গাজীপুরের নতুন মেয়র জায়েদা খাতুন

:: গাজীপুর প্রতিনিধি ::

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী জায়েদা খাতুন। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত দেড়টার দিকে ৪৮০টি কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষিত হয়েছে। তিনি ১৬ হাজার ১৯৭ ভোটের ব্যবধানে হারিয়েছেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লা খানকে। তিনি গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রথম নারী মেয়র।

৪৮০ ভোটকেন্দ্রে টেবিল ঘড়ি প্রতীকে জায়েদা খাতুন ২ লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট পেয়েছেন। নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা পেয়েছেন ২ লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট। জায়েদা খাতুন ১৬ হাজার ১৯৭ ভোট বেশি পেয়েছেন। ইসলামী আন্দোলনের গাজী আতাউর রহমান ৪৫ হাজার ৩৫৩ ভোট পেয়ে তৃতীয় হয়েছেন। মোট ভোটার ১১ লাখ ৭৯ হাজার ৪৬৩ জন। প্রদত্ত ভোট ৫ লাখ ৭৫ হাজার ৫০, যা মোট ভোটের ৪৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

বৃহস্পতিবার (২৫ মে) রাত দেড়টার দিকে গাজীপুরের বঙ্গতাজ অডিটোরিয়াম থেকে ভোটের ফল ঘোষণা করেন ঢাকার আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মো. ফরিদুল ইসলাম।

এর আগে বৃহস্পতিবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত চলে ভোটগ্রহণ। সকাল ৮টায় ভোট শুরুর কথা থাকলেও সকাল ৬টার আগে থেকেই লাইনে দাঁড়ান ভোটাররা। দিনভর বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। অধিকাংশ কেন্দ্রেই মানুষের লম্বা লাইন দেখা গেছে।

নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মোট ৩৩১ জন প্রার্থী। এর মধ্যে মেয়র পদে ৮ জন, সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৭৮ জন এবং সাধারণ কাউন্সিলর পদে ২৪৫ জন প্রার্থী।

প্রথমবার ২০১৩ সালের নির্বাচনেও বিএনপির প্রার্থী এম এ মান্নানের কাছে হেরেছিলেন আজমত।

জায়েদা খাতুন সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা। ফল ঘোষণার সময় মিলনায়তনে উপস্থিত ছিলেন জায়েদা খাতুনের নির্বাচনী কার্যক্রমের প্রধান সমন্বয়কারী জাহাঙ্গীর আলম। মায়ের বিজয়ের পর জাহাঙ্গীর আলম তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এই বিজয় কেবল তার নয়, নগরবাসীর।

নতুন মেয়র হিসেবে জায়েদা খাতুনে নাম ঘোষণা হওয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তার মা বলেছে, সবাইকে নিয়ে সিটি কর্পোরেশনের উন্নয়নে কাজ করবেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করবেন। প্রধানমন্ত্রী আমাদের গার্ডিয়ান। দেশের উন্নয়নে তাকে সহযোগিতা করতে চাই।

তিনি বলেন, আমি জন্মের পর থেকেই আওয়ামী লীগ করি। আমি এখানকার আওয়ামী লীগের পরীক্ষিত ব্যক্তি। মানুষ আমার মায়ের পাশে দাঁড়িয়েছে। আমি ও আমার মা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে যাব। আমরা সবার সহযোগিতা নিয়ে একটা সুন্দর শহর গড়ে তুলব।’

তিনি আরও বলেন, আমি মায়ের কর্মী হিসেবে তার কাজে সহযোগিতা করব। আমি আমার মেয়র থাকাকালীন অভিজ্ঞতা দিয়ে গাজীপুরের জন্য কাজ করব। মায়ের সঙ্গে থেকে গাজীপুরকে পরিকল্পিত নগরী করে দেব। কোনো সন্ত্রাসীর কাছে মাথা নত করব না।

সাংবাদিক ও গাজীপুরবাসীর প্রতি অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেন, আল্লাহ্‌র ওয়াস্তে আমাকে আর আমার পরিবারকে নিয়ে কেউ আর মিথ্যা কথা লিখবেন না, মিথ্যা ছড়াবেন না।

এ সময় আওয়ামী লীগের মনোনীত মেয়র প্রার্থী আজমত উল্লাহ খানকে উদ্দেশ্য করে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমার বড়ভাই আজমত উল্লা খানসহ অনেকেই এখানে নির্বাচন করেছেন। আমাদের ব্যক্তিগতভাবে কারও প্রতি রাগ, ক্ষোভ নাই। আমরা সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে কাজটি করতে চাই।

বঙ্গবন্ধুকে কটূক্তি করে ২০২১ সালে মেয়র পদ থেকে বরখাস্ত হন জাহাঙ্গীর। আওয়ামী লীগ থেকেও বহিষ্কার হন। চলতি বছরেই সাধারণ ক্ষমায় দলে ফেরেন। কিন্তু মেয়র পদে নৌকার মনোনয়ন  না পেয়ে বিদ্রোহী প্রার্থী হলে আবার আজীবনের জন্য বহিষ্কার হন আওয়ামী লীগ থেকে। কিন্তু ঋণখেলাপির কারণে তাঁর প্রার্থিতা বাতিল হয়। ভোট করতে পারবেন না আশঙ্কায় মা জায়েদা খাতুনকেও প্রার্থী করেন গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর।

পুরো নির্বাচনী প্রচারে ছেলের ছায়া হয়েছিলেন জায়েদা। মা কাগজকলমে প্রার্থী হলেও বাস্তবে ভোটে লড়েছেন ছেলে। ফলে তাঁর জয় আদতে জাহাঙ্গীরের বিজয়। ক্ষমতাসীন দলের সর্বাত্মক সমর্থন পেয়েও আজমত উল্লার মতো শক্তিশালী প্রার্থী গৃহিণী জায়েদার বিরুদ্ধে হেরে যাবেন, তা কেউ ধারণাই করতে পারেননি। কিন্তু সুষ্ঠু ভোটে সব হিসাব পাল্টে গেছে।

গতকাল ভোট চলাকালে দিনভর অধিকাংশ কেন্দ্রে জায়েদা খাতুনের এজেন্টদের ছিল না। কিন্তু নির্লিপ্ত ছিলেন জাহাঙ্গীর। সন্ধ্যার পর নগরের বঙ্গতাজ মিলনায়তনে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে যখন বিভিন্ন কেন্দ্র থেকে ভোটের ফল আসতে শুরু করে তখন ছিলেন শান্ত। সবাইকে চমকে দিয়ে শুরু হয় টেবিল ঘড়ির জয়ধ্বনি। ভোট গণনা কেন্দ্রে একবারের জন্যেও আসেননি আজমত উল্লা। তাই সন্ধ্যা থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল, ফল তাঁর প্রতিকূলে যাচ্ছে।

ফল ঘোষণার সময় আসেননি  জায়েদা খাতুনও।  জাহাঙ্গীরকে ঘিরেই মধ্যরাতে বিজয় উল্লাসে মাতেন সমর্থকরা। তখনও দেখা মেলেনি জায়েদার। ফলে জায়েদা মেয়র নির্বাচিত হলেও গাজীপুরের চাবি থাকছে জাহাঙ্গীরের হাতেই। বিজয়ের পর জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আমার মা সবাইকে নিয়ে গাজীপুরের উন্নয়ন করবেন।

জায়েদা খাতুন তার নির্বাচনী হলফনামায় নিজেকে গৃহিণী ও স্বশিক্ষিত বলে উল্লেখ করেছেন। তার জন্ম গাজীপুর সিটি করপোরেশনের কানাইয়া এলাকায় ১৯৬২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। জাহাঙ্গীর আলমসহ তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছেন।

মেয়র পদে মনোনয়ন জমা দেওয়ার পূর্বে রাজনীতি বা সামাজিক কোন ক্ষেত্রে তার নাম শোনা যায় নি। তবে এলাকায় তিনি জনদরদি হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন পারিবারিক ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে এবং শিক্ষার্থীসহ গরিব-দুঃখী মানুষকে বরাবরই আর্থিক সহায়তা করেন।

তিনি পূর্বে নির্বাচন তো দূরের কথা কোন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেননি। তার সম্বন্ধে বলা যায় ছেলে জাহাঙ্গীর আলমের ইমেজকে ভিত্তি করেই তিনি ক্রমশ পরিচিতি অর্জন এবং নির্বাচন ও রাজনীতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছেন। এভাবেই তিনি এবারের মেয়র পদের নির্বাচনে তার অবস্থান অনেকটাই সুসংহত ও পাকাপোক্ত করে তুলেছেন।

তাকে নিয়ে আলোচনার কমতি নেই। নির্বাচনী পর্যবেক্ষকদের ধারণা তিনি অপরিচিতির বেড়া ভেঙে যেমন পরিচিতি লাভ করেছেন তেমনি মেয়র পদে প্রতিদ্বন্ধী হিসেবেও শক্তিশালী অবস্থানে চলে এসেছেন।

এর আগে দিনভর ভোটারের ঢল, শৃঙ্খলা, কৌশল সবই ছিল গাজীপুরের নির্বাচনে। যদিও দেশের অন্যতম রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি ও তাদের মিত্রদের বর্জনে অনেকেরই ধারণা ছিল ভোট হবে একতরফা। তবে কিন্তু সব ধারনা ভুল করে কেন্দ্রগুলোতে ছিল ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত উপস্থিতি। কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর পাওয়া যায়নি। ভোটকেন্দ্রে ছিল সিসি ক্যামেরা। গোপন বুথে ‘ডাকাত’ দেখা যায়নি। বহিরাগতরা বুথে ঢুকে ভোটারের ভোট দিয়ে দেয় বলে যে গুরুতর অভিযোগ প্রায় প্রতিটি নির্বাচনে পাওয়া যাচ্ছিল, তা গাজীপুরে ওঠেনি। ভোটাররা নিজের ভোট নিজেই দিতে পেরেছেন।  

বেশ কয়েক বছর ধরেই বিশ্লেষকরা বলে আসছেন, অনিয়ম ও কারচুপির নিয়মিত অভিযোগের কারণে দেশের নির্বাচন ব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের অনাস্থা তৈরি হয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহল  থেকেও সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর নানামুখী চাপের গুঞ্জনও ছিল। ভোটের আগের রাতে মার্কিন ভিসা নীতি পরিবর্তনের ঘোষণা আসে। সুষ্ঠু ভোটে বাধা দানকারীরা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা পড়বেন। এ ঘোষণা গাজীপুরের ভোটে নতুন মাত্র যোগ করে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সাত মাস আগে, গাজীপুরের নির্বাচন গুরুত্বের সঙ্গে নিতে বাধ্য হয় সরকার ও নির্বাচন কমিশন (ইসি)।  ইসিও বলেছিল, গাজীপুরের নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; কারণ দেশের মানুষ, বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা তাকিয়ে আছে এ নির্বাচনের দিকে। গাজীপুরের সুষ্ঠু ভোট কিছুটা হলেও চাপমুক্ত করছে ইসিকে। রাজনৈতিকভাবে নির্বাচনী অনিয়মের আরেকটি অভিযোগ থেকেও রেহাই পাচ্ছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও।

ভোট শেষে ঢাকায় নির্বাচন ভবনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। সেখানে কমিশন সদস্যরা বলেছেন, গাজীপুরে ভোটারদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে নির্বাচন প্রত্যাশার চেয়েও ভালো হয়েছে। এর আগে কমিশন সদস্যরা ইসির পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে বসে বড় স্ক্রিনে ভোট পর্যবেক্ষণ করেন এবং ভোটের মাঠে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পাঠান।

ঘড়ি আর নৌকা ছাড়া বাকিদের জামানত বাজেয়াপ্ত

গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে টেবিল ঘড়ি প্রতীক নিয়ে বিজয়ী সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মা জায়েদা খাতুন এবং তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকার আজমত উল্লা খান ছাড়া বাকি ছয় মেয়রপ্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৫ মে) রাতে রিটার্নিং কর্মকর্তার ঘোষিত ফলাফল বিশ্লেষণ করে এই তথ্য জানা গেছে।

বেসরকারি ফলাফল শিট অনুযায়ী, এই সিটির ১১ লাখ ৮৯ হাজার ৪৬৩ জন ভোটারের মধ্যে ভোট দিয়েছেন পাঁচ লাখ ৭৫ হাজার ৫০ জন, যা মোট ভোটের ৪৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

ইসি কর্মকর্তারা জানান, জামানত বাঁচাতে হলে প্রার্থীকে প্রদত্ত ভোটের কমপক্ষে আট ভাগের এক ভাগ পেতে হয়। এই সিটিতে ভোট পড়েছে পাঁচ লাখ ৭৫ হাজার ৫০টি। সেই হিসেবে জামানত বাঁচাতে প্রত্যেক প্রার্থীর কমপক্ষে ৭১ হাজার ৮৮১ ভোট পেটে হতো।

রিটার্নিং কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিজয়ী জায়েদা খাতুন টেবিল ঘড়ি প্রতীকে পেয়েছেন দুই লাখ ৩৮ হাজার ৯৩৪ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী নৌকার আজমত উল্লা খান পেয়েছেন দুই লাখ ২২ হাজার ৭৩৭ ভোট।

জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়াদের মধ্যে মাছ প্রতীকের আতিকুল ইসলাম ১৬ হাজার ৯৭৪, লাঙ্গল প্রতীকের এম এম নিয়াজ উদ্দিন ১৬ হাজার ৩৬২, হাতপাখা প্রতীকের গাজী আতাউর রহমান ৪৫ হাজার ৩৫২, গোলাপ ফুল প্রতীকের মো. রাজু আহাম্মেদ সাত হাজার ২০৬, ঘোড়া প্রতীকের মো. হারুন অর রশিদ দুই হাজার ৪২৬ এবং হাতি প্রতীকের সরকার শাহনূর ইসলাম পেয়েছেন ২৩ হাজার ২৬৫ ভোট।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *