খাবার স্যালাইনের আবিষ্কারক ডা. রফিকুল ইসলাম

অন্তরালে থাকা মানুষটির নাম ডা. রফিকুল ইসলাম। অনেকে হয়ত জানেন না যে, এই মানুষটিই খাবার স্যালাইনের মত জীবন বাঁচানোর যুগান্তকারী ঔষধটি আবিস্কার করেছিলেন। জনস্বাস্থ্যে খাবার স্যালাইনের গুরুত্ব বিবেচনায় ব্রিটিশ মেডিকেল জার্নাল দ্য ল্যান্সেট একে চিকিৎসা বিজ্ঞানে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার আখ্যা দিয়েছিল। গতকাল ৬ মার্চ ছিল গুনী এই মানুষটির দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী।


ডায়রিয়ার হাত থেকে বিশ্বজুড়ে লক্ষ লক্ষ শিশুর জীবন বাঁচানোর কৃতিত্ব দেওয়া হয় খাবার স্যালাইনকে (ওআরএস)। সব ওষুধের দোকানেই স্বল্প মূল্যে খাবার স্যালাইন পাওয়া যায়। তবে হাতের কাছে এটি পাওয়া না গেলেও সবাই জানে এক মুঠো চিনি বা গুড় আর তিন আঙ্গুলের এক চিমটি লবণ আধা লিটার বিশুদ্ধ পানিতে মিশিয়ে ডায়রিয়ার প্রাণরক্ষাকারী দ্রবণটি তৈরি করা যায়।

গ্রামের মানুষকে ডায়রিয়া সম্পর্কে সচেতন করা ও বাড়িতে স্যালাইন তৈরি করার প্রকল্প ব্র্যাক শুরু করেছিল ১৯৮০ সালে। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে গ্রামের মাঠকর্মীরা প্রতিটি খানার অন্তত একজন সদস্যকে পানি, লবণ ও গুড়ের দ্রবণ তৈরি করা শেখান। সরকারি গণমাধ্যম বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন এ ব্যাপারে নিয়মিত প্রচার চালায়। ১৯৯০ সাল নাগাদ দেশের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।


জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ব্র্যাকের এই কর্মসূচি ডায়ারিয়া প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে। সাধারণ মানুষ স্যালাইন তৈরি করতে পারে। আর ডায়রিয়া হলে স্যালাইন খেতে হয়, সেই সচেতনতাও মানুষের এসেছে। আজ দেশব্যাপী লাখ লাখ ওআরএসের প্যাকেট বিক্রি হওয়ার কারণও এই জনসচেতনতা।


এক চিমটি লবণ, এক মুঠ গুড় ও আধা সের পানি, স্যালাইন তৈরিতে এই ফর্মূলার সাফল্য নিয়ে টাইম সাময়িকী ২০০৬ সালের ১৬ অক্টোবর প্রচ্ছদ প্রতিবেদন ছাপে।

বাংলাদেশের গর্ব ওরস্যালাইনের আবিস্কারক ডা. রফিকুল ইসলাম ১৯৩৬ সালে কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে জন্মগ্রহন করেন। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে ইংল্যান্ড থেকে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ঔষুধ (Tropical medicine) এবং স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেন তিনি। পরে আইসিডিডিআরবিতে যোগ দেন ১৯৬০ সালে এবং ২০০০ সালে সেখান থেকে অবসরে যান।

আইসিডিডিআরবিতে তিনি ওষুধ নিয়ে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা চালালেও তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ওআরএস।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থী শিবিরগুলোতে একবার কলেরা ছড়িয়ে পড়েছিল। তখন এর একমাত্র চিকিৎসা ছিলো শিরায় দেওয়া স্যালাইন (ইন্ট্রাভেনাস)। কিন্তু এ ধরনের স্যালাইনের সরবরাহ কম থাকায় খাবার স্যালাইন দিয়ে অনেকের প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল।

এরপর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা খাবার স্যালাইনকে স্বীকৃতি দেয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ডায়রিয়ার চিকিৎসায় স্যালাইনের ব্যবহার নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়। এ কারণে এটি ‘ঢাকা স্যালাইন’ নামেও পরিচিতি পেয়েছিল।

ডা. রফিকুল আইসিডিডিআরবিতে থাকাকালীন সময়ে বেশ কিছু ওষুধ আবিষ্কার করেন, যার মধ্যে ওরস্যালাইন অন্যতম। যেটা আমরা সবাই হয়তো জানি, আধা লিটার পানিতে এক মুঠো চিনি বা গুড় এবং তিন আঙ্গুলের এক চিমটি লবণের মিশ্রণ। ব্যাস! ঘরে বসে ডায়রিয়ার পানিশূণ্যতা দূরীকরণের অতি সহজ উপায় তৈরি হয়ে গেল। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পশ্চিমবঙ্গে অনেক বাংলাদেশি শরণার্থী কলেরা রোগে আক্রান্ত হলে ঐ রোগীদের বাঁচাতে এই স্যালাইন পদ্ধতি প্রয়োগ করেন তিনি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১৯৮০ সালে ডা. রফিকুল ইসলামের এই আবিষ্কারকে স্বীকৃতি দেয়। পরবর্তীতে এনজিও ব্র্যাক এই ওরস্যালাইনকে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেয়ার কাজটি করে। ডায়রিয়ার হাত থেকে বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ শিশুর জীবন বাঁচানোর কৃতিত্ব পায়

কিছু কিছু পুরষ্কার দিতে পারলে পুরষ্কার দাতারই গৌরব বাড়ে। যদি বৈশ্বিক ক্ষেত্রে  ডা. রফিকুল এর অবদান বিবেচনায় নিয়ে তাকে  শান্তিতে নোবেল দিতে পারতো, তাহলে নোবেল ফাউনডেশন নিজেই ধন্য হত।

রফিকুল ইসলাম ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে হৃদরোগে আক্রান্ত হন এবং বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। ২০১৮ সালের ৬ মার্চ তিনি রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *