে মারা গেছেন। বিশেষ করে সিনিয়র সিটিজেনদের অনেকেই হারিয়ে গেছেন চিরতরে। কাজী শাহেদ কি বেঁচে আছেন? স্মৃতি হাতড়ে দেখলাম। না, উনার মৃত্যুসংবাদ তো পাইনি।

ভাবলাম, উনার তো বয়স হয়েছে। হয়তো অসুস্থ হয়ে আছেন। অথবা ছেলেদের হাতে সব দায়-দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে নিজে হয়তো নির্ঝঞ্ঝাট অবসর জীবন বেছে নিয়েছেন। হয়তো খবরের অন্তরালে নিরুপদ্রব থাকাটাই তার পছন্দ এখন।

কাজী শাহেদের কথা ভাবতেই মানসপটে ভেসে উঠলো একটা তুলনামূলক চিত্র। তিনি ধোয়া তুলসিপাতা বা অবিতর্কিত লোক ছিলেন না। তবে কিছু মূল্যবোধ তাদের ছিল। সৌজন্যবোধ ও চক্ষুলজ্জার প্রমাণ দিয়েছেন বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে। তাছাড়া সব কিছুতে ন্যূনতম একটা ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করতে দেখেছি। কাজী শাহেদদের সঙ্গে তুলনা করলেও তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে একেবারেই ‘নষ্ট মানুষ’ ছাড়া আর কিছু বলার সুযোগ থাকে না।

আমি জানি-না কাজী শাহেদ কেন গতরাতে আচমকা আমার ভাবনার মধ্যে উদিত হয়েছিলেন। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই পেলাম তার মৃত্যুসংবাদ। চমকে উঠে অনেকক্ষণ গুম মেরে বসে ছিলাম। কী আশ্চর্য ব্যাপার! কী বিষ্ময়কর কাকতাল! কী অদ্ভূত টেলিপ্যাথি! ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। আমি তার বিদেহী আত্মার পারলৌকিক সদগতি কামনা করি।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সিনিয়র কর্নেল কাজী শাহেদ আহমেদ স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়েই মেতে ছিলেন। জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর তিনি প্রথম অভিজাত বলয়ে কিছুটা পাদপ্রদীপের আলোয় আসেন। শোনা যায়, তিনি পাকিস্তান মিলিটারি একাডেমিতে এরশাদ সাহেবের ঘনিষ্ঠ কারুর ইনস্ট্রাক্টর ছিলেন। তাই এরশাদ শাসনামলে সরকারি আনুকূল্যে তার এক সময়কার স্যারের তেজারতি দ্রুত প্রসারিত হয়।

২০০১ সালের নির্বাচনে চার দলীয় জোটের ভূমিধ্বস বিজয়ের আগ থেকেই কাজী শাহেদ বিএনপির সঙ্গে সৌহার্দ্য স্থাপনের চেষ্টা শুরু করেন। তার পত্রিকার ভূমিকায় কিছুটা পেশাদারিত্ব আনার চেষ্টা করেন। বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম দিকে নিয়মিত জাতীয় পর্যায়ের সংবাদ-মাধ্যমের সম্পাদকদের সঙ্গে মতবিনিময় করতেন। এই ‘মিট দ্য এডিটর্স’ অনুষ্ঠানের প্রশ্নোত্তর পর্ব একটু জটিলতার দিকে মোড় নিলে কাজী শাহেদ বলতেন : ম্যাডাম, আর কতো? আমাদের মতন অসুস্থ ও বয়স্ক লোকদের সময়মতো খাবার খেতে হয়। এখন প্রায় দুটো বাজে। অনেক হয়েছে। এবার দয়া করে আমাদেরকে চারটে দানাপানি দেন। খেয়ে বিদায় হই।

তবে কাজী সাহেব ব্যাপক আলোচিত হন এবং পরিচিতি পান এরশাদ পতনের পর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নির্বাচিত বিএনপি সরকার আমলে। জেনারেল নাসিম তখন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা প্রধান। তিনি সুদূরপ্রসারী উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার আওতায় প্রণীত গোয়েন্দা রিপোর্টের অস্ত্র কাজে লাগিয়ে সশস্ত্রবাহিনীর পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারদের অবসর, অগুরুত্বস্থানে বদলি ও কোনঠাঁসা করার প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষম হন। সিজিএস পদে জেনারেল মাহবুব ছাড়া আর সকল গুরুত্বপূর্ণ পোস্টিং থেকে অমুক্তিযোদ্ধাদের হটিয়ে দেয়া হয়। বিপরীতে সকল কমান্ডিং পজিশনে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের বসানো হয়। এ সকল পদক্ষেপে সশস্ত্রবাহিনীর জন্য অপরিহার্য ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই সব আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার হাত দিয়েই করিয়ে নেয়া সম্ভব হয়। জেনারেল নাসিম প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে তার একটি শক্তিশালী প্রভাববলয়ও তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন।

নাসিমের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পরের ধাপে প্রয়োজন পড়ে পরিকল্পিত প্রচারণা এবং এই লক্ষ্যে ডেডিকেটেড মিডিয়া। এ পর্যায়ে কাজী শাহেদের অর্থায়নে আবির্ভূত হয় আজকের কাগজ নামের দৈনিক পত্রিকা। পত্রিকাটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রচার এবং জামায়াত ও রাজাকারবিরোধী অ্যাক্টিভিজমের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। সে সময় এসব তৎপরতায় অসন্তুষ্ট মহল থেকে বলা হয় যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় কর্নেল শাহেদ পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধ করেছেন এবং তার পত্রিকার সম্পাদক নাইমুল ইসলাম খান একজন স্বাধীনতাবিরোধীর পুত্র। কিন্তু ওই ডামাডোলের মধ্যে এসব তথ্য হালে পানি পায়নি।

এরই ধারাবাহিকতায় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালত নামে মক ট্রায়ালের আয়োজন এবং সেই তথাকথিত আদালতের রায় বাস্তবায়নের দাবিতে দেশজুড়ে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা সম্ভব হয়। বিএনপিকে সরকার গঠনে সমর্থন প্রদানকারী জামায়াত এই সব ঘটনাপ্রবাহের ফলে সৃষ্ট প্রবল রাজনৈতিক ঘুর্ণিপাকে বিএনপি থেকে সরে যায় এবং এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের আন্দোলনের মিত্রে পরিণত হয়।

তবে কাজী সাহেব ব্যাপক আলোচিত হন এবং পরিচিতি পান এরশাদ পতনের পর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নির্বাচিত বিএনপি সরকার আমলে। জেনারেল নাসিম তখন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা প্রধান। তিনি সুদূরপ্রসারী উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার আওতায় প্রণীত গোয়েন্দা রিপোর্টের অস্ত্র কাজে লাগিয়ে সশস্ত্রবাহিনীর পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারদের অবসর, অগুরুত্বস্থানে বদলি ও কোনঠাঁসা করার প্রকল্প বাস্তবায়নে সক্ষম হন। সিজিএস পদে জেনারেল মাহবুব ছাড়া আর সকল গুরুত্বপূর্ণ পোস্টিং থেকে অমুক্তিযোদ্ধাদের হটিয়ে দেয়া হয়। বিপরীতে সকল কমান্ডিং পজিশনে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের বসানো হয়। এ সকল পদক্ষেপে সশস্ত্রবাহিনীর জন্য অপরিহার্য ভারসাম্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এই সব আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার হাত দিয়েই করিয়ে নেয়া সম্ভব হয়। জেনারেল নাসিম প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে তার একটি শক্তিশালী প্রভাববলয়ও তৈরি করে নিতে পেরেছিলেন।

আরও পরে জেনারেল নাসিম সেনাপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত হয়। কিন্তু ততোদিনে মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মধ্যেই দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হওয়ায় কেয়ারটেকার সরকার আমলে ক্ষমতা দখলের ব্যাপারে জেনারেল নাসিমের ক্যু-চেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এসব ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ হয়ে আছে। আমি আজ সে আলোচনায় যাবো না।

আজকের কাগজ অ্যাক্টিভিজমের তুঙ্গে থাকতেই এক পর্যায়ে নাইমুল ইসলাম খানের গ্রুপের সঙ্গে কাজী শাহেদের প্রকাশ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এর নেপথ্যে জেনারেল নাসিমের সঙ্গে কাজী শাহেদের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছিল বলে শোনা যায়। যা-হোক, কাজী শাহেদ রাতারাতি নাইমুলদের সদলবলে বের করে দেন। তবে অচিরেই এই গ্রুপটি জেনারেল নাসিমের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় সাবের হোসেন চৌধুরীর অর্থায়নে ভোরের কাগজ পত্রিকা বের করিয়ে সেখানে পুনর্বাসিত হয়।

এরপর সম্ভবতঃ আত্মরক্ষার্থে কাজী শাহেদ আহমেদ আওয়ামী লীগের দিকে ঝুঁকে পড়েন। ভাস্কর রাসাকে দিয়ে ‘হাস্যোজ্জ্বল বঙ্গবন্ধু’ নামে এক ভাস্কর্য বানিয়ে পত্রিকা অফিসের চত্বরে স্থাপন করেন। কিন্তু তবুও ১৯৯৬-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন লাভে ব্যর্থ হন তিনি এবং সক্রিয় রাজনীতি থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে গুটিয়ে নেন।

২০০১ সালের নির্বাচনে চার দলীয় জোটের ভূমিধ্বস বিজয়ের আগ থেকেই কাজী শাহেদ বিএনপির সঙ্গে সৌহার্দ্য স্থাপনের চেষ্টা শুরু করেন। তার পত্রিকার ভূমিকায় কিছুটা পেশাদারিত্ব আনার চেষ্টা করেন। বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসেবে প্রথম দিকে নিয়মিত জাতীয় পর্যায়ের সংবাদ-মাধ্যমের সম্পাদকদের সঙ্গে মতবিনিময় করতেন। এই ‘মিট দ্য এডিটর্স’ অনুষ্ঠানের প্রশ্নোত্তর পর্ব একটু জটিলতার দিকে মোড় নিলে কাজী শাহেদ বলতেন : ম্যাডাম, আর কতো? আমাদের মতন অসুস্থ ও বয়স্ক লোকদের সময়মতো খাবার খেতে হয়। এখন প্রায় দুটো বাজে। অনেক হয়েছে। এবার দয়া করে আমাদেরকে চারটে দানাপানি দেন। খেয়ে বিদায় হই।

কাজী শাহেদের ছিল স্যানিটারি পায়খানার জন্য কংক্রিটের স্লাব তৈরির ফ্যাক্টরি। ধুরন্ধর ব্যবসায়ী রাতারাতি সেটিকে সিমেন্টের খুঁটি তৈরির কারখানায় রূপান্তরিত করেন। খবর রটে যায় কাজী শাহেদ এককভাবে সরকারকে ইলেক্ট্রিক পোল সরবরাহ করে লালে লাল হয়ে গেছেন। অনেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে খুঁটি বানাবার কাজে। তারেক রহমানের ব্যবসায়ী বন্ধু ও পার্টনার গিয়াসউদ্দিন আল-মামুনও ‘খাম্বা’ নাম দিয়ে একটা ফ্যাক্টরি খোলেন। তবে এ ব্যবসায় অনেক লোক চলে আসায় তীব্র প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়। এতে প্রতিযোগিতামূলকভাবে টেন্ডারে দরও কমতে থাকে।

জোট সরকারের আমলেই জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে আর্সেনিক দুষণের ওপর একটি গবেষণা চালায় এবং তাদের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, কাঠের বৈদ্যুতিক খুঁটি আর্সেনিক দুষণের একটি প্রধান উৎস। কাঠের খুঁটি যাতে সহজে পচে না যায় তার জন্য বৃটিশ আমল থেকেই মাটিতে পোতা অংশটি আর্সেনিক দ্রবণে চুবিয়ে নেয়া হতো। সেই আর্সেনিক চুইয়ে ভূগর্ভস্ত পানির স্তরকে দুষিত করছিল। বিশেষজ্ঞরা অবিলম্বে এই সব কাঠের খুঁটিকে সিমেন্টে তৈরি খুঁটি দিয়ে রিপ্লেস করার জন্য সরকারকে পরামর্শ দেয়।

কাজী শাহেদের ছিল স্যানিটারি পায়খানার জন্য কংক্রিটের স্লাব তৈরির ফ্যাক্টরি। ধুরন্ধর ব্যবসায়ী রাতারাতি সেটিকে সিমেন্টের খুঁটি তৈরির কারখানায় রূপান্তরিত করেন। খবর রটে যায় কাজী শাহেদ এককভাবে সরকারকে ইলেক্ট্রিক পোল সরবরাহ করে লালে লাল হয়ে গেছেন। অনেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে খুঁটি বানাবার কাজে। তারেক রহমানের ব্যবসায়ী বন্ধু ও পার্টনার গিয়াসউদ্দিন আল-মামুনও ‘খাম্বা’ নাম দিয়ে একটা ফ্যাক্টরি খোলেন। তবে এ ব্যবসায় অনেক লোক চলে আসায় তীব্র প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয়। এতে প্রতিযোগিতামূলকভাবে টেন্ডারে দরও কমতে থাকে।

এসময় কাজী শাহেদ সবাইকে ডেকে বলেন : “ভাতিজারা, এমন করতে থাকলে তো সবার ব্যবসাই লাটে উঠবে।” তিনি বুদ্ধি দেন, কম্পিটিশনে না নেমে সরকারি চাহিদা অনুযায়ী খুঁটি নিজেদের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে ভাগাভাগি করে সরবরাহ করার। এতে দর কমার ঝুঁকি থাকবে না এবং সকলেই মুনাফার অংশীদার হবে। এটা সবাই মেনে নিয়ে ভাগাভাগির দায়িত্ব আঙ্কেলের ওপর ন্যস্ত করেন। ফলে বৈদ্যুতিক খুঁটি সরবরাহের ব্যবসায় কাজী শাহেদের আধিপত্য বহাল থাকে। তিনি একাই সরকারকে ষাট শতাংশের বেশি খুঁটি সরবরাহ করেন। আর বাকিটা সবাই মিলে ভাগে জোকে সরবরাহ করে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রচারণায় সব দায় চাপে ‘খাম্বা’র ঘাড়ে। আর এতে তারেক রহমানের কোনও অংশীদারিত্ব না থাকা সত্বেও তিনি কলঙ্কিত হন।

কেবল বৈদ্যুতিক খুঁটি ও পত্রিকাই নয় কাজী শাহেদ আহমেদ স্বীয় যোগ্যতায় এক বিশাল বাণিজ্য-সাম্রাজ্য স্থাপনে সক্ষম হন। তার মালিকানাধীন জেমকন গ্রুপের আওতায় তেতুলিয়ায় মস্ত এলাকা জুড়ে রয়েছে সহস্রাধিক একর জমিতে চা-বাগান। রফতানিযোগ্য উন্নতমানের দামি অর্গানিক চা উৎপাদিত হয় ওই বাগানে। অন্যান্য কৃষিজাত অর্গানিক শষ্যেরও খামার আছে তার। আছে ‘মিনাবাজার’ নামের চেইন ডিপার্টমেন্ট স্টোর। তিনি ইউল্যাব ইউনিভার্সিটিসহ আরও অনেক ব্যবসার মালিক।

কাজী শাহেদ আহমেদ সৃজনশীল লেখালেখিতেও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। ক্রীড়া সংগঠক হিসেবেও সক্রিয় ছিলেন। তিনি ছিলেন সংস্কৃতিমনা মানুষ। নিজের বাগানবাড়িতে নিয়মিত গানবাজনার জলসা আয়োজন করতেন তিনি। অনেক তারকা শিল্পী ও সমঝদাররা তাতে অংশ নিতেন। সে আসরে আমাকেও দু’-একবার নিমন্ত্রণ করেছিলেন তিনি কিন্তু নানা কারণে যাওয়া হয়ে ওঠেনি কখনো।

সরকারে থাকতেই বিএনপি আলাদা আলাদা করে বিভাগীয় কর্মী সন্মেলনের উদ্যোগ নেয়। ভেন্যু ছিল গণভবন চত্ত্বর এবং আয়োজনের দায়িত্ব অর্পিত হয় দলের তৎকালীন সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব তারেক রহমানে ওপর। আমি তখন প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা-বিবৃতি লেখার দায়িত্বে প্রেস উইংয়ে নিয়োজিত। এর আগে ২০০১ সালের নির্বাচনী প্রচারণার কাজ আমরা করি সেগুনবাগিচায় বসে শফিক রেহমানের নেতৃত্বে ছোট্ট টিমে। আমি মূলতঃ লিখতাম, শফিক ভাই এডিট করতেন এবং বনানীর ‘হাওয়া’ বাড়িতে স্থাপিত চেয়ারপার্সনের অফিসের সঙ্গে লিয়াজোঁ রাখার দায়িত্বে ছিল ছোটন নামে সুপরিচিত নুরুল ইসলাম ভুঁইয়া। নির্বাচনের পর আমাকে প্রায় জোর করেই প্রধানমন্ত্রীর অফিসে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়।

যাই-হোক, সেটা আলাদা প্রসঙ্গ। ছোটন এসে একদিন বললেন, তারেক সাহেব আমাকে পাঠিয়েছেন। উনি বলেছেন, তিনি চান প্রতিটি বিভাগীয় কর্মী সন্মেলনে আপনি যেন উপস্থিত থেকে পর্যবেক্ষণ করেন। সন্মেলনগুলো শেষ হলে উনি সব মিলিয়ে আপনাকে একটি লেখা লিখবার অনুরোধ করেছেন।

বললাম, আমি রাজি আছি। তবে লেখার ব্যাপারে আমার পূর্ণ স্বাধীনতা থাকতে হবে। আমি যা ভালো মনে করি তাই লিখবো। ডিক্টেট করতে পারবে না কেউ।

ছোটন চলে গেলেন। একটু পর তারেক রহমান আমাকে ফোন করে বললেন, “আপনার লেখার ব্যাপারে আমি ডিক্টেট করবো, এমন ধারণা কেন হলো আপনার?” আমি বললাম, আপনার এ প্রশ্নের ভেতরে যে বার্তা দিয়েছেন তাতে আমি খুশি। ঠিক আছে, আমি লিখবো।

আমি লিখেছিলাম এবং তা’ তখনকার সামনের সারির ৭/৮ টি পত্রিকায় একযোগে ছাপা হয়েছিল ‘তিন প্রজন্মের বিএনপি’ শিরোনামে। আজকের কাগজে লেখাটি প্রকাশের জন্য আমি পাঠিয়েছিলাম এনাম আবেদিনের হাত দিয়ে। আমার প্রিয়ভাজন এনাম তখন আজকের কাগজে সিটি এডিটর কিংবা স্পেশাল করেস্পন্ডেন্ট। এনাম ফোন করে বললো, লেখাটি নিয়ে কাজী সাহেব আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চান। উনি বিকেলে আপনাকে চায়ের দাওয়াত দিয়েছেন।

গেলাম বিকেলে। কাজী শাহেদ বললেন, দারুণ লেখা হয়েছে। এমন লেখাই তো চাই। তবে লেখার একটি শব্দ আমি যদি চেঞ্জ করি আপনি কি আপত্তি করবেন?

আমি জিজ্ঞেস করলাম : কোন্ শব্দ?

– আপনি লিখেছেন, জিয়াউর রহমানের গন্ধ। ওটাকে যদি আমি ঘ্রাণ করে দিই? কারণ আওয়ামী লীগাররা কত বড় শয়তান তা আমি জানি। ওরা এই গন্ধটাকেই দুর্গন্ধ বানিয়ে ফেলতে পারে।

– ঠিক আছে। করে দেন, অসুবিধা নেই।

এ সময়ে ঢুকলেন আওয়ামী লীগ নেতা সাকো খ্যাত আবুল হোসেন। তিনি সম্পাদকের কামরায় না ঢুকে বাইরে একটু দূরে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছিলেন। তাকে দেখেই কাজী সাহেবকে একটু বিব্রত মনে হলো। গলা নামিয়ে আমাকে বললেন, উনাকে একটু সময় দিই। বুঝেনই তো, ওরা লোক কেমন।

আমি হাত বাড়িয়ে হেসে বললাম, আমার তো আর কোনও কাজ নেই। আজ উঠি।

চলে এলাম। পরদিন আজকের কাগজে আমার লেখাটি পুরো ছাপা হয়। বিন্দু-বিসর্গও চেঞ্জ করা হয়নি, এমনকি গন্ধ শব্দটিও নয়।

মানুষ বড় বিচিত্র। সে এক দুর্জ্ঞেয় রহস্য। তার ভেতরে আলো থাকে, অন্ধকার থাকে এবং থাকে আলো-আঁধারির লুকোচুরি। সদ্য থেমে যাওয়া কাজী শাহেদের জীবনও তা’ থেকে আলাদা কিছু ছিল-না।

ছবি পরিচিতি : সে সময়ে কোনও একদিন আজকের কাগজ অফিস পরিদর্শনে গিয়েছিলেন তারেক রহমান। সঙ্গে ছিলাম আমি এবং প্রধানমন্ত্রীর সিনিয়র সহকারি প্রেসসচিব আশিক ইসলাম। দীর্ঘ কয়েক ঘন্টা ধরে আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন ইস্যুতে আলোচনা করেছিলেন কাজী শাহেদ আহমেদ। আমাদেরকে হরেক রকম উপাদেয় খাদ্যসম্ভারে মধ্যাহ্নভোজেও আপ্যায়িত করেছিলেন তিনি।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *