অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন ক্লডিয়া গোলডিন

:: নাগরিক নিউজ ডেস্ক ::

বিশ্বের তৃতীয় নারী হিসেবে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ক্লডিয়া গোলডিন (Claudia Goldin)। শ্রমবাজারে নারীর অবদান ও লিঙ্গবৈষম্য নিয়ে গবেষণার জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

সোমবার (৯ অক্টোবর) বাংলাদেশ সময় বিকেল পৌনে ৪টায় সুইডেনের স্টকহোমে রয়্যাল সুইডিস একাডেমি তার নাম ঘোষণা করে।

এক বিবৃতিতে একাডেমি বলেছে, ‘কয়েক শতক ধরে নারীদের উপার্জন ও শ্রমবাজারে তাঁদের অংশগ্রহণের বিষয়ে প্রথম সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরেছেন অর্থনীতি বিদ্যায় এবারের নোবেলজয়ী ক্লডিয়া গোলডিন। তাঁর গবেষণায় পরিবর্তনের কারণের সঙ্গে বিদ্যমান লিঙ্গবৈষম্যের প্রধান উৎসগুলো বের হয়ে এসেছে।’ 

তাঁর আগে দুই নারী অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন, তাঁরা হলেন এলিনর অস্ট্রম ও এস্থার দুফলো।

১৯৯০ সালে প্রথম নারী হিসেবে হার্ভার্ডের অর্থনীতি বিভাগে যোগ দেন গোলডিন। অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী তৃতীয় নারী তিনি।

ক্লডিয়া গোল্ডিন ১৯৪৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭২ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন।

রয়্যাল সুইডিশ একাডেমি অব সায়েন্সেসের সেক্রেটারি জেনারেল হ্যান্স এলেগ্রেন বলেন, ‘তিনি একাধারে বিস্মিত ও খুশি।’

‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং দ্য জেন্ডার গ্যাপ: অ্যান ইকোনমিক হিস্ট্রি অব আমেরিকান উইমেন’ নামে ১৯৯০ সালে প্রকাশিত বইতে মজুরি বৈষম্যের শিকড় কতটা গভীরে তা তুলে ধরেন। এই ক্ষেত্রে তার গবেষণা দিক উন্মোচন করেছে।

পরবর্তীতে তিনি নারীদের কর্মজীবন ও বিয়ের সিদ্ধান্তের ওপর গর্ভনিরোধক বড়ির প্রভাব, বিয়ের পরে সামাজিক সূচক হিসেবে স্বামীর নাম ব্যবহার এবং বেশিরভাগ নারীদের স্নাতকোত্তর না পেরোনোর কারণ নিয়ে গবেষণা করেন।

পুরস্কার কমিটির সদস্য রান্ডি হালমারসন বলেন, ক্লাউডিয়া গোলডিনের গবেষণার ব্যাপক সামাজিক প্রভাব আছে। সমস্যা গভীরভাবে বুঝে সঠিক নামে চিনলে সামনে ভাল উপায় বের করা সম্ভব হবে।

পুরস্কারের অর্থমূল্য হিসেবে ১ কোটি ১০ লাখ সুইডিশ ক্রোনার পাবেন গোলডিন। অর্থনীতিতে ব্যাংকের ভূমিকা ও অর্থনৈতিক সঙ্কট এড়াতে ব্যাংকের সুরক্ষার মধ্যে আন্তঃসম্পর্কের উন্মোচন করে যুক্তরাষ্ট্রের তিন অর্থনীতিবিদ বেন এস বেরনান, ডগলাস ডব্লিউ ডায়মন্ড ও ফিলিপ এইচ ডিবভিগ নোবেল পুরস্কার পান।  

নোবেল প্রাইজ ডট অর্গে বলা হয়েছে, অনেক উচ্চ আয়ের দেশে গত এক শতকে বেতন-মজুরিভিত্তিক কাজে নারীর অংশগ্রহণ তিন গুণ হয়েছে। আধুনিক সময়ের ইতিহাসে এটি অন্যতম বৃহৎ সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন, কিন্তু তা সত্ত্বেও নারী-পুরুষের মধ্যে বড় ধরনের ব্যবধান রয়ে গেছে। গত শতকের আশির দশকে ক্লডিয়া গোলডিন এ বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ গবেষণা শুরু করেন।

ক্লডিয়া গোলডিনের বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যার মূল বিষয় হচ্ছে, আগে এবং এখনো নারীর সিদ্ধান্ত মূলত তাঁর বিয়ে ও পরিবারের প্রতি দায়িত্ব-কর্তব্য পালনের নিরিখে নির্ধারিত হয়েছে এবং হচ্ছে। মূলত, যুক্তরাষ্ট্রের পরিপ্রেক্ষিতে কাজ করলেও তাঁর অন্তর্দৃষ্টি কাল-সীমানার গণ্ডি পেরিয়ে যায়।

সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, সমাজের সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ক্লডিয়া গোলডিন ২০০ বছরের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে গবেষণায় দেখেছেন, এই সময়ে শ্রমশক্তিতে নারী অংশগ্রহণ শুধু বেড়েছে—বিষয়টি মোটেও তেমন নয়, বরং এ-বিষয়ক রেখাচিত্র ইংরেজি ইউ আকৃতির। অর্থাৎ এই ইতিহাস সরলরৈখিক নয়। দেখা গেছে, কৃষিসমাজ থেকে শিল্পসমাজে উত্তরণের সময় উনিশ শতকে বিবাহিত নারীদের শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ কমেছে। এরপর বিশ শতকের শুরু থেকে সেবা খাতের বাড়বাড়ন্ত হতে শুরু করলে শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে।

ক্লডিয়া গোলডিনের ব্যাখ্যা হলো, মূলত কাঠামোগত পরিবর্তন এবং পরিবার ও সমাজে নারীর দায়িত্ব-কর্তব্যবিষয়ক সামাজিক রীতিনীতির পরিবর্তনের কারণে এমনটা হয়েছে। বিশ শতকে নারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে। অধিকাংশ উচ্চ আয়ের দেশে নারীর শিক্ষার মান পুরুষের চেয়ে বেশি।

আরেকটি কারণে নারীর শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন এসেছে। সেটা হলো, জন্মবিরতিকরণ সামগ্রী। এটা নারীকে ক্যারিয়ার নিয়ে পরিকল্পনা করার সুযোগ দিয়েছে, অর্থাৎ স্বাধীনতা দিয়েছে।

তবে এত পরিবর্তন সত্ত্বেও কিছু পুরোনো বিষয় এখনো রয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন ক্লডিয়া গোলডিন। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরে নারী-পুরুষের আয়ের ব্যবধান তেমন একটা কমছে না। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এই অধ্যাপক মনে করেন, এর আংশিক কারণ হচ্ছে শিক্ষাবিষয়ক সিদ্ধান্ত সাধারণত কম বয়সে নেওয়া হয়। তরুণীদের আকাঙ্ক্ষা যদি আগের প্রজন্মের নারীদের অভিজ্ঞতার আলোকে নেওয়া হয়, অর্থাৎ মেয়েরা যদি মাকে দেখে সিদ্ধান্ত নেয়—যে মা হয়তো সন্তান বড় হওয়ার আগে কাজে ফেরত যাননি—তাহলে উন্নয়নের গতি কমে যায়।

উল্লেখ্য, অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া শুরু হয় ১৯৬৯ সাল থেকে। সেই বছর থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৫৫ বার এই পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।

এর আগে গত ৬ অক্টোবর শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন ইরানের নার্গিস মোহাম্মদি। সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন নরওয়ের লেখক ও নাট্যকার ইয়োন ফসে।

এর আগে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। এবার নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ক্যাটালিন ক্যারিকো (Katalin Karikó) ও ড্রু ওয়েইসম্যান (Drew Weissman)।  করোনার টিকা তৈরিতে অবদানের জন্য হাঙ্গেরি ও যুক্তরাষ্ট্রের দুই বিজ্ঞানী যৌথভাবে এবারের চিকিৎসাবিজ্ঞানের নোবেল জিতে নিয়েছেন। করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তাঁরা। 

প্রতি বছর শান্তি, সাহিত্য, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসা ও অর্থনীতি- এই ছয় বিষয়ে যারা বিশেষ অবদান রেখেছেন; তাদের পুরস্কার প্রদান করে সুইডেনভিত্তিক নোবেল ফাউন্ডেশন। পুরস্কার প্রদানের পর তা উদযাপনে উৎসবের আয়োজন করে নোবেল কমিটি। নোবেল কমিটির সদর দফতর নরওয়েতে।

উনবিংশ শতাব্দিতে সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল আবিষ্কার করেছিলেন ডিনামাইট নামের ব্যাপক বিধ্বংসী বিস্ফোরক; যা তাকে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পত্তির মালিক করে তোলে। মৃত্যুর আগে তিনি ৩ কোটি ১০ লাখ ক্রোনার রেখে গিয়েছিলেন, আজকের বাজারে যা প্রায় ১৮০ কোটি ক্রোনের সমান। আলফ্রেড নোবেলের উপার্জিত অর্থ দিয়ে ১৯০১ সালে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, সাহিত্য ও শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের গোড়াপত্তন ঘটে। ১৯৬৮ সালে এই তালিকায় যুক্ত হয় অর্থনীতি।

মঙ্গলবার পদার্থে আর বুধবার রসায়নে নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। এরপর ৫ অক্টোবর সাহিত্যে আর ৬ অক্টোবর শান্তিতে নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। দুই দিন বিরতি দিয়ে ৯ অক্টোবর ঘোষণা করা হল অর্থনীতির নোবেল।

১৯৬৮ সাল থেকে সুইডেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক নোবেলের অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে অবদানের কথা স্মরণ করে এই পুরস্কার দেওয়া শুরু করে।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *