ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং: ১৭ জেলায় ৩৮ জনের মৃত্যু

:: নাগরিক প্রতিবেদন ::

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে দেশের ১৭ জেলায় অন্তত ৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। মঙ্গলবার রাত ৮টা পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকার প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে ৩৮ জনের মৃত্যুর খবর জানা গেছে।

এদের মধ্যে চট্টগ্রামের মিরসরাই উপকূলের সন্দ্বীপ চ্যানেলে বালু তোলার ড্রেজার ডুবে আট শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার রাতে উপজেলার সাহেরখালী ইউনিয়নের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগরের ৩ নম্বর জেটি এলাকার পশ্চিমে এ ড্রেজারডুবির ঘটনা ঘটে।

চট্টগ্রাম নগরের মোহরায় জোয়ারের পানিতে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মোবারক হোসেন নামে এক যুবক ও সীতাকুণ্ডের শিপইয়ার্ডে ভেসে এসেছে তিন মাসের এক শিশুর মরদেহ।

ভোলায় চারজনের মৃত্যু হয়েছে। গাছের চাপায় প্রাণ যায় বিবি খাদিজা (৬৮) নামের এক নারীর। চরফ্যাশন উপজেলায় ঘূর্ণিঝড়ের সময় মোটরসাইকেলে করে দুজন যাওয়ার পথে গাছের ডাল পড়ে ঘটনাস্থলে মারা যান স্বর্ণ ব্যবসায়ী মো. মাইনুদ্দিন (৪৫)। ভোলা সদর উপজেলার চেউয়াখালী গ্রামের মফিজুল ইসলাম (৭০) ঘরচাপায় এবং লালমোহন উপজেলার ফাতেমাবাদ গ্রামের ফরিদুল ইসলামের স্ত্রী রাবেয়া বেগম (২৫) পানিতে ডুবে মারা যান।

টাঙ্গাইলের মধুপুরে ঝড়ের সময় সড়ক দুর্ঘটনায় দুই পুলিশ কনস্টেবল নুরুল ইসলাম ও মো. সোহেল এবং আসামি লালন নিহত হন। ঘরে বৃষ্টির পানি ডুকে তলিয়ে যাওয়া আইপিএস সরাতে গিয়ে বিদ্যুৎপৃষ্টে মারা যান টাঙ্গাইল শহরের সাবালিয়া পাঞ্জাপাড়া এলাকার শরীফ ফকির।

কুমিল্লার নাঙ্গলকোট উপজেলা হেসাখাল গ্রামের পশ্চিমপাড়ায় সোমবার রাতে ঘরের ওপর গাছ পড়লে এক পরিবারের তিনজন নিহত হয়েছেন। তারা হলেন- নিজাম উদ্দিন, তার স্ত্রী শারমিন আক্তার ও তাদের চার বছরের মেয়ে নুসরাত আক্তার।

নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলা পরিষদ চত্বরে সোমবার রাতে গাছের ডাল ভেঙে পড়ে মারা যান মর্জিনা বেগম (৪০) নামের এক নারী।

বরগুনা সদর উপজেলার সোনাখালী এলাকায় একটি ঘরের চালে গাছ পড়লে ওই ঘরে থাকা আমেনা খাতুন নামের এক নারী মারা যান।

প্রবল ঢেউয়ে সিরাজগঞ্জে নৌকাডুবিতে মা ও ছেলের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন- উপজেলার পূর্বমোহনপুর গ্রামের খোকনের স্ত্রী আয়েশা খাতুন (২৮) এবং তার ছেলে আরাফাত হোসেন (২)।

গাছচাপায় গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার পাঁচকাহনিয়া গ্রামের রেজাউল খার স্ত্রী শারমিন বেগম (২৫) ও বাঁশবাড়ির চরপাড়া গ্রামের হান্নান তালুকদারের স্ত্রী রোমেছা বেগম (৫৮) মারা যান।

ঝড়ের সময় রান্নাঘরের ওপর গাছ উপড়ে পড়ে নোয়াখালীর সুবর্ণচর উপজেলার পূর্ব চরবাটা গ্রামে আইনজীবী মো. আবদুলল্গাহর ১১ বছর বয়সী শিশু সন্তান সানজিদ আফ্রিদি মারা গেছে।

শরীয়তপুরের জাজিরার সিডারচর এলাকায় গাছের নিচে চাপা পড়ে সাফিয়া বেগম (৬৫) নামের এক নারীর মৃত্যু হয়।

কক্সবাজারের টেকনাফে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। মিয়ানমার থেকে টেকনাফ বন্দরে পণ্য নিয়ে আসা জাহাজ ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়লে ডেক থেকে পড়ে শৌমিং (৭১) নামের এক বাবুর্চির মৃত্যু হয়। তিনি মিয়ানমারে নাগরিক। এ ছাড়া ঝড়ের সময় নিখোঁজ সোহেনা (৯) নামে এক শিশুর লাশ টেকনাফ পৌরসভার একটি পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয়।

পটুয়াখালী সদর উপজেলার প্রতাপপুর খেয়াঘাট এলাকায় লোহালিয়া নদীতে ইটবোঝাই ট্রলার ডুবে নিখোঁজ হন ট্রলারের শ্রমিক নুরুল ইসলাম (৪৫)।

গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার ইকুরিয়া গ্রামে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের সময় ঘরচাপায় আনিসুর রহমান (৯) নামের এক শিশুর মৃত্যু হয়।

মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার কনকসার এলাকার আব্দুর রাজ্জাকের স্ত্রী আসমা বেগম (২৮) ও তার মেয়ে সুরাইয়া আক্তার (৩) বসত ঘরে গাছ ভেঙে পড়লে মারা যান।

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে ৫৮ হাজার ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানের ভাষ্য, সিত্রাংয়ের যে ভয়ঙ্কর মূর্তি ছিল তা পূর্ণরূপ গ্রহণ না করায় ক্ষয়ক্ষতি আশঙ্কার চেয়ে কম হয়েছে। তিনি জানান, ১০ হাজার ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হয়েছে। মারা গেছেন ৯ জন। ফসলি আক্রান্ত হয়েছে ৯ হাজার হেক্টর। মৎস্যঘের ভেসে গেছে এক হাজার। সরকার বলছে, তারা ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে আছে।

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে ৮০ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎ-বিচ্ছিন্ন

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ে বিদ্যুৎ বিতরণ লাইনে ব্যাঘাত ঘটার কারণে ৮০ লাখ গ্রাহক বর্তমানে বিদ্যুৎ সেবার বাইরে রয়েছে। বুধবার (২৬ অক্টোবর) দুপুরের মধ্যে এ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ।

ঘূর্ণিঝড়ে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) সচিবালয়ে নিজ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান তিনি।

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কারণে কত গ্রাহক এখন বিদ্যুৎ-বিচ্ছিন্ন অবস্থায় আছে এমন প্রশ্নের উত্তরে প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমাদের প্রায় ৪ কোটি ৮০ লাখের মতো গ্রাহক। এখন প্রায় ৮০ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎ-বিচ্ছিন্ন আছে। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড-এর ৮০০-এর বেশি পোল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পিডিবিসহ সব মিলিয়ে প্রায় দেড়-দুই হাজার পোল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা আশা করছি আজ বিকেলের মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশ গ্রাহকের বিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে পারব। 

তিনি বলেন, ট্রান্সমিশনে আমাদের খুব বড় রকমের আঘাত হয়নি। বড় ধরনের আঘাত হয়েছে ডিস্ট্রিবিউশনের ক্ষেত্রে। সেখানে তার ছিঁড়ে গেছে। গাছ উপড়ে গিয়ে লাইনের ক্ষতি করেছে। অনেক জায়গায় পোল (বিদ্যুতের খুঁটি) পড়ে গেছে, ভেঙে গেছে। প্রচুর জায়গায় সমস্যা দেখা গেছে। তার ছিঁড়ে যাওয়ার কারণে সংশ্লিষ্ট এলাকায় আমরা বিদ্যুৎ সম্পূর্ণ বন্ধ রেখেছি। এক্সিডেন্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে, সম্পূর্ণভাবে ঠিক না করা পর্যন্ত আমরা বিদ্যুৎ চালু করব না। 

সম্পূর্ণ সমাধান হতে কতদিন লাগবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা আগামীকাল দুপুরের মধ্যে শতভাগ গ্রাহককে বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারব বলে আশা করছি। আমাদের কর্মীরা কাজ করছেন, বিশেষ করে আরএডি ঝড় শুরু হওয়ার পর থেকেই সজাগ ছিলো। এখন ২৪ ঘণ্টা তারা কাজে নিয়োজিত আছেন, বিশেষ করে আরএডি ও পিডিবি। 

ভোলা, পটুয়াখালী, বরিশাল, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালীতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী।

কী পরিমাণ অর্থের ক্ষতি হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, টাকার অংক এই মুহূর্তে আমাদের কাছে আছে। সে বিষয়টি আমরা এখন বলতে চাই না। বেশ ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে সাবস্টেশনগুলোতে পানি উঠে গেছে।

সোমবার (২৪ অক্টোবর) সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ বাংলাদেশের উপকূলে আঘাত শুরু করে সিত্রাংয়ের অগ্রবর্তী অংশ। আর রাত ১০টা নাগাদ ঝড়টির কেন্দ্র উপকূল পেরিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করে। পরে সিলেট ও কুমিল্লা হয়ে ত্রিপুরায় প্রবেশ করে।

৪১৯টি ইউনিয়নে ১০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের আঘাতে দেশের ৪১৯টি ইউনিয়নে ১০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী মো. এনামুর রহমান। এ সময় প্রায় সাত হাজার আশ্রয়কেন্দ্রে ১০ লাখ মানুষকে নিয়ে আসা হয়, যারা ইতোমধ্যে বাড়ি ফিরেছেন জানান তিনি।

মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) দুপুরে সচিবালয়ে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী।

এনামুর রহমান বলেন, ‘সিত্রাংয়ে ৪১৯টি ইউনিয়নের প্রায় ১০ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এছাড়া ৬ হাজার হেক্টর কৃষিজমি ও এক হাজার চিংড়ির খামারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’

প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত চিংড়িচাষিদের সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া হবে। এছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত ঘরের জন্য টিন ও নির্মাণ শ্রমিকদের মজুরি দেওয়া হবে’।

এনামুর রহমান বলেন, সিত্রাংয়ের কারণে দেশের ৬ হাজার ৯২৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১০ লাখ মানুষ আশ্রয় নেন। ঘূর্ণিঝড় শেষে মধ্যরাত থেকে মানুষ বাড়ি ফিরতে শুরু করেছেন। সকালের মধ্যে সবাই আশ্রয়কেন্দ্র ত্যাগ করেছেন।

এনামুর রহমান জানান, ঝড়ের কবলে পড়ে নয়জনের প্রাণহানি হয়েছে। এরমধ্যে আটজন মারা গেছেন ঘরের ওপর গাছ পড়ে। এছাড়া ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ছয় হাজার হেক্টর ফসলি জমি ক্ষতি হয়েছে।

তবে বেসরকারি হিসাব মতে রাতভর চলা এই ঝড়ের তাণ্ডবে ইতোমধ্যে দেশের আট জেলায় ১৭ জনের প্রাণহানি হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে ঢাকা-খুলনা ও ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে গাছ উপড়ে যোগাযোগ বন্ধ হলেও মঙ্গলবার (২৫ অক্টোবর) ভোররাত নাগাদ দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে দেশের সড়ক যোগাযোগও অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। দুটি মহাসড়কেই সীমিত আকারে যান চলাচল শুরু হয়েছে।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *