কামালপুর যুদ্ধের মহানায়ক ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ

কামালপুর যুদ্ধের মহানায়ক, মুক্তিযুদ্ধে যাকে ডাকা হতো “দ্য রিয়েল টাইগার” নামে। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ বীর উত্তম এর বীরত্বগাঁথা আজো পড়ানো হয় বিশ্বখ্যাত সামরিক কলেজসমূহে।

এক অবিস্মরণীয় দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ (বীর উত্তম)। যুদ্ধের ময়দানে তাঁকে সহযোদ্ধারা ডাকতো “রিয়েল টাইগার” নামে । বিখ্যাত কামালপুর যুদ্ধের মহানায়ক তিনি! যে কামালপুর যুদ্ধের রণকৌশল ও তাঁর বীরত্বগাঁথা আজো পাঠদান করা হয় বিশ্বখ্যাত সব সামরিক কলেজ সমূহে।

১৯৬৬ সালে ফ্লাইট ক্যাডেট হিসেব যোগদিয়েছিলেন তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে। বন্ধুদের আড্ডার প্রাণ সালাউদ্দিন। একজন যদি বলে চা চলবে, তাঁর প্রতিউত্তর কেন কফি খাওয়া নিষেধ। একবার বাড়ি এলে আর ফিরে যেতে মনে চায়না। যাওয়ার বেলায় মায়ের সেকি আকুতি। বাক্স পেটারা ভর্তি, চিঁড়ে আর মোয়া। ছেলে কবে ছুটি পায়। আর যেদিন ছুটিতে দেশে আসা হয় এক সপ্তাহ আগে থেকে মায়ের সেকি প্রস্তুতি। ছেলে আসবে, প্রাণের ছেলে প্রিয় ছেলে।

এভাবেই চলে এলো ১৯৭১। দিনের পর দিন অসহ্য লাগছে মাতৃভূমি ছেড়ে। গোটা দেশে তখন তুমুল যুদ্ধ। বাড়ি থেকে নেই কোন খবর। মা বাবা বেঁচে আছে না মরে গেছে কে জানে। রাত্রির ঘুম দুচোখের পাতায় একত্র হয়না। ঘুমের মাঝেই প্রলাপ বকে সালাউদ্দিন। মা ও মা। কতদিন তোমার কাছে ঘুমাই না। খানিক বাদে ঘুম ভাঙ্গে। সঙ্গীরা তখন অতল ঘুমে।

পহেলা জুলাই পাঁচ বাঙ্গালী অফিসার তথা ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ সহ জাহাঙ্গীর, মহিউদ্দিন,শাহরিয়ার আর আনাম সিদ্ধান্ত নেন পালানোর। কেউ যেন জানতে না পারে। ধরা পড়লেই সোজা ফায়ারিং স্কোয়াডে। একপাশে প্রিয় মাতৃভূমির প্রতি অবিনশ্বর টান আর অন্যদিকে প্রাণের মায়া। তাঁর দুদিন পরে ক্যান্টনমেন্টে উঁচু প্রাচীর ডিঙ্গিয়ে পালানেন পাঁচজন। ৩ জুলাই শিয়ালকোটের মারালা সীমান্তের খরোস্রোতা মুনাওয়ার তাবী নদী অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করলেন তাঁরা। তাঁদের এই আগমন ঝড় তুললো গণমাধ্যমে। শিরোনাম পাকিস্তানের দুর্ভেদ্য ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে পালিয়েছে পাঁচ বাঙ্গালী অফিসার।

ভারতের টাইমস অব ইন্ডিয়া ৪ই জুলাই প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছিলো, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালী পাঁচ অফিসার ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ, ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার রশিদ খান, ক্যাপ্টেন আবদুল আজিজ পাশা ও ক্যাপ্টেন আনাম পশ্চিম পাকিস্তানের শিয়ালকোটের কাছে মারালা সীমান্তের খরোস্রোতা মুনাওয়ার তাবী নদী অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করেন। তাঁরা পরবর্তীতে তাঁরা পাঁচজনই কলকাতায় গিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এর আনুগত্য স্বীকার করে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তাঁরা মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করার জন্য মুজিবনগরে যাবেন বলে জানিয়েছেন।’

ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজসহ পাঁচজনই প্রথমে কলকাতা গিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এর আনুগত্য স্বীকার করে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। সালাউদ্দিনকে পাঠানো হয় ১১ নং সেক্টরের প্রথম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তেলঢালা ক্যাম্পে এই রেজিমেন্টের অধীনে মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং চলছিল। এখানে পরে জেড ফোর্স গঠিত হলে তাঁকে এই ফোর্সে নিযুক্ত করা হয়..ট্রেনিং শেষ হলে জেড ফোর্সের কমান্ডার মেজর জিয়া প্রথম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মাধ্যমে কামালপুর বিওপি আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন। সালাহউদ্দিনকে “চার্লি” কোম্পানীর কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়।

ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ ও লেফটেন্যান্ট মান্নানকে কামালপুর পাকিস্তানি অবস্থান রেকি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন ও লেফটেন্যান্ট মান্নান রেকি করার সময় দুজন পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের সম্মুখে পড়েন। একজন পাকিস্তানি হানাদারদের সঙ্গে সালাহউদ্দিনের ধস্তাধস্তি শুরু হয়। লেফটেন্যান্ট মান্নান একটি গাছের নিচে অবস্থান নিলেন। সুবেদার হাই রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করে পাকিস্তানি সেনার রাইফেল কেড়ে নিলেন।নায়েক শফি পলায়নপর পাকিস্তানি সেনাকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করল। পাকিস্তানি সেনার বাংকার থেকেও গুলি বর্ষিত হলো।

সুবেদার হাই শত্রুর অবস্থান লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করতে করতে ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিনের দিকে অগ্রসর হলো। হাই সালাহউদ্দিনের বুকের ওপরে চড়ে থাকা পাকিস্তানি সেনাকে স্টেনগান দিয়ে আঘাত করলে পাকিস্তানি সেনা তার রাইফেল ফেলেই পালিয়ে যায়। সালাহউদ্দিন ও মান্নান শত্রুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া রাইফেল দুটিসহ অন্যদের নিয়ে নিজ অবস্থানে ফিরে আসেন। সেদিন অল্পের জন্য এভাবেই প্রাণে বেঁচে গেল।”

৩১শে জুলাই দিবাগত রাতে (১লা অগাস্ট রাত) জেড ফোর্সের কমান্ডার জিয়াউর রহমান এর নির্দেশে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিও (কমান্ডিং অফিসার) মেজর মইনুল হোসেন এর নেতৃত্বে উত্তর ও পূর্ব দিক থেকে ডেল্টা এবং ব্রাভো কোম্পানি শত্রুপক্ষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মেজর মইন এতো দ্রুত এমন মিশনে রাজি ছিলেন না। মেজর মঈনের মত ছিলো কামালপুরের মত শক্তিশালী পাকিস্তানি ঘাঁটিতে সেটপিস যুদ্ধের মাধ্যমে আক্রমণ করার সক্ষমতা জেড ফোর্সের বা তাঁর ব্যাটালিয়নের তখনো অবধি হয়নি। মেজর মইনের প্ল্যান ছিলো হিট অ্যান্ড রান তথা গেরিলা পদ্ধতিতে পাকিস্তান ফোর্সকে দুর্বল এবং নাজেহাল করা। কিন্তু জিয়া সিদ্ধান্ত পাল্টালেন না। এর মূল কারণ ছিল হাইকমান্ডের নির্দেশ এবং ঘাঁটিটির স্ট্র্যাটেজিক গুরুত্ব। মেজর মইনের ১ম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নে সৈন্য ছিলো সর্বসাকুল্যে ৮৫০ জন। জেড ফোর্সের ১ম সম্মুখ সমর কামালপুর অপারেশনে ব্রিগেড কমান্ডার জিয়াউর রহমান নিজে উপস্থিত ছিলেন যুদ্ধ সমন্বয় করার জন্য।

৩১ জুলাই রাত ৩টার দিকে লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিয়া এবং মেজর মইন ১ম বেঙ্গল ব্যাটালিয়ন নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটি থেকে প্রায় ১১-১২শ’ গজ দূরে অবস্থান নেন। তখন মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিলো। তখন মুক্তিযোদ্ধাদের পজিশন ছিলো এমন ক্যাপ্টেন মাহবুব শত্রু ঘাঁটির পেছনে তাঁর কোম্পানিসহ অবস্থান নিয়েছেন। ক্যাপ্টেন হাফিজ ও ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন ৬০০ গজ ইনসাইড এনিমি লাইন অগ্রসর হয়ে পাটক্ষেতে অবস্থান নিয়েহচিলেন। মেজর মইন তাঁর ওয়ারলেস অপারেটর এবং ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট লিয়াকত সহ পাটক্ষেতে অবস্থান নিলেন। একদিকে টিলায় মেজর জিয়া হালকা কামান ও হেভি মেশিনগান সহ অবস্থান নিলেন। অন্যদিকে কাট অফ পার্টি হিসেবে একটি বাহিনী কামালপুর-বকশীগঞ্জ সড়কে মাইন পুঁতে রেখে কামালপুর-শ্রীবর্দি জংশন এবং উঠানীপাড়ায় অবস্থান নেয় যাতে যুদ্ধ শুরু হলে বকশীগঞ্জ থেকে কোন পাকিস্তানি রিইনফোর্সমেন্ট কামালপুরে আসতে না পারে।

জিয়ার অবস্থান থেকে কামানের গোলা বর্ষনের মাধ্যমেই যুদ্ধ শুরু হয়। রাত সাড়ে ৩ টায় ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন মমতাজ তাঁর ২ প্লাটুন সৈন্য নিয়ে শত্রুঘাঁটিতে ঢুকে পড়েন। এটি ছিল জেড ফোর্সের ১ম অপারেশন। আর যোদ্ধাদের বড় অংশই ছিল স্বল্প প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। ফলে তারা শুরুর দিকে ময়দানে যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারছিল না। তাদের গতি অপেক্ষাকৃত ধীর হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি বিবেচনায় ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ অসামান্য নেতৃত্বের পরিচয় দেন। তিনি সামনে থেকে দলকে এগিয়ে নিয়ে যান, তার উচ্চ এবং উদ্দামী কন্ঠ জোয়ানদের মাঝে নিয়ে আসে গতি।

উচ্চকন্ঠে বলতে থাকেন, ‘ইয়াহিয়া খান এখনও এমন বুলেট তৈরি করতে পারেনাই, যা মমতাজকে ভেদ করবে যদি মরতেই হয়, এক পাকসেনাকে সাথে নিয়ে মরো। বাংলার মাটিতে শহিদ হও!’

ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজের অসীম সাহসে আর তাঁর কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমণে পাকিস্তানিদের ১ম ডিফেন্স কর্ডন শেল প্রুফ বাংকারে ঢুকে পড়ে। এ সময় সালাউদ্দিন মমতাজ আরও সাহসী হয়ে উঠে ২০-২৫ জনকে নিয়ে বিওপির কমিউনিটি সেন্টারে ঢুকে পড়েন। তিনি একসময় বুঝতে পারেন যে পাকিস্তানিরা সামনের সারির বাংকার পজিশনগুলো ক্লিয়ার করে পিছিয়ে গিয়ে পুনরায় সেকেন্ড লাইনে কাউন্টার অ্যাটাকের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাই তিনি ওয়্যারলেসে সুবেদার হাই এর প্লাটুনকে ডান দিকে যাওয়ার জন্য আদেশ দিলেন। প্রথমবারে সম্ভবত হাই তাঁর নির্দেশ শুনতে পান নি, তাই সালাউদ্দিন পুনরায় ওয়্যারলেসে “হাই” বলেন।

সাথে সাথেই তাঁর সামনে একটি গোলা বিস্ফোরিত হয়। লুটিয়ে পড়লেন ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ বীর উত্তম। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ বারবার এক স্বপ্নের কথাই বলতেন সহচর মুক্তিযোদ্ধাদের, ‘দেখবে আমরা বিজয়ী হবোই। একদিন না একদিন আমাদের বিজয় আসবেই।’

দুর্ভাগ্য তাঁর, স্বাধীন বাংলার সূর্য তিনি দেখে যেতে পারলেন না। তীব্র যুদ্ধের কারণে শহীদ ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজের দেহ উদ্ধার করা যায় নি। বরং তাঁর লাশ উদ্ধার করতে গিয়ে আরো তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছিলেন। অবশ্য তাঁর ঘড়ি, স্টেনগান ও কিছু কাগজপত্র উদ্ধার করতে পেরেছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা।

কামালপুর বিওপির তখন সিও ছিলো ক্যাপ্টেন আহসান মালিক। ৩১ বেলুচ রেজিমেন্টের কমান্ডার আহসান মালিক ছিলেন ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজের পাকিস্তানে সেনাবাহিনীতে থাকাকালীন সময়ের সহকর্মী ও সহপাঠী। সালাউদ্দিন মমতাজের সহমুক্তিযোদ্ধারা ধারনা করেন হয়তো ক্যাপ্টেন আহসান মালিকের নির্দেশেই সালাউদ্দিন মমতাজের লাশ সরিয়ে নিয়ে কোন এক অজানা স্থানে তাঁকে দাফন করা হয়েছিলো।

তথ্যসূত্র

কামালপুর ১৯৭১- সম্পাদক- মুহাম্মদ লুৎফুল হক একাত্তরের বীরযোদ্ধা,

খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা (প্রথম খন্ড)
রক্তেভেজা একাত্তর -মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *