ড. ইউনূস কী আসলেই শ্রমিকদের ঠকিয়েছেন?

:: নাজমুল আহসান ::

নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস শ্রমিকদের ঠকিয়েছেন। কীভাবে ঠকিয়েছেন? তিনি শ্রমিকদের লভ্যাংশ দেন নাই।

শ্রমিকদের “লভ্যাংশ” নিয়ে কোনো আইডিয়া আছে রে, বেকুবের দল? এই লভ্যাংশ মানে প্রভিডেন্ট ফান্ড বা রিটায়ারমেন্ট ফান্ড না। এই লভ্যাংশ হলো কোম্পানির প্রফিট শেয়ারিং। অর্থাৎ, একটা কোম্পানির যত প্রফিট হয়, তাঁর ৫ শতাংশ কোম্পানির সকল কর্মীর মধ্যে বিভিন্ন ভাবে বিতরণ করার একটা প্রোগ্রেসিভ ল’ বাংলাদেশে আছে। এই ল’ পৃথিবীর কোন কোন দেশে আছে — আমি জানি না। আমেরিকাতে যে নাই, এটা নিয়ে আমি একশত ভাগ নিশ্চিত। প্রফিট শেয়ারিং-এর ধারণা উন্নত বিশ্বের গুটিকয়েক কোম্পানিতে নিজ উদ্যোগে প্রচলিত আছে; অনেক বুদ্ধিজীবী একে বৈষম্য নিরোধনের উপায় হিসেবে তুলে ধরছেন ইদানীং; কিন্তু পৃথিবীর খুব কম দেশই আইন করে প্রফিট-শেয়ারিং-এর বিধান রেখেছে।

এবং বাংলাদেশের অনেক “ভালো” আইনের মতো, এই আইনও কাগজে আছে, কিন্তু বাস্তবে খুব কমই অনুসৃত হয়।

বাংলাদেশে কিছু বিদেশী কোম্পানি, বিদেশী-বিনিয়োগের ফার্মা কোম্পানি, কিছু ব্যাংকে (সব বছরই নয়) কর্মীদের “প্রফিট বোনাস” হিসেবে লাম্পসাম একটা টাকা দেয়া হয় বলে অনেকে কমেন্টে লিখেছেন। অ্যানিওয়েজ, আমি আমার জীবনে বাংলাদেশে ৩টা বহুলপরিচিত কোম্পানিতে কাজ করেছি। আমার সঙ্গে এদের কেউই ১ পয়সা প্রফিট শেয়ার করেনি; আমার জানামতে কোনো এমপ্লয়ীর সঙ্গেই কেউ করেনি, করেও না।

কিন্তু ইউনূসকে করতেই হবে। কারণ, ইউনূস মঙ্গল গ্রহ থেকে এসেছেন — সুতরাং এই গ্রহের কারও বেলায় ওই নিয়ম প্রযোজ্য না হলেও, তাঁর বেলায় হবে!

এখন এখানে মজার বিষয় হলো, যেই কোম্পানির বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনা হয়েছে, সেই কোম্পানি হলো একটা নন-প্রফিট কোম্পানি। নাম হলো গ্রামীন টেলিকম। এই কোম্পানির মালিক ইউনূস নন; তিনি কোম্পানির বোর্ডের চেয়ারম্যান। আইনগতভাবেই নন-প্রফিট বা অলাভজনক কোম্পানির কেউ মালিক হতে পারেন না।

এখানে আয়রনিক ঘটনা হলো, ওই ঘটনার পর ইউনূসের বিরুদ্ধে দুর্নীতি কমিশন মানি-লন্ডারিং-এর অভিযোগ আনে। লেবার ল’ অনুযায়ী, ৫ শতাংশ লভ্যাংশের একটা অংশ কর্মীদের ফান্ডে রাখতে হয়, একটা অংশ সরকারি ফান্ডে রাখতে হয়, বাকিটা কর্মীদের দিতে হয়। তো এই ৪৩৭ কোটি টাকার একটা অংশ, ২৬ কোটি টাকা, কর্মীদের ফান্ড অর্থাৎ ইউনিয়নের ফান্ডে যায়৷ এই টাকাকে আপনারা বলেছেন ইউনিয়নকে দেওয়া ঘুষ। আর দুদক বলেছে মানি লন্ডারিং! অর্থাৎ, ইউনূস শ্রমিকের হক “পরিশোধ” করার পর সেটা হলো পাচার! একেবারে দো-ধারি তলোয়ার!

কিন্তু কোম্পানির মালিক ইউনূস না হলেও, কর্মীদের সঙ্গে লভ্যাংশ শেয়ার না করার অভিযোগ উঠে ইউনূসের বিরুদ্ধে; গ্রামীণ টেলিকমের বিরুদ্ধে নয়।

এটা নিয়ে গ্রামীন টেলিকম ও কোম্পানির কর্মীদের মধ্যে একটা বিরোধ দেখা দেয়। কারণ হলো গ্রামীন টেলিকম সেই শুরুর দিকে গ্রামীনফোনের ৩৪% শেয়ারের মালিক। আর সেই সূত্রে নব্বইয়ের দশক থেকে জমতে জমতে তাদের মোট রেভিনিউ এখন প্রায় ১-২ বিলিয়ন ডলারের সমান; বাংলাদেশি অর্থে এখন ১০-২০ হাজার কোটি টাকা। বিরাট অংকের টাকা! এই টাকা শুধুমাত্র দাতব্য খাতে ব্যয় করার বিধান রেখেই গ্রামীন টেলিকম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ইউনূস কী বোকা দেখেন! সেই ইউরোপ থেকে ফান্ড এনে গ্রামীনফোনে বিনিয়োগ করিয়েছিলেন। কিন্তু মালিকানা দিয়েছেন একটা নন-প্রফিটকে। নিজের বা নিজের পরিবারের নামে মালিকানা রাখেন নাই।

কিন্তু গ্রামীন টেলিকমের নিজস্ব কোনো প্রোডাকশন বা ইউটিলিটি নাই। নব্বইয়ের দশকে তারা গ্রামেগঞ্জে সস্তায় নোকিয়া ফোন ডিস্ট্রিবিউট করার জন্য ৩০০ কর্মী নিয়োগ দিয়েছিল। কিন্তু এরপর তো সবার হাতে হাতে ফোন চলে আসলো, ওই ব্যবসাও আর রইলো না। এরপর থেকে তাদের কর্মীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৬০ জন। যারা শুধু অফিস পরিচালনার কাজ কর্মই করতেন — যেহেতু কোম্পানির সমস্ত আয় ছিল গ্রামীনফোনের ডিভিডেন্ড থেকে।

এখন ১-২ বিলিয়ন ডলার কোম্পানির এমপ্লয়ী মাত্র ৬০ জন বা সাবেক শ’ খানেক; আর এরাই চাইলেন ৫% প্রফিট। আপনি মঙ্গলগ্রহের আইন বাদ দেন। একেবারে কমনসেন্স খাটায়ে বলেন যে একটা ১-২ বিলিয়ন ডলারের কোম্পানি, যাদের কোনো নিজস্ব প্রোডাক্ট বা সার্ভিস নাই, যাদের সমস্ত প্রফিট আসে আরেক কোম্পানির শেয়ার থেকে প্রাপ্ত ডিভিডেন্ড থেকে, সেই কোম্পানির এত বড় ডিভিডেন্ডের অঙ্ক কি গুটিকয়েক কর্মচারি ডিজার্ভ করেন? ইউটোপিয়ায় হয়তো করে থাকতে পারেন।

এমপ্লয়ীরা যখন ওই টাকা চাইলেন, কোম্পানির লইয়াররা বললেন, এই টাকা দেওয়া যাবে না; কারণ নন-প্রফিট কোম্পানি হিসেবে কোম্পানির লাভের অঙ্ক কাউকে দেওয়া যাবে না। আইনে বলা আছে, শুধু দাতব্য কাজেই এই অর্থ ব্যয় করা যাবে। ইফ ইউ আস্ক মি, দ্যাট’স অ্যা ভেরি লেজিটিমেট লিগ্যাল পজিশন। অর্থাৎ, গ্রামীন টেলিকমের কর্মচারিরাই বরং কোম্পানির দাতব্য কাজের সুবিধাভোগীদের হক মারতে চাইছেন।

কিন্তু এমপ্লয়িরা গোস্বা করলেন — মামলা করার উদ্যোগ নিলেন। একেবারে ক্ল্যাসিক কোম্পানি ভার্সাস এমপ্লয়ী কেইস। ইউনূসের এত রাজনৈতিক চাপ সত্ত্বেও তিনি আইনি পথে বিষয়টা মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিলেন। অথচ, তিনি চালাক হলে তখনই ৫-১০ কোটি টাকা দিয়ে বিষয়টা মিটমাট করে ফেলতে পারতেন। বিষয়টা এতদূর আসতে দিতেন না।

মামলা হলো। সরকারের লেবার পরিদর্শকরাও মামলা করলেন।

গ্রামীণ টেলিকমের আইনজীবীদের আরেকটা শক্ত যুক্তি ছিল, গ্রামীনফোনের শেয়ার থেকে যেই ডিভিডেন্ড গ্রামীন টেলিকম পেয়েছে, সেটা তো টেলিকমের কর্মীদের হক নয়; সেটা হলো গ্রামীনফোন কর্মীদের হক। কেউ যদি ওই অর্থ প্রাপ্য হন, সেটা হবেন গ্রামীনফোনের কর্মীরা; টেলিকমের নয়।

এমপ্লয়ীরা জানতেন, তারা হেরে যাবেন দুই যুক্তিতে। তারপর তারা একটা শয়তানির আশ্রয় নিলেন। তারা কোম্পানি আদালতে মামলা করলেন যে, যেহেতু গ্রামীণ টেলিকমের সস্তায় নোকিয়া ফোন বিক্রয়ের প্রকল্প আর নাই, তাহলে কোম্পানি হিসেবে গ্রামীন টেলিকমের আর উপযোগিতা নাই; ফলে একে বিলুপ্ত করে দেওয়া হোক। এবং, কোম্পানি কোর্ট সেই যুক্তি আমলে নেয়।

অর্থাত, আপনার আদরের “শ্রমিকরা” সিদ্ধান্ত নিলেন আমরা যেহেতু ফল খাইতে পারুম না, ফলে পুরা ফলগাছ কাইটা ফেলবো!

এইখানে তারা আর কী পাবে আর না পাবে, সেটার প্রশ্ন নাই। তারা জানে ইউনূস চাপে আছে; অতএব আরও চাপ কেমনে দেওয়া যায়! একেবারে আদর্শ ”শ্রমিক“ যাদের বলে আরকি।

এই ঘটনার পর গ্রামীন টেলিকম বুঝে যায় আইনি পথে তাদের জয়ের সম্ভাবনা নাই। কোম্পানির অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি। তখন তারা ইউনিয়নের সঙ্গে দরকষাকষিতে বসেন। এবং, সমঝোতা অনুযায়ী গ্রামীন টেলিকমের লইয়াররা শ কয়েক কর্মীকে ৪৩৬ কোটি টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত দেয়। প্রত্যেক কর্মীর ভাগে প্রায় ১-২ কোটি টাকা করে পড়েছে!

আপনার সারাজীবনের চাকরির বেতন ২ কোটি টাকা হবে তো? ৫% প্রফিট থেকে ২ কোটি তো দূরে থাক। এই হলো আপনার শ্রমিকের “হক” যেইটা গ্রামীন টেলিকমের কর্মচারীরা প্রাপ্য না হয়েও পেয়েছে; যেইটা আপনি আপনার প্রাপ্য শ্রমিককে দেওয়ার কথা কল্পনাও করতে পারেন না; আর যেইটা আপনি নিজেও কখনও পাওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না।

সমঝোতা হওয়ার পর, একটা যৌথ অ্যাকাউন্টে টাকাটা সাথে সাথে ডিসবার্স করে দেওয়া হয়। আদালত থেকে এই সেটেলমেন্ট অ্যাপ্রুভ করা হয়। মামলা ডিসমিস! আমি এমনও শুনেছি যে, কর্মীরা ওই টাকা বুঝে পাওয়ার সাথে সাথেই দুয়েকটা করে অ্যাপার্টমেন্ট কিনে ফেলেন!

এদিকে তখন সরকারের টনক নড়ে! আরে পাখি তো খাঁচা ছাইড়া যাইতাছে গা! এতদিন পর্দার আড়ালে খেললেও, সরকার একেবারে নগ্ন হয়ে উঠে।

যেই শ্রমিকদের হক নিয়ে সরকারের এত হাহাকার, সেই সরকার ঘোস্বা করলো কেন তারা কোটি কোটি টাকা নিয়ে সন্তুষ্ট হইলো! তারা কেন মামলা অব্যাহত রেখে সরকারের গুটিতে পরিণত হইলো না!

এদিকে পত্রিকায় খবর আসে যে ইউনূস নাকি ঘুষ দিয়া মামলা দফারফা করাইছেন! অর্থাৎ, যেই “হক” ইউনূস তাঁর শ্রমিকদের দেন নাই বলে আপনি চিৎকার করতেছেন, সেই “হক” রাতারাতি হয়ে গেল “ঘুষ”। আপনাদের ন্যারেটিভ নির্মানের দক্ষতা দেখে আপনাদেরই গর্ব হওয়া উচিৎ!

খুব দ্রুতই ডিবি থেকে কর্মীদের নেতা দুইজনকে গুম করা হয়। তাদেরকে টর্চার করা হয়েছে, এমন অভিযোগও আমরা শুনেছি। কর্মীদের যেই লইয়ার তাদেরকে ৪৩৭ কোটি টাকার সেটেলমেন্ট পাইয়ে দিলেন, সেই লইয়ারও নাকি ঘুষ পাইছেন! অথচ, সেই লইয়ার তাঁর পূর্বচুক্তি অনুযায়ী সেটেলমেন্টের একটা অংশ পেয়েছে মাত্র। একেবারে আইনগত নথিপত্র অনুযায়ী হওয়া ও সর্বোচ্চ আদালত অনুমোদিত একটি বৈধ সেটেলমেন্ট রাতারাতি হয়ে গেল ঘুষ!

এই হলো মঙ্গলগ্রহের আইন আর বিধান!

আরও আইন-কানুনের গল্প শুনবেন?

যেই হাইকোর্ট সেটেলমেন্ট অ্যাপ্রুভ করলো, সেই হাইকোর্টই ক’ দিন বাদে সেই সেটেলমেন্ট বাতিল করলো! খুবই স্বাধীন কোর্ট আপনাদের! ডিসমিস হয়ে যাওয়া মামলা পুনরায় চালু হলো; গুম হওয়া শ্রমিক নেতা বের হয়ে এসে “স্বীকারোক্তি” দিলেন ইউনূসের বিরুদ্ধে; আরও ডজন খানেক মামলা যোগ হলো রাতারাতি! সেইটা চলতে থাকলো বছরের পর বছর।

এখানে আয়রনিক ঘটনা হলো, ওই ঘটনার পর ইউনূসের বিরুদ্ধে দুর্নীতি কমিশন মানি-লন্ডারিং-এর অভিযোগ আনে। লেবার ল’ অনুযায়ী, ৫ শতাংশ লাভ্যাংশের একটা অংশ কর্মীদের ফান্ডে রাখতে হয়, একটা অংশ সরকারি ফান্ডে রাখতে হয়, বাকিটা কর্মীদের দিতে হয়। তো এই ৪৩৭ কোটি টাকার একটা অংশ, ২৬ কোটি টাকা, কর্মীদের ফান্ড অর্থাৎ ইউনিয়নের ফান্ডে যায়৷ এই টাকাকে আপনারা বলেছেন ইউনিয়নকে দেওয়া ঘুষ। আর দুদক বলেছে মানি লন্ডারিং! অর্থাৎ, ইউনূস শ্রমিকের হক “পরিশোধ” করার পর সেটা হলো পাচার! একেবারে দো-ধারি তলোয়ার!

২০২১ সালের দিকে ইউনূসের সঙ্গে আমার প্রথম ও শেষবারের মতো আলাপ হয়। ওই সময় পর্যন্ত তাকে দেখে মনে হয়েছে তিনি সেটেলমেন্ট আর পরিস্থিতি নিয়ে খুবই সন্তুষ্ট। তিনি আইনি পথেই হাঁটতে চান। আমি আর আমার আরেক সাংবাদিক সহকর্মী বিষয়টা নিয়ে খুবই বিস্মিত হয়েছিলাম।

তো পরিস্থিতি এরপর থেকে এতই বাজে দিকে গেছে যে ইউনূসের মতো চরম অপ্টিমিস্টিক মানুষও ফিল করতেছেন যে, তাকে এবার গ্রেফতারই করা হবে! অথবা, তাঁর মিত্ররা পুরো বিষয়টা টেকওভার করেছেন। তারা বুঝেছেন যে, বিষয়টা ইউনূসের অপ্টিমিজমের উপর ছেড়ে রাখলে, ইট উইল বি টু লেইট।

এরপর বারাক ওবামা থেকে শুরু করে বিশ্বের বেশিরভাগ জীবিত নোবেল পুরষ্কারজয়ী যখন বিবৃতি দেওয়া শুরু করলেন যে ইউনূসের বিরুদ্ধে বিচারিক হয়রানি চলছে, তখন আপনি গোস্বা করলেন! আপনাদের সাধের সোহাগা বিচার বিভাগ নিয়ে এত বড় কথা!

ওয়াশিংটন ডিসি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে

লেখক: ইংরেজি সম্পাদক, বেনার নিউজ

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *