নতুন শিক্ষাক্রম শিক্ষাব্যবস্থাকে শোচনীয় করতে পারে

:: ফয়েজ আহমদ তৈয়ব ::

নতুন শিক্ষাপদ্ধতি গ্রহণের সঙ্গে যুক্তদের কেউ কেউ সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, এর মাধ্যমে নাকি কোচিং-বাণিজ্য বন্ধ হবে। বাস্তবে এর উল্টো ঘটনা ঘটবে বলে মনে হয়। দৈনন্দিন ধারাবাহিক মূল্যায়ন ও ‘এক্সপেরিমেন্টাল লার্নিং’-এর জন্য শিক্ষক শ্রেণিশিক্ষা দেওয়ার সময় একেবারেই কম পাবেন, ধারাবাহিক মূল্যায়ন, ‘এক্সপেরিমেন্টাল লার্নিং’-এর কাজ, অ্যাডমিনিস্ট্রেশনসহ অপরাপর ডকুমেন্টেশন তৈরি এবং বাড়তি ব্যবস্থাপনার কাজে শ্রেণিশিক্ষার সময়টা ব্যয় হবে। এতে শিক্ষকের পক্ষে বিশাল ছাত্রসংখ্যার শিক্ষার্থীর একাডেমিক চাহিদার পেছনে সময় দেওয়া, জটিল বিষয়াদি বোঝানোর সময় দেওয়া সম্ভব হবে না।

শিক্ষকদের সংখ্যা না বাড়িয়ে, তাঁদের বেতনকাঠামো ঠিক না করে, সুযোগ-সুবিধার চাহিদাকে বিবেচনায় না নিয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়নের বাড়তি দায়িত্ব দেওয়ায় নতুন যে ব্যবস্থা আনা হয়েছে, সেটা হিতে বিপরীত হতে পারে। ৫০ শতাংশ নম্বরের মূল্যায়ন শিক্ষকের ওপর দেওয়া হয়েছে। ফলে যারা শিক্ষকের কাছে কোচিং ও প্রাইভেট ক্লাস করবে, তাদের এই মূল্যায়নের নম্বর বেশি হওয়ার প্রবণতা তৈরি হবে। এতে গরিব শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ব্যয় বাড়বে, অপারগ হলে বাড়তে পারে স্কুল থেকে ঝরে পড়াও।

আমাদের বাংলা মাধ্যমের স্কুলশিক্ষার প্রতিষ্ঠিত পথটি ব্যর্থ হতে যাচ্ছে, এটা হতাশার। ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছেই, যেমন জিপিএ গ্রেডিং সিস্টেমে পরিবর্তন, প্রাইমারি-নিম্নমাধ্যমিকে পাবলিক পরীক্ষা একবার ঢোকানো আবার বন্ধ করা, সৃজনশীল ঢুকিয়ে পরে বন্ধ করা, শিক্ষক প্রস্তুত না করেই সৃজনশীল সিলেবাস ঢোকানো। বিশেষ দলের বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতায় যুক্ত দু-চারজন লেখক দিয়েই গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, উচ্চতর গণিত ও জীববিজ্ঞানের সব বই লেখানো। এসএসসিতে অটো পাস, আবার এসএসসি বন্ধের উদ্যোগ, এইচএসসিতে অটো পাস, সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা, সহজ প্রশ্ন, বেশি পাস দেখাতে উদার মূল্যায়ন—এসবের পাশাপাশি প্রশ্ন ফাঁসের মতো ধারাবাহিক জঞ্জাল তো আছেই! এসব কারণে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার বারোটা বেজে গেছে। এ শিক্ষা শিক্ষিত বেকার ছাড়া কিছুই দিচ্ছে না। নতুন শিক্ষাক্রম এই পরিস্থিতিকে আরও শোচনীয় করতে পারে।

ঘুষের বিনিময়ে ধারাবাহিক ও শিক্ষক মূল্যায়নের নম্বরের বিনিময় হওয়ার ঘটনা ঠেকানো কঠিন হবে। অর্থের বিনিময়ে বিশেষ কোচিং সেন্টারে ভর্তি হওয়া ছাত্রছাত্রীদের নম্বর বাড়িয়ে দেওয়ার আশঙ্কাও থাকবে এ শিক্ষাপদ্ধতিতে। দিন শেষে শুধু কোচিং সেন্টারের ব্যবসাকেই রমরমা করবে না, বরং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনৈতিক লেনদেনের একটি বিধিবদ্ধ ব্যবস্থাও তৈরি হতে পারে।

শিক্ষকের সংখ্যা না বাড়িয়ে, মূল্যায়নের সফটওয়্যারভিত্তিক অবকাঠামো তৈরি না করে, মাথাপিছু কম্পিউটার বরাদ্দ না করে এবং শ্রেণি-শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৫ বা ৩০-এ না নামিয়ে বিদেশি কারিকুলামের নামে যে ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেই ব্যবস্থা বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। বিদেশে ২০-২৫ জনের শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন মূল শিক্ষক ও একজন শিক্ষানবিশ শিক্ষক থাকেন। আর তাঁরা প্রাইমারি স্কুলের প্রায় সব কটি বিষয় পড়ান। ফলে শিক্ষার্থীর বিকাশ নিয়ে শিক্ষকের সার্বিক মূল্যায়নের ব্যাকগ্রাউন্ড তৈরি হয়।

উন্নত বিশ্বে ধারাবাহিক শিক্ষক মূল্যায়ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেখানে বই আকারের প্রশ্নপত্রগুলো আঞ্চলিক শিক্ষা বোর্ড থেকে পাঠানো হয়। পরীক্ষার পর নম্বর সফটওয়্যারে ইনপুট দিয়ে উত্তরপত্র বোর্ড অফিসে ফেরত পাঠানো হয়, যা আবার দৈবচয়নের ভিত্তিতে নিরীক্ষায় পড়ে।

বাংলাদেশে শিক্ষক না বাড়িয়ে, শিক্ষকের শ্রমঘণ্টার হিসাব না করে, কারিগরি সফটওয়্যার ও কম্পিউটারভিত্তিক অবকাঠামোগত বন্দোবস্ত না করে ফিনল্যান্ডের কারিকুলামের কথা বলে একটা কারিকুলাম চালিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হলো।

‘এক্সপেরিমেন্টাল লার্নিং’য়ের কথা বলা হয়েছে, অথচ এর জন্য দরকার এক্সট্রা কারিকুলাম ডিজাইন এবং বিশেষ দক্ষ জনবল। এক্সপেরিমেন্টাল লার্নিংয়ের নাম করে আসলে একটা ‘আনটেস্টেড এক্সপেরিমেন্টাল কারিকুলাম’ কতটা কাজে দেবে?

আমাদের বাংলা মাধ্যমের স্কুলশিক্ষার প্রতিষ্ঠিত পথটি ব্যর্থ হতে যাচ্ছে, এটা হতাশার। ক্রমাগত পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছেই, যেমন জিপিএ গ্রেডিং সিস্টেমে পরিবর্তন, প্রাইমারি-নিম্নমাধ্যমিকে পাবলিক পরীক্ষা একবার ঢোকানো আবার বন্ধ করা, সৃজনশীল ঢুকিয়ে পরে বন্ধ করা, শিক্ষক প্রস্তুত না করেই সৃজনশীল সিলেবাস ঢোকানো। বিশেষ দলের বুদ্ধিবৃত্তিক তৎপরতায় যুক্ত দু-চারজন লেখক দিয়েই গণিত, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, উচ্চতর গণিত ও জীববিজ্ঞানের সব বই লেখানো। এসএসসিতে অটো পাস, আবার এসএসসি বন্ধের উদ্যোগ, এইচএসসিতে অটো পাস, সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা, সহজ প্রশ্ন, বেশি পাস দেখাতে উদার মূল্যায়ন—এসবের পাশাপাশি প্রশ্ন ফাঁসের মতো ধারাবাহিক জঞ্জাল তো আছেই!

এসব কারণে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার বারোটা বেজে গেছে। এ শিক্ষা শিক্ষিত বেকার ছাড়া কিছুই দিচ্ছে না। নতুন শিক্ষাক্রম এই পরিস্থিতিকে আরও শোচনীয় করতে পারে।

লেখক: টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক ও গবেষক

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *