গ্রামীন টেলিকমের লভ্যাংশ বিতরণ প্রসঙ্গে

:: নাজমুল আহসান ::

৪৭৪ কোটি টাকা ১৫০-১৭০ জন কর্মচারির মধ্যে বিতরণ করার পরও গ্রামীন টেলিকমকে মামলার ঘানি টানতে হচ্ছে — এই বিষয়টা নিয়ে লেখার পর থেকে বেশ কিছু প্রতিক্রিয়া পেলাম। প্রথম প্রথম প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করে জবাব দিয়েছি; এরপর আর কুলিয়ে উঠতে পারলাম না। তাই ভাবলাম মোটাদাগে এখানে কিছু উত্তর দিই।

কিছু মন্তব্য একেবারে অবভিয়াস। “আরে! এত কিছু তো জানতাম না আগে!” আবার একেবারে রাজনৈতিক ফাতরামি আছে: “৩০ হাজার কোটি টাকা…হিলারি…ঘুষ…আইন সবার জন্য সমান,” ইত্যাদি। এগুলোর জবাব দেওয়ার সময় আর মানসিক শক্তি, কোনোটাই আমার এই মুহূর্তে নাই।

কিছু হলো একদম গবেট। যেমন, একজন বললো অলাভজনক কোম্পানি হলে লাভ এত কেন! নন-প্রফিট কোম্পানি হলে প্রফিট করা যাবে না — এই হলো এদের বুদ্ধির দৌড়।

নন-প্রফিট কোম্পানির লাভ করতে কোনো সমস্যা নাই, কিন্তু সেই লাভ কোনো ব্যাক্তি নিজ স্বার্থে ব্যবহার করতে পারবেন না; শুধু প্রতিষ্ঠাকালীন ম্যান্ডেট অনুযায়ী দাতব্য বা জনহিতকর কাজে, বা প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন অন্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে ব্যবহার করতে পারবেন — এই কথাটাও বুঝিয়ে বলতে হবে, ভাবি নাই।

কিছু লেজিটেমিট প্রশ্নও আছে। যেমন কেউ বলেছেন, গ্রামীন টেলিকমের এত টাকা জমলো কীভাবে? তারা এতদিন করেছে কী? উত্তরটা মজার। টাকা আরও জমতো। কিন্তু অনেক টাকা খরচ করা হয়েছে স্কুল-হাসপাতাল বানাতে৷ এবং, এই ধরণের জনহিতকর কাজে টাকা খরচ করা নিয়ে দুদক “অর্থ আত্মসাৎ”-এর মামলাও দিয়েছে৷

কিছু টাকা দিয়ে নতুন সামাজিক ব্যবসায় (যেটা প্রতিষ্ঠান তৈরির ম্যান্ডেটে উল্লেখ ছিল) বিনিয়োগ হয়েছে, ইত্যাদি। টাকা অন্তত ড. মুহাম্মদ ইউনূস গিলে খেয়ে গায়েব করে দেন নাই। প্রতিটা টাকার পাই পাই হিসাব আছে। ব্যাংকে রাখা মানুষের লাখ কোটি টাকার আমানত আপনারা এক লোহমায় গায়েব করে দিতে পারেন। অথচ, এই লোকের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে হাজার হাজার কোটি টাকা ছিল বছরের পর বছর – কিন্তু তিনি বোর্ড চেয়ারম্যান হিসেবে নিজের বেতনটা পর্যন্ত নেন না পারিশ্রমিক হিসেবে। এমনকি গ্রামীন সংক্রান্ত কোনো দায়িত্বের বিনিময়ে তিনি কোনো পারিশ্রমিক, বেতন বা সম্মানী নেন না। তাঁর ব্যক্তিগত আয়ের শতভাগ হলো বিদেশে দেওয়া বক্তব্য, পুরষ্কার আর বই লিখে। সেই টাকাই তার জন্য অনেক। আবার বিদেশ থেকে আয় করা টাকা নিয়ে পর্যন্ত আলাদা করে আয়কর বিভাগকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে। নোবেল পুরষ্কার জয়ের অর্থ নিয়ে পর্যন্ত মামলা হয়েছে।

আচ্ছা, সে যাকগে। পুরনো কথায় ফিরে আসি।

কিছু মানুষের মন্তব্য দেখে মনে হলো, এরা ওই কাতারের কেউ নন। মানে গবেটও নন, আবার দলান্ধও নন। কিন্তু দেশে থাকতে থাকতে ফেয়ারনেস, সুবিচার, ইত্যাদির ধ্যানধারণা মস্তিষ্ক থেকে বিলোপ হয়ে গেছে। যখন সরকার কোনো ব্যাক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মামলায় হস্তক্ষেপ করে বা প্রভাব বিস্তার করে, সেই বিচার যে টেইন্টেড হয়ে যায় — সুবিচারের অত্যন্ত মৌলিক ধারণাগুলো এদের মধ্যে অনুপস্থিত।

বিষয়টা অনেকটা এরকম যে ধরেন, একটা গ্রুপ অব কোম্পানিজের গার্মেন্ট খাত নেট প্রফিট করলো ১০০ কোটি; আর কারখানার আসল শ্রমিকরা ৫% প্রফিট হিসেবে হয়তো পাবেন বছরে ১০,০০০ টাকা করে বা আরও কম। ব্যাংক করলো ১০০ কোটি। ফার্মা করলো ১০০ কোটি। মোট ৩০০ কোটি। কিন্তু তাদের হোল্ডিংস বা মাদার কোম্পানি, যারা শুধু ওউন করে অন্য কোম্পানিগুলো, তাদের ৩০ জন কর্মচারি পাবেন বাকি ২৮৫ কোটি টাকার ৫% অর্থাৎ ১৪ কোটি টাকা; বা গড়ে একজন ৬৬ লাখ করে।

কারও কারও মধ্যে গোষ্ঠীতান্ত্রিক মানসিকতা গেঁথে গেছে। এই টাইপের লোকগুলো সচরাচর আমাদের মধ্যবিত্ত। এরা কর্পোরেট চাকরি করেছেন। নিজের কোম্পানিতে ইউনিয়ন করেছেন। কেউ হয়তো প্রফিট-শেয়ারিং নিয়ে নিজ কোম্পানির সঙ্গে লড়াই করেছেন। সুবিধা পেয়েছেন, যেটা হয়তো তাদের নায্য প্রাপ্যও ছিল; অথবা পাননি, কোম্পানির অন্যায্য আক্রমণের শিকার হয়েছেন। অতএব, বাই ডিফল্ট, তারা “শ্রমিক”দের পক্ষে। এখানে কোনো যদি, আর কিন্তু থাকতে পারে না; সব কিছুই যেন সাদা আর কালো। মাঝখানে যেন কোনো গ্রে নাই।

আইনে আছে ৫% প্রফিট শেয়ার করতে হবে — অতএব, এই টাকা দিতে হবে। এই হলো তাদের কোমল মনের বুঝ। আসেন তাদেরকে একটু বুঝ দিই।

গ্রামীন টেলিকমের লাভের পুরো টাকাটাই আসে গ্রামীনফোনের শেয়ার ডিভিডেন্ড থেকে। অর্থাৎ গ্রামীনফোনের করা আয় থেকে। সেই আয়ের ৫% ডিভিডেন্ড তো গ্রামীনফোনের কর্মীরা পাবেন। কারণ, তাদের রক্তে, শ্রমে, আর ঘামে প্রতিষ্ঠান এত টাকা লাভ করেছে। গ্রামীন টেলিকমের কর্মীরা কেন পাবে? তাদের পরিশ্রমে কি এই টাকা এসেছে? প্রফিট তো শেয়ার তাদের সঙ্গে করবেন, যারা আপনার প্রফিট তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। সেজন্যই তো প্রফিট-শেয়ারিং-এর ধারণা তৈরি হয়েছে।

এখন আপনাদের বক্তব্য কি তাহলে এই যে, তৈরি হওয়া প্রফিটের ৫% আপনি গ্রামীনফোনের কর্মীদের দিয়ে দেওয়ার পর; আপনি সেই প্রফিট থেকে মাদার কোম্পানির এমপ্লয়ীদেরও ৫% করে দেবেন! এটা তো ডাবল হয়ে গেল — কোম্পানির স্বার্থ এখানে ক্ষুন্ন হলো না? আচ্ছা, তারপরও আপনাদের যুক্তি মেনে নিলাম।

এবার দেখেন যে সেটা কত লুডিক্রিয়াস একটা বিষয়।

ধরেন, গ্রামীনফোনের কর্মীর সংখ্যা এখন প্রায় হাজার তিনেক। যদি কোম্পানির নেট প্রফিট এক বছরে ৫০০ কোটি টাকা হয়, তাহলে ৫% হলো ২৫ কোটি টাকা। এই ২৫ কোটি টাকা গ্রামীনফোনের সব কর্মীর মধ্যে ভাগ হলে গড়ে সবাই পাবেন ৮৩ হাজার টাকা করে। ফেয়ার অ্যান্ড স্কয়ার!

কিন্তু গ্রামীন টেলিকমের কর্মীরা হলেন প্যারেন্ট বা মাদার কোম্পানির। এবার ধরেন, আপনার কথা মতো, গ্রামীন টেলিকমের কর্মীরা পাবেন তাদের ৫%। চলেন হিসাব করি। গ্রামীন টেলিকম তাদের লভ্যাংশ পাবে ১৬১ কোটি টাকা। আর সেই হিসাবে কোম্পানির ৬০ জন বর্তমান এমপ্লয়ী পাবেন ৫৩ লাখ টাকা করে। প্রতি বছর! এটা কোনো বাস্তবসম্মত কথা হলো?

বিষয়টা অনেকটা এরকম যে ধরেন, একটা গ্রুপ অব কোম্পানিজের গার্মেন্ট খাত নেট প্রফিট করলো ১০০ কোটি; আর কারখানার আসল শ্রমিকরা ৫% প্রফিট হিসেবে হয়তো পাবেন বছরে ১০,০০০ টাকা করে বা আরও কম। ব্যাংক করলো ১০০ কোটি। ফার্মা করলো ১০০ কোটি। মোট ৩০০ কোটি। কিন্তু তাদের হোল্ডিংস বা মাদার কোম্পানি, যারা শুধু ওউন করে অন্য কোম্পানিগুলো, তাদের ৩০ জন কর্মচারি পাবেন বাকি ২৮৫ কোটি টাকার ৫% অর্থাৎ ১৪ কোটি টাকা; বা গড়ে একজন ৬৬ লাখ করে।

ওয়াশিংটন ডিসি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে

লেখক: ইংরেজি সম্পাদক, বেনার নিউজ

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *