গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য জাতিসংঘে প্রস্তাব পাস

:: নাগরিক নিউজ ডেস্ক ::

‘জরুরি ও বর্ধিত মানবিক বিরতির’ আহ্বান জানিয়ে মাল্টার করা প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে অবশেষে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে। প্রস্তাবে অবিলম্বে জিম্মিদের নিঃশর্ত মুক্তিরও আহ্বান জানানো হয়েছে।

প্রস্তাবের পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্যের মধ্যে ১২ সদস্য ভোট দিয়েছেন। ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিল তিন সদস্য যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়া।

ইসরাইলি বাহিনী ও সশস্ত্র হামাসের যুদ্ধের প্রায় দেড় মাসের মাথায় এই প্রস্তাব পাশ হয়। তবে এর বিরোধিতা করেছে ইসরায়েল।

স্থানীয় সময় বুধবার গাজায় মানবিক দিক বিবেচনায় সাময়িক যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে মাল্টা।  

উত্থাপিত প্রস্তাবে, বেশ কয়েক দিনের জন্য গাজা উপত্যকায় সংঘাত বন্ধ ও করিডর খোলার আহ্বান জানানো হয়েছে। সেই সঙ্গে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা ও তাদের সহযোগীদের পূর্ণাঙ্গ, নিরাপদ ও বাধাবিহীন চলাচলের নিশ্চয়তা দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া গাজায় হামাসের হাতে জিম্মি সব ইসরায়েলি ও বিদেশি নাগরিককে মুক্তি দেওয়ার দাবি জানানো হয়।

এর আগেও গাজা যুদ্ধের ইস্যুতে চারবার বৈঠকে বসেছে নিরাপত্তা পরিষদ। তবে এতদিন ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের বাধায় কোনো প্রস্তাব পাশ হয়নি।

মাল্টার জাতিসংঘের রাষ্ট্রদূত ভেনেসা ফ্রেজিয়ার বলেছেন, আজ আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের প্রথম ধাপ অর্জন করেছি। অপরিণামদর্শী সশস্ত্র এ সংঘাতে বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষা এবং শিশুদের দুর্দশা প্রতিরোধে আমরা আমাদের প্রতিশ্রুতিতে অটল থাকবে।

গত ৭ অক্টোবর এ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এ সংকট নিয়ে পঞ্চমবারের মতো বসল নিরাপত্তা পরিষদ। আগের বৈঠকে উত্থাপিত প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেওয়ায় পাস হয়নি।

ফিলিস্তিনের প্রতিরোধ সংগঠন হামাস গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে আকস্মিক হামলা চালায়। এতে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন বলে জানিয়েছে ইসরায়েল। যদিও শুরুতে এ সংখ্যা ১ হাজার ৪০০ দাবি করেছিল দেশটি। এ ছাড়া ফিলিস্তিনি যোদ্ধারা প্রায় ২৪০ জনকে জিম্মি করে রেখেছে বলে ইসরায়েল দাবি করে আসছে।

হামাসের হামলার জবাবে ওই দিনই গাজায় ব্যাপক হামলা শুরু করে ইসরায়েল। নির্বিচার ও বিরামহীন হামলায় গাজায় প্রায় সাড়ে ১১ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন।তাঁদের মধ্যে আট হাজারের বেশি নারী ও শিশু। এ ছাড়া সর্বাত্মক অবরোধের কারণে গাজায় খাবার, পানি ও ওষুধের অভাবে মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে।

ইসরায়েলি সেনাদের মুখোমুখি হয়ে যা বললেন আল-শিফা হাসপাতালের চিকিৎসক

গাজার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল আল-শিফায় চলছে ইসরায়েলি বাহিনীর (আইডিএফ) অভিযান। হাসপাতালের ভেতরের পরিবেশকে প্রচণ্ড ভয়ংকর বলে অভিহিত করেছেন সেখানকার একজন চিকিৎসক। পাশাপাশি হাসপাতালের ভেতরে ইসরায়েলি সেনাদের অভিযান চালাতে না দিতে রুখে দাঁড়ান এক চিকিৎসক।

কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনীর মুখোমুখি দাঁড়ানো ওই চিকিৎসকের নাম মুনির আল-বারশ। তিনি বলেছেন, ইসরায়েলি সেনারা হাসপাতালে অভিযান চালাচ্ছে মূলত সেখানে থাকা ফিলিস্তিনিদের মনে ভয় ও আতঙ্কের সৃষ্টি করতে।

মুনির আল-বারশ ইসরায়েলি সেনাদের উদ্দেশে বলেন, ‘এখানে থাকা ফিলিস্তিনিদের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি করার জন্যই তোমরা এই হাসপাতালে প্রবেশ করেছ। হাসপাতালের প্রতিটি করিডর, প্রতিটি তলা মানুষে পরিপূর্ণ।’ তিনি আরও বলেন, ‘তাই তোমরা কেন অভিযান চালাচ্ছ, সেটার কারণ আমি শুনতে চাই না।’

আল-শিফা হাসপাতালের এই চিকিৎসক আরও বলেন, ‘হাসপাতালের প্রতিটি তলা—প্রথম থেকে শুরু করে ষষ্ঠ তলা পর্যন্ত মানুষে পরিপূর্ণ। তার পরও তোমরা অভিযান চালানোর ব্যাপারে বলতেই থাকবে?’ তিনি আরও বলেন, তার পরও কী এটি তোমাদের জন্য সমস্যার কারণ? তার পরও তোমাদের হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে দেখতে হবে?’ 

এ সময় মুনির আল-বারশ বলেন, ‘হাসপাতালের রিসেপশন, সার্জারি বিভাগ বাস্তুচ্যুত মানুষে ভর্তি। ডায়ালাইসিস, ডেলিভারি ও প্রশাসনিক বিভাগ কিছুটা খালি রয়েছে। হাসপাতালের ডান দিকে থাকা বার্ন ইউনিটও রোগী আর বাস্তুচ্যুত মানুষ দিয়ে ভর্তি।’

এদিকে আল-জাজিরার পৃথক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরায়েলি বাহিনী প্রায় ৩০ জনকে চোখ বেঁধে আল-শিফা হাসপাতালের বাইরে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কিন্তু হামাসের উপস্থিতির কোনো প্রমাণ এখনো সেখানে পাওয়া যায়নি। ওই ৩০ জন ফিলিস্তিনিকে চোখ বেঁধে বিবস্ত্র করে বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালের আঙিনায় তিনটি ট্যাংক দিয়ে ঘেরা জায়গায় তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

সার্জারি ভবনের ভেতরে ইসরায়েলি সেনারা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। সব পার্টিশন ছিঁড়ে ফেলা হয়েছে, ভেঙে দেওয়া হয়েছে সব দেয়াল। বেসমেন্টে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ফিলিস্তিনিদের। সেখানে একেকজন করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

আল-শিফা হাসপাতালের নিচে অবস্থিত একটি সুড়ঙ্গে হামাস তাদের অভিযানের নিয়ন্ত্রণকক্ষ স্থাপন করেছে—এমন দাবি করে সেখানে অভিযান পরিচালনা করার কথা বলেছিল আইডিএফ। তবে ইসরায়েলের একটি রেডিওতে বলা হয়েছে, হাসপাতালটিতে হামাসের উপস্থিতির কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

হাসপাতালটির ভেতরে থাকা চিকিৎসক আহমেদ আল মোখাল্লালাতি জানিয়েছেন, ইসরায়েলি বাহিনীর ক্রমাগত গুলিবর্ষণে জানালার কাছ থেকে দূরে সরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে রোগী, চিকিৎসক, আশ্রয়প্রার্থী সবাই। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের ভেতরে ও আশপাশে গুলি করা হচ্ছে। এটা সত্যিই প্রচণ্ড ভয়ংকর যে এতগুলো নিরীহ মানুষের মধ্যে গুলি করা হচ্ছে। হাসপাতালের আশপাশে ঘুরছে ট্যাংক। জরুরি বিভাগের সামনেই একটি ট্যাংক মোতায়েন রাখা আছে। হাসপাতালের চারপাশে সব ধরনের আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। সরাসরি হাসপাতালকেই লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে তারা। আমরা জানালা থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করছি।’

আল-শিফাসহ গাজার হাসপাতালগুলোকে হামাস ব্যবহার করছে—এমন দাবি করার কয়েক ঘণ্টা পরই স্থানীয় সময় আজ বুধবার রাত ১টায় ইসরায়েলি বাহিনী আল-শিফা হাসপাতালে প্রবেশ করেছে। সামাজিক প্ল্যাটফর্ম এক্সে দেওয়া এক বিবৃতিতে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) বলেছে, চিকিৎসক দল ও আরবি ভাষাভাষীদের অন্তর্ভুক্ত করে গঠিত তাদের বাহিনী এই অভিযান চালাচ্ছে।

তবে হামাস তার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য হাসপাতাল ব্যবহার করার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। এ বিষয়ে কোনো আন্তর্জাতিক কমিটিকে এসে পরিদর্শনের আহ্বানও জানানো হয়েছে।

আল-শিফায় ফিলিস্তিনিদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে মানসিক নির্যাতন

কয়েক দিন ধরে ইসরায়েলি ট্যাংক অবস্থান করছিল ফিলিস্তিনের গাজার সবচেয়ে বড় হাসপাতাল আল-শিফার বাইরে। ট্যাংক থেকে হামলার কারণে হাসপাতালটির এক ভবন থেকে আরেক ভবনে পর্যন্ত যেতে পারছিলেন না রোগী, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীসহ আশ্রয়গ্রহণকারীরা। এরপর গতকাল বুধবার হাসপাতালটিতে প্রবেশ করে অভিযান শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী।

এই অভিযানের সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক জিহাদ আবু শানাব। তিনি আল জাজিরাকে বলেন, হাসপাতাল চত্বরে যাঁরা ছিলেন তাঁদের নিষ্ঠুরভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন ইসরায়েলি সেনারা। তাঁদের মানসিকভাবে নির্যাতন করা হচ্ছিল। এই ফিলিস্তিনিরা ভীত, সন্ত্রস্ত ছিলেন।

ফোনকলে এই সাংবাদিক আরও বলেন, গত মঙ্গলবার রাত থেকে দুঃস্বপ্নের মতো সবকিছু হচ্ছে। হাসপাতাল চত্বর তছনছ করার আগে ইসরায়েলি বাহিনী জেনারেটর, যোগাযোগ স্থাপনের সবকিছু নষ্ট করেছে। এই হাসপাতাল থেকে এখন বাইরের বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ করার উপায় নেই।

সাংবাদিক জিহাদ আবু শানাব বলেন, মঙ্গলবার পুরো রাতই বিশৃঙ্খলা চলে এই হাসপাতালে। সকাল না হওয়া পর্যন্ত ইসরায়েলি গুলিবর্ষণও চলে। যাঁরা হাসপাতালে ছিলেন, তাঁরা দেখেছেন ইসরায়েলি বাহিনী কীভাবে হাসপাতালটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনীর নিষ্ঠুর জিজ্ঞাসাবাদের ধরন প্রসঙ্গে এই সাংবাদিক বলেন, ইসরায়েলি বাহিনী সবাইকে একটি তলায় জড়ো হতে বলেন। এরপর ইসরায়েলি সেনারা নিচের তলায় অনুসন্ধান চালান এবং জিজ্ঞাসাবাদের নামে হেয়প্রতিপন্ন করা হয় ফিলিস্তিনিদের।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে এই সাংবাদিক আরও বলেন, আল-শিফা হাসপাতাল ইসরায়েলি সেনারা যখন অভিযান চালান, তখন কোনো ধরনের প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হয়নি তাঁদের। হাসপাতালটিতে কেবল রোগী, চিকিৎসক ও আশ্রয়গ্রহণকারীরাই রয়েছেন।

এদিকে, গাজার খান ইউনিস থেকে আল জাজিরার সাংবাদিক হানি মাহমুদ বলেন, গুলিবর্ষণ ও কামানের ভারী গোলাবর্ষণের পাশাপাশি আল-শিফা হাসপাতালের মূল ভবনে অভিযান চালান ইসরায়েলি সেনারা। এ সময় জরুরি বিভাগ, বিশেষায়িত সার্জারি বিভাগ, এমনকি প্রসূতি ওয়ার্ডেও অভিযান চালানো হয়। এক কক্ষের পর আরেক কক্ষ—করিডরের পর করিডর ধরে অভিযান চালান তাঁরা। চিকিৎসক এবং চিকিৎসাসংশ্লিষ্ট প্রত্যেককে আলাদাভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

হামাসের নেতা কিংবা সদস্যরা তাঁদের অভিযান চালাতে আল-শিফা হাসপাতাল ব্যবহার করেন—এই অভিযোগ তুলে ইসরায়েলি বাহিনী সেটি অবরুদ্ধ এবং এরপর অভিযানে যায়। কিন্তু এই অভিযানের পক্ষে কোনো জোরালো প্রমাণ হাজির করতে পারেনি তারা।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী হাসপাতালটির মূল ভবনের একাধিক দরজায় বৈদ্যুতিক তল্লাশিচৌকি বসিয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ইসরায়েলি সেনারা যখন একে একে চিকিৎসক, রোগী, আহত ব্যক্তি, আশ্রিতদের ডাকছিলেন, তাঁদের প্রত্যেককে এই তল্লাশিচৌকি পেরিয়েই যেতে হয়েছে।

ধারণা করা হয়, অভিযান চলাকালে হাসপাতালটিতে প্রায় তিন হাজার লোক ছিলেন। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, অভিযানের সময় সেখানে প্রায় আড়াই হাজার লোক ছিলেন। এর মধ্যে নবজাতক ৩৬টি এবং আহত ব্যক্তি প্রায় ৬০০ জন।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *