টিপু হত্যার অভিযোগপত্রে আ.লীগ নেতাসহ আসামি ৩৩

:: নাগরিক প্রতিবেদন ::

মতিঝিলের সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু ও কলেজছাত্রী সামিয়া আফনান প্রীতি হত্যাকাণ্ডের তদন্ত শেষ করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। 

ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ সোমবার সাংবাদিকদের বলেন, অভিযোগে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতাসহ ৩৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। আমরা কোনো দল দেখিনি। তদন্তে যার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে, তাকেই অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

অভিযোগপত্রে থাকা আসামিরা হলেন—ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফ তালুকদার, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা মারুফ আহমেদ মনসুর, ফ্রিডম মানিক, মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক খায়রুল ইসলাম, মতিঝিল থানা জাতীয় পার্টির নেতা জুবের আলম খান রবিন, হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক সোহেল শাহরিয়ার, ১০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি মারুফ রেজা সাগর, ১১ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক সভাপতি কামরুজ্জামান বাবুল, ১০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সদস্য কাইল্যা পলাশ, একই ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক নেতা আমিনুল, ছাত্রলীগের সাবেক আহ্বায়ক ‘ঘাতক’ সোহেল, সুমন শিকদার মুসা, মুসার ভাগনে সৈকত, মুসার ভাতিজা শিকদার আকাশ, ইমরান হোসেন জিতু, মোল্লা শামীম, রাকিব, বিডি বাবু, ওমর ফারুক, ‘কিলার’ নাসির, রিফাত, ইশতিয়াক হোসেন জিতু, মাহবুবুর রহমান টিটু, হাফিজ, মাসুম ও রানা মোল্লা। তাদের মধ্যে ২৪ জনই গ্রেফতার হয়েছেন। এ হত্যা মামলায় মুসা, শুটার আকাশ ও নাসির উদ্দিন মানিক স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

টিপু হত্যা মামলার তদন্তে ৩৪ জনের সংশ্লিষ্টতা পায় ডিবি। তাদের মধ্যে এক্সএল সোহেল নামে সন্দেহভাজন একজনের পরিচয় নিশ্চিত করতে না পারায় তাকে অভিযোগপত্রে রাখা হয়নি। বাকি ৩৩ জনকে আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে ২৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, ৯ জন এখনো পলাতক।

আলোচিত এই মামলার অভিযোগপত্রে এক নম্বর আসামি হচ্ছেন পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ মন্টি। টিপু হত্যার ভেতর দিয়ে আবার আলোচনায় আসেন জিসান। রাজধানীর গুলশান, বনানী, পল্টন, মগবাজার, মালিবাগ, ফকিরাপুল, মতিঝিল এলাকায় একসময় দাপিয়ে বেড়াতেন তিনি। অভিজাত এসব এলাকার ব্যবসা ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত চাঁদা তুলতেন। তালিকাভুক্ত ২৩ সন্ত্রাসীর একজন তিনি।  ইন্টারপোল তাঁর নামে রেড অ্যালার্ট জারি করে রেখেছে।

সংস্থাটির ওয়েবসাইটে তাঁর বিষয়ে বলা আছে, হত্যাকাণ্ড ঘটানো এবং বিস্ফোরক বহনের অভিযোগ আছে। ২০০৩ সালে মালিবাগের একটি হোটেলে দুই ডিবি পুলিশকে হত্যার পর আলোচনায় আসেন জিসান। ২০০৫ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে তিনি দেশ ছাড়েন। জিসান ও আরেক সন্ত্রাসী ফ্রিডম মানিকের ‘ছায়া’ পেয়েই টিপু হত্যাকাণ্ডে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন সুমন শিকদার মুসা। তিনি ঢাকার অপরাধজগতের আরেক নিয়ন্ত্রক। টিপু হত্যার সমন্বয়কারী হিসেবে আবার তাঁর নাম সামনে এলো। এর আগে ২০১৬ সালে মতিঝিলে যুবলীগ কর্মী রিজভী হাসান ওরফে ‘বোঁচা বাবু’ হত্যার সময়ও শুটারকে ভাড়ার দায়িত্ব ছিল তাঁর। বাবু হত্যা মামলার অভিযোগপত্রভুক্ত আসামি তিনি। বিচার চলাকালে আদালতে আইনজীবীর মাধ্যমে করোনার সনদ দাখিল করে ১২ মার্চ শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে দুবাই পালিয়েছেন মুসা। পালানোর আগে ১০ বছর মেয়াদি নতুন পাসপোর্টও করেন। এর আগে টিপু হত্যার সব ছক চূড়ান্ত করেন।

তদন্তে হত্যার কারণ সম্পর্কে এক প্রশ্নে ডিবি কর্মকর্তা হারুন বলেন, আইডিয়াল স্কুলে ভর্তি, এলাকায় আধিপত্য ও মতিঝিল এলাকার চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের কিছু বিষয় তদন্তে এসেছে।

জাহিদুল ইসলাম টিপু (৫৪) ছিলেন ঢাকার মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ছিলেন তিনি। মতিঝিল এজিবি কলোনির গ্র্যান্ড সুলতান রেস্তোরাঁর মালিক টিপু ঠিকাদারির কাজও করতেন। দুই মেয়ে, এক ছেলের বাবা টিপু থাকতেন শাহজাহানপুরে।

২০২২ সালের ২৪ মার্চ রাত সোয়া ১০টার দিকে শাহজাহানপুরে ইসলামী ব্যাংকের পাশে বাটার শোরুমের সামনে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপুকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই সময় গাড়ির পাশে রিকশায় থাকা সামিয়া আফরান প্রীতি (১৯) নামের এক কলেজছাত্রীও নিহত হন। এ ছাড়া টিপুর গাড়িচালক মুন্না গুলিবিদ্ধ হন। ওই দিন রাতেই শাহজাহানপুর থানায় নিহত টিপুর স্ত্রী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সংরক্ষিত কাউন্সিলর ফারহানা ইসলাম ডলি হত্যা মামলা করেন। এতে অজ্ঞাতদের আসামি করা হয়।

হত্যাকাণ্ডের পর টিপুর স্ত্রী স্থানীয় নারী ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফারহানা ইসলাম ডলি যে মামলা করেছেন, তাতে আসামির তালিকায় কারও নাম উল্লেখ করা ছিল না। পরে ওই বছর ২৬ মার্চ রাতে বগুড়া থেকে মাসুম মোহাম্মদ ওরফে আকাশ নামে একজনকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, এ ব্যক্তিই টিপুকে গুলি করেছিলেন। 

পরে আরফান উল্লাহ দামাল নামে আরও একজনকে অস্ত্রসহ গ্রেফতার করা হয় কমলাপুর থেকে। এরপর ২ এপ্রিল সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহ, মতিঝিল থানার ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুকসহ চারজনকে গ্রেফতার করার কথা জানায় র‌্যাব।

র‌্যাব সেই সময় বলেছিল— চাঁদাবাজি ও দরপত্র নিয়ে আধিপত্যের দ্বন্দ্ব, রিয়াজুল হক মিল্কী হত্যার বদলা এবং বোঁচা বাবু হত্যা মামলা থেকে বাঁচতে টিপুকে হত্যার পরিকল্পনা করেন ওমর ফারুকসহ স্থানীয় কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা। বাজেট ছিল ১৫ লাখ টাকা।

পরে এ হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সন্দেহভাজন সুমন শিকদার মুসাকে ওমান থেকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। হত্যাকাণ্ডের ১২ দিন আগেই মুসা দুবাই চলে গিয়েছিলেন। হত্যা পরিকল্পনা এবং যাবতীয় নির্দেশনা সেখান থেকেই দেওয়া হয় বলে সে সময় তদন্তকারীরা জানিয়েছিলেন।

তারা বলেছিলেন, মুসা ‘রাজনীতি ও অপরাধ জগতের মধ্যে যোগসূত্র’ হিসেবে কাজ করে আসছিলেন। ঢাকা ও দুবাইয়ের অপরাধ জগতের মধ্যেও সংযোগের সমন্বয় করতেন তিনি।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *