থেমে গেল ‘ফেড এক্সপ্রেস’

:: নাগরিক প্রতিবেদন ::

বিদায় বললেন ‘ফেড এক্সপ্রেস’। হয়ত এটাই ঠিক সময় মনে করেছেন। রজার ফেদেরার শীর্ষ পর্যায়ের টেনিস ছাড়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

চলতি মাসের শেষে লন্ডনে অনুষ্ঠিত লেভার কাপের পরে জুতো জোড়া ও টেনিস ব্যাট তুলে রাখবেন ২০ বারের একক গ্রান্ডস্লাম জয়ী এই ৪১ বছর বয়সী তারকা।

২০২১ সালের উইম্বলডনের পরে আর মাঠে নামেননি ফেদেরার। তৃতীয়বার হাঁটুর অস্ত্রোপচার করিয়েছেন তিনি। সুস্থ হয়ে ফিরলেও বুঝে গেছেন শরীর আর চালিয়ে যাওয়ার বার্তা দিচ্ছে না। ২৪ বছরের ক্যারিয়ারে তাই ইতি টানার ঘোষণা দিলেন তিনি।

ফেদেরার বলেছেন, ‘আমার প্রতি আমার শরীরের বার্তাটা পরিষ্কার। ২৪ বছরের ক্যারিয়ারে ১৫শ’র বেশি ম্যাচ খেলেছি। এখন আমার স্বীকার করতে হবে যে, প্রতিযোগিতামূলক ক্যারিয়ার শেষ করার সময় চলে এসেছে। তবে বলতেই হবে, টেনিস আমি তোমাকে ভালোবেসেছি এবং কখনও ছেড়ে যাবো না।’

সুইস তারকা ফেদেরার ১৯৯৮ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে পেশাদার টেনিস ক্যারিয়ার শুরু করেন। ২০০৩ সালে তিনি প্রথম গ্রান্ডস্লাম জয় করেন। তার চেয়ে একক গ্রান্ডস্লাম বেশি কেবল স্পেনের রাফায়েল নাদাল (২২) ও সার্ভিয়ার নোভাক জকোভিচের (২১)।

ফেদেরার ২০০৪ সালে বিশ্বের সেরা টেনিস তারকা হন। ৩১০ সপ্তাহ তিনি বিশ্বের সেরা টেনিস তারকা হিসেবে রাজত্ব করেছেন। ২০১৮ সালে তিনি তার শেষ গ্রান্ডস্লাম জিতেছেন। তখন তার বয়স ৩৬। বিশ্বের দ্বিতীয় বয়স্ক টেনিস তারকা হিসেবে ওই শিরোপা জেতেনে তিনি। ইনজুরি বাধা না হয়ে দাঁড়ালে কে জানে নাদাল-রজারকে হয়তো ছাড়িয়ে যেতেন তিনি। 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও ও লিখিত বার্তায় বিদায়ের ঘোষণা দেন ফেদেরার।

সুইস মহাতারকা সেই বার্তার পুরোটা পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

টেনিস পরিবার ও অন্যরা,

বছরের পর বছর ধরে টেনিস আমাকে যত উপহার দিয়েছে, কোনো সন্দেহ ছাড়াই তার মধ্যে সবচেয়ে মহৎ হচ্ছে সেই মানুষেরা, যাঁদের আমি এ যাত্রায় পেয়েছি। আমার বন্ধু, প্রতিপক্ষ এবং সর্বোপরি সেই ভক্তরা, যাঁরা খেলাটিকে জীবন্ত করে তুলেছেন। আজ আমি আপনাদের কিছু সংবাদ দিতে চাই।

অনেকেই জানেন, চোট ও অস্ত্রোপচারের কারণে তিন বছর ধরে আমি কতটা ভুগেছি। পূর্ণশক্তিতে প্রতিযোগিতামূলক লড়াইয়ে ফিরতে কঠোর পরিশ্রম করেছি। তবে আমার শরীরের সামর্থ্য ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানি আমি। এখন তার বার্তাটা আমার কাছে পরিষ্কার। আমার বয়স এখন ৪১ বছর। ২৪ বছরে আমি ১ হাজার ৫০০-এর বেশি ম্যাচ খেলেছি। টেনিস যে আমার প্রতি এত উদারতা দেখাবে, আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি।

এখন আমাকে প্রতিযোগিতামূলক টেনিসকে বিদায় বলার সময়টাকেও মেনে নিতে হবে। আগামী সপ্তাহে লন্ডনে শুরু হতে যাওয়া লেভার কাপ আমার শেষ এটিপি ইভেন্ট। অবশ্যই ভবিষ্যতে আমি আরও টেনিস খেলব। তবে সেটা গ্র্যান্ড স্লাম কিংবা কোনো ট্যুরে নয়।

এ সিদ্ধান্ত অম্লমধুর। ট্যুরগুলো আমাকে যা দিয়েছে, সবটাই আমি মিস করব। তবে একই সঙ্গে উদ্‌যাপন করার মতোও অনেক কিছু আছে। আমি নিজেকে পৃথিবীতে একজন ভাগ্যবান মানুষ বলেই মনে করি। আমাকে টেনিস খেলার বিশেষ প্রতিভা দেওয়া হয়েছে এবং আমি সেটা এমন পর্যায়ে খেলেছি, যা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। এতটা সময় ধরে খেলেছি, যা সম্ভব হবে বলে আমি কখনো ভাবিনি।

আমি বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাতে চাই আমার স্ত্রী মিরকাকে। যে প্রতিটি মুহূর্ত আমার সঙ্গে যাপন করেছে। ফাইনালের আগে সে আমাকে উজ্জীবিত করেছে। সে অগণিত ম্যাচ দেখেছে, এমনকি যখন সে ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা তখনো। ২০ বছরের বেশি সময় ধরে দলের সঙ্গে থেকে আমার পাগলামি সহ্য করেছে।

আমাকে সমর্থনের জন্য আমি চার অপূর্ব সন্তানকেও ধন্যবাদ জানাতে চাই, যারা নতুন একটি জায়গাকে আবিষ্কার করা এবং চলার পথে সুন্দর সব স্মৃতি তৈরিতে সব সময় উন্মুখ ছিল। আমাকে উৎসাহ দিতে নিজের পরিবারকে স্ট্যান্ডে দেখা এমন কিছু, যা সব সময় ভেতরে ধরে রাখব।

আমি আমার ভালোবাসার মা-বাবা এবং স্নেহের বোনকেও ধন্যবাদ দিতে চাই এবং তাদের কথা বলতে চাই। তাদের ছাড়া কোনো কিছুই সম্ভব হতো না। একটি বড় ধন্যবাদ আমার সব সাবেক কোচদের, যাঁরা সব সময় আমাকে সঠিক পথে চলতে সহায়তা করেছেন…আপনারা অসাধারণ! সুইস টেনিসকেও (ধন্যবাদ), যারা কৈশোরে আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছিল এবং আমাকে আদর্শ শুরু এনে দিয়েছিল।

আমি আমার অসাধারণ দলটিকে ধন্যবাদ দিতে চাই, তাদের অবদানের কথা উল্লেখ করতে চাই। ইভান, দানি, রোলান্ড, বিশেষভাবে স্টিভ ও পিয়েরে, যারা আমাকে সেরা পরামর্শটিই দিয়েছে এবং সব সময় আমার পাশে ছিল। সঙ্গে টনির কথাও বলতে চাই, যিনি দারুণভাবে ১৭ বছরের বেশি সময় ধরে আমার ব্যবসা দেখভাল করছেন। আপনারা সবাই অবিশ্বাস্য এবং আপনাদের সঙ্গে প্রতিটি মিনিট আমি উপভোগ করেছি।

আমার বিশ্বস্ত পৃষ্ঠপোষকদেরও ধন্যবাদ, যারা সত্যিই আমার অংশীদারের মতো। আর এটিপি ট্যুরের পরিশ্রমী দল ও টুর্নামেন্ট কর্তৃপক্ষকেও, যারা নিয়মিত আমাদের সবাইকে আন্তরিকভাবে ও আতিথেয়তার সঙ্গে স্বাগত জানিয়েছে।

ধন্যবাদ আমার কোর্টের প্রতিদ্বন্দ্বীদেরও। আমি সৌভাগ্যবান, মহাকাব্যিক কিছু ম্যাচ খেলতে পেরেছি, যা কখনো ভুলব না। আমরা ন্যায্যভাবে, আবেগ দিয়ে এবং তীব্রভাবে লড়েছি। আমি সব সময় আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি খেলাটির ইতিহাসকে শ্রদ্ধা করতে। আমি খুবই কৃতজ্ঞ অনুভব করছি। আমরা একে অপরকে তাড়িত করেছি এবং একসঙ্গে টেনিসকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছি।

সবকিছুর ঊর্ধ্বে আমি বিশেষ ধন্যবাদ জানাতে চাই আসলে আমার অবিশ্বাস্য ভক্তদের। আপনারা জানেন না, কী পরিমাণ শক্তি ও বিশ্বাস আপনারা আমাকে দিয়েছেন। পূর্ণ স্টেডিয়াম ও অ্যারেনার মধ্য দিয়ে হেঁটে আসার প্রেরণা আমার জীবনের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর বিষয়গুলোর একটি ছিল। আপনারা না থাকলে সফলতাগুলো আনন্দ ও শক্তিতে পূর্ণ হওয়ার বদলে বড্ড নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ত।

গত ২৪ বছর ট্যুরগুলো ছিল অবিশ্বাস্য এক অভিযাত্রা। কখনো এটি মনে হয়েছে ২৪ ঘণ্টার মতো। আবার এ যাত্রা এত গভীর ও জাদুকরি ছিল যে মনে হয়েছে আমি আমার পুরো জীবনটাই যাপন করে ফেলেছি। আমি দারুণ সৌভাগ্যবান—আপনাদের সামনে আমি ৪০টির বেশি দেশে খেলতে পেরেছি। আমি কখনো হেসেছি, কখনো কেঁদেছি। আনন্দ ও বেদনা অনুভব করেছি।

তবে সবচেয়ে বেশি আমি অবিশ্বাস্যভাবে নিজেকে জীবন্ত অনুভব করেছি। এ যাত্রায় আমি অনেক অসাধারণ সব মানুষের দেখা পেয়েছি, যাঁদের সঙ্গে আমার আজীবনের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠেছে। তাঁরা ধারাবাহিকভাবে তাঁদের ব্যস্ত সূচি থেকে সময় বের করে আমার খেলা দেখতে এসেছেন এবং বিশ্বব্যাপী আমার জন্য উল্লাস করেছেন। আপনাদের ধন্যবাদ।

টেনিসের প্রতি আমার যখন ভালোবাসার সৃষ্টি হয়, তখন আমি বাসেলে নিজ শহরের একজন ‘বল কিড’। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে খেলোয়াড়দের দেখতাম। তারা আমার জন্য বিশাল ব্যাপার ছিল এবং আমিও স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। আমার স্বপ্ন আমাকে কঠিন পরিশ্রমের দিকে চালিত করেছে এবং আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে শুরু করি। কিছু সফলতা আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস নিয়ে আসে এবং এরপর আমি আমার সবচেয়ে অসাধারণ যাত্রাটির পথে ছিলাম, যা আমাকে আজকের দিনে নিয়ে এসেছে।

তাই আমি আপনাদের সবাইকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, বিশ্বব্যাপী সব মানুষকে যারা একজন সুইস বল কিডের স্বপ্নকে সত্যি হতে সাহায্য করেছে।

সবশেষে টেনিস, আমি তোমাকে ভালোবাসি এবং তোমাকে ছেড়ে কখনো যাব না।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *