চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্থানের নামের ইতিহাস

:: ফিচার ডেস্ক ::

চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন স্থানের নামের ইতিহাস জেনে নেওয়া যাক।

☞ হালিশহরঃ আরবি ‘হাওয়ালে শহর’ থেকে উদ্ভুত। অর্থ- ‘শহরতলি’। এটি ছিল আরব বণিকদের সাময়িক বসবাসের জন্য নির্ধারিত স্থান।

☞ শোলকবহরঃ আরব বণিকদের নৌবাণিজ্যের যুগে প্রাচীন কর্ণফুলী নদীর যে স্থানটিতে বাণিজ্যতরী অবস্থান করত সেটি ‘সুলকুল বহর’ নামে খ্যাত ছিল। আরবি ‘সুলকুল বহর’ শব্দের অর্থ- ‘বাণিজ্যতরীর বিরতি স্থান- পোতাশ্রয়’। পরবর্তীতে এলাকাটি বর্তমানের ‘সুলকবহর’ নামে বিবর্তিত হয়েছে।

☞ ষোলশহরঃ সুলকবহরের কাছের এই জায়গাটি ‘চাহেলে শহর’ নামে পরিচিত ছিল। আরবি চাহেলে শহর নামের অর্থ ‘নদীর তীরবর্তী শহর’ যা কালক্রমে ষোলশহর নাম ধারণ করে।

☞ আন্দরকিল্লাঃ আরকানি আমলে এখানে প্রাচীন দুর্গ ছিল। নাম ছিল- ‘চাটিগাঁ দুর্গ’। ১৬৬৬ সালে মোগল বাহিনী আরকানি বাহিনীকে পরাজিত করে এই দুর্গ দখল করলে প্রধান সেনাপতি উমেদ খাঁ এই দুর্গের নাম দেন ‘আন্দরকিল্লা’।

☞ লালদিঘিঃ বর্তমান চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ সদর দপ্তরে ইংরেজ আমলের শুরুর দিকে একটি পাকা ভবন ছিল যেটির দেওয়ালে লাল রঙ দেয়া হয়েছিল যা ‘লালকুঠি’ নামে পরিচিত ছিল। লালকুঠির সন্নিকটের দিঘিটি ‘লালদিঘি’ নামে বিখ্যাত হয়ে উঠে।

☞ হাজারি লেনঃ আন্দরকিল্লার মধ্যস্থিত এই গলিতে বারজন মোগল ‘হাজারি’ বা সেনাপতির অন্যতম ভগবান সিং হাজারির বাড়ি ছিল। তা থেকে এই নামের উৎপত্তি।

☞ মেহেদিবাগঃ চট্টগ্রাম শহরের এই এলাকাটিতে এককালে মেহেদি গাছের আধিক্য ছিল।

☞ চকবাজারঃ পূর্ব নাম- ‘সদরবাজার’। আরকানিদের হটিয়ে চট্টগ্রাম মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হলে এই বাজার স্থাপনের মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম শহরের গোড়াপত্তন হয়। চট্টগ্রামের ১৮তম মোগল শাসক নবাব অলি বেগ খাঁ সদরবাজারের নাম ‘চকবাজার’ নামে পরিবর্তন করেন। চকবাজারেই ‘অলি খাঁর মসজিদ’ নামে পুরাতন একটি মসজিদ এখনো রয়েছে।

☞ কাপাসগোলাঃ কার্পাস শব্দের বিকৃত রূপ ‘কাপাস’। প্রাচীনকালে পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্ত কার্পাস তুলা এখানে বিক্রির জন্য গোলাজাত বা জমা হতো বলে এই এলাকাটি ‘কাপাসগোলা’ নামে খ্যাত হয়।

☞ কাঠগড়ঃ এই স্থানে আরকানিদের কাঠের নির্মিত দুর্গ ছিল। কাঠের দুর্গের অপর নাম ছিল ‘কাঠগড়’।

☞ লাভ লেইনঃ ব্রিটিশ আমলে এটি ছিল ইংরেজ কর্মচারীদের আবাসিক এলাকা। এই এলাকায় ইংরেজ নারী-পুরুষের প্রকাশ্য প্রেমের কারনে এই নামের উৎপত্তি।

☞ আলকরণঃ আলকরণ অর্থ- গণ্ডারের শিং। আরব বাণিজ্যের যুগে এই এলাকায় গণ্ডারের শিং এর আড়ৎ ছিল। তৎকালে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে গণ্ডারের শিং মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে রপ্তানি হতো।

☞ অভয় মিত্রের ঘাটঃ ফিরিঙ্গি বাজার নিবাসী ধনাঢ্য রায় বাহাদুর অভয়চরণ মিত্রের নামানুসারে এই ঘাট।

☞ দেবপাহাড়ঃ ব্রিটিশ সরকার শরচ্চন্দ্র দাস নামের এক ব্যক্তির কাজে খুশি হয়ে তাঁকে পুরষ্কারস্বরূপ ‘জয়নামা বা জাঁহানুমা’ পাহাড়টি প্রদান করেন। শরচ্চন্দ্র ঐ পাহাড়শীর্ষে একটি দেবমন্দির নির্মাণ করে নতুন নাম দেন ‘দেবপাহাড়’।

☞ চন্দনপুরাঃ পার্বত্য চট্টগ্রামে উৎপাদিত আগরকাঠ প্রাচীনকাল হতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজযোগে ইউরোপে রপ্তানি হতো। আগরকাঠ সেকালে চট্টগ্রামবাসীর কাছে ‘চন্দনকাঠ’ নামে খ্যাত ছিল। বর্তমান চন্দনপুরা ছিল এসব চন্দনকাঠের গোলাঘর বা মজুতস্থান।

☞ পার্সিভাল হিলঃ চন্দনপুরার বিপরীতের এক উচ্চ পাহাড়ে ‘ব্রেডন পার্সিভাল’ নামের এক পর্তুগিজ বাসিন্দা সপরিবারে বসবাস করার জন্য বাড়ি তৈরি করেন। এই পার্সিভাল পরিবারের একাধিক সদস্য পরবর্তীতে চট্টগ্রাম জজ কোর্টের আইনজীবী ছিলেন। আরেক সদস্য ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের শিক্ষক। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় চট্টগ্রামের পার্সিভাল পরিবারের শেষ পুরুষ চট্টগ্রাম ত্যাগ করে লন্ডনবাসী হন।

☞ পাথরঘাটাঃ কথিত আছে- পীর বদর শাহ আরব দেশ থেকে সমুদ্রপথে একটি পাথরের উপর সওয়ার হয়ে চট্টগ্রামে আসেন। এবং সেই পাথরখানি কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী একটি স্থানে থেমে যাওয়ার পর তিনি তীরে উঠে আসেন। তখন থেকে এই জায়গার নাম ‘পাথরঘাটা’ নামে খ্যাত হয়৷

☞ এনায়েত বাজারঃ এনায়েত খাঁ নামের একজন মোগল সেনাপতির নামানুসারে এই নামকরণ হয়েছিল। এনায়েত বাজার ছিল তৎকালীন মোগল সেনাবাহিনীর মুসলমান সেনাদলের আবাসস্থল।

☞ টাইগার পাসঃ দু’পাশে উঁচু পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে এই রাস্তাটি সোজা চলে গেছে সমুদ্রে। ১৯ শতকের শেষার্ধেও এসব পাহাড় ছিল জনবসতিহীন, গভীর জঙ্গলাবৃত এবং বাঘের আখড়া। ১৮৬২ সালে চট্টগ্রামে কর্মরত ব্রিটিশ সিভিলিয়ান মিস্টার ক্লে’র আত্মজীবনী থেকে জানা যায়- এখানে নিয়মিত বাঘের আক্রমনে লোকে প্রাণ হারাতো, এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে এই রাস্তা ধরে বাঘ চলাচল করতো বিধায় এটি “টাইগার পাস” নামে খ্যাত হয়। সেই ঐতিহাসিক স্মৃতির স্মারক হিসেবে বর্তমানে টাইগার পাস এলাকায় টাইগার বা বাঘের মূর্তি স্থাপিত আছে।

☞ বাঘ ভ্যালিঃ চট্টেশ্বরী রোডের ওয়ার সিমেট্রির সন্নিকটস্থ এই পাহাড়ি এলাকাটি একসময় ছিল জনমানবহীন ও জঙ্গল আবৃত- সেখানে দিনে দুপুরে বাঘ বিচরণ করতো। এই এলাকায় বাঘ ধরার জন্য ফাঁদ পাতার ব্যবস্থা ছিল, জীবন্ত বাঘ ধরতে পারলে মিলতো পুরষ্কার। এভাবেই এলাকাটি বাঘভ্যালি বা বাঘের উপত্যকা হিসেবে খ্যাত হয়।

☞ খুলশীঃ আরবি ও ফারসি ভাষার প্রচলিত “খোলাসা” শব্দ থেকে খুলশী নাম উদ্ভুত। খোলাসা অর্থ খোলামেলা, জনবিরল স্থান।

☞ কাজির দেউড়িঃ কাজি মির আবদুল গণির নামানুসারে এই এলাকা খ্যাত হয়েছে। ১৮ শতকের গোড়ার দিকে তিনি দিল্লী গমন করে তৎকালীন মোগল সম্রাটের কাছ থেকে চট্টগ্রামের কাজী (বিচারক) এর দায়িত্ব লাভ করেন এবং স্টেডিয়ামের পূর্বদিকে নিজের দেউড়ি (বহির্বাড়ি) ও মসজিদ স্থাপন করেন।

☞ আসাদগঞ্জঃ পটিয়া থানার বড় উঠান গ্রামনিবাসী ১৮ শতকের প্রখ্যাত জমিদার আসাদ আলী খাঁ’র নামানুসারে এই এলাকার নামকরণ হয়েছে।

☞ বকশীর হাটঃ ইংরেজ আমলের শুরুর দিকে বাঁশখালীর নিবাসী বকশী হামিদ নামের এক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি এই বকশীর হাট স্থাপন করেন। বাঁশখালীর ইলসা গ্রামে বকশী হামিদের নামে দিঘি, মসজিদ ইত্যাদি নিদর্শন আজো বিদ্যমান।

☞ খাতুনগঞ্জঃ উনবিংশ শতকে চট্টগ্রামের একজন অভিজাত, গুণী ও খ্যাতিমান ব্যক্তি ছিলেন খান বাহাদুর হামিদউল্লাহ খাঁ। তিনি ফারসি ভাষায় “তারিখে হামিদী” শিরোনামে প্রথম চট্টগ্রামের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছিলেন। হামিদউল্লাহ খাঁ’র ২য় পত্নীর নাম ছিল- খাতুন বিবি। কালক্রমে তাঁর স্ত্রী খাতুন বিবির নামে এই খাতুনগঞ্জ গড়ে উঠে।

☞ রহমতগঞ্জঃ ১৬৯৮ সালে নবাব রহমতুল্লা চট্টগ্রামের শাসনকর্তা নিয়োগ হলে এই স্থান তাঁর নামে পরিচিত হয়ে উঠে। বর্তমান জে.এম.সেন হলের উত্তর পার্শ্বে নবাব রহমতুল্লাহর কবর বিদ্যমান রয়েছে।

☞ ফিরিঙ্গি বাজারঃ ১৬ শতকের শুরুর দিকে চট্টগ্রামে পর্তুগিজ বণিকরা আগমন করে। তারা এদেশে “ফিরিঙ্গি” নামে খ্যাত ছিল। অত্র এলাকাটি ছিল ফিরিঙ্গি বণিকদের আড়ত।

☞ রেয়াজুদ্দিন বাজারঃ এই এলাকাটি একসময় ছিল জমিদার দেওয়ান বৈদ্যনাথের বাগানবাড়ি। এখানে সেগুনবাগিচা ছিল। পরবর্তীতে এই এলাকাটি কিনে নেন চট্টগ্রামের প্রথম মুসলমান বিএ, বিএল শেখ রেয়াজুদ্দিন সিদ্দিকির পিতা শেখ মোঃ ওয়াশীল। শেখ রেয়াজুদ্দিন এই এলাকার প্রভূত উন্নয়ন ঘটালে এটি তাঁর নামে পরিচিত হয়ে উঠে।

☞ চেরাগী পাহাড়ঃ কথিত আছে- আরব দেশ থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে হযরত বদর শাহ নামক এক সুফি সাধক মাটি নির্মিত একটি চেরাগ বা চাটি হাতে নিয়ে সমুদ্রে পাথরের উপর আরোহন করে চট্টগ্রাম এসে পৌঁছান। তখন চট্টগ্রাম ছিল গভীর অরণ্যাবৃত এবং জ্বীনপরীর আবাসস্থল। বদর শাহ একটি অনুচ্চ পাহড়ে উঠতে গেলে জ্বীনপরীরা বাধা প্রদান করে এবং থাকার অনুমতি দেয়না। তখন বদর শাহ রাতের অন্ধকারে হাতের চেরাগটি পাহাড়ে রেখে জ্বালাবার স্থানটুকু দিতে অনুরোধ করলে জ্বিনেরা রাজি হয়। কিন্তু চেরাগ জ্বালাবার পর চেরাগের তেজ সহ্য করতে না পেরে জ্বিনেরা স্থান ত্যাগ করে এবং বদর শাহ সেখানে ইবাদাতের স্থান তৈয়ার করেন। উল্লেখ্য “চেরাগী পাহাড়” টি “চাটির পাহাড়” নামেও পরিচিত, চাটি অর্থ মৃৎপ্রদীপ। অনেকে ধারণা করেন- এই “চাটি” শব্দ থেকেই চাটিগাঁ> চাটগাঁ> চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি। বর্তমানে এই চেরাগী পাহাড়ে চেরাগ সদৃশ একটি সুন্দর স্থাপনা নির্মিত আছে।

তথ্যসূত্র

* বন্দর শহর চট্টগ্রামঃ আবদুল হক চৌধুরী

* চট্টগ্রামের ইতিহাসঃ পূর্ণচন্দ্র চৌধুরী

* চট্টগ্রামের ইতিহাসঃ ওহীদুল আলম

* বৃহত্তর চট্টলাঃ মোহাম্মদ নুরুল হক

* From a Diary in Lower Bengal: Mr. A.St. Clay

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *