বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর নারী গুপ্তচর

কুখ্যাত বা বিখ্যাত যাই বলা হোক না কেন, তিনি হলেন কুইন অব কিউবা নামে খ্যাত বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর নারী গুপ্তচর অ্যানা মন্তেস (Ana Montes)। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী অ্যানা মূলত পেন্টাগনের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার শীর্ষস্থানীয় বিশ্লেষক হিসেবে কাজ করতেন। অভিযোগ আছে তিনি ১৯৮৫ সাল থেকে ২০০১ সালের টুইন টাওয়ার হামলা পর্যন্ত যাবতীয় গোপন তথ্যাদি দলিলাকারে হাভানার কাছে হস্তান্তর করেছেন। এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চিত নয় যে, অ্যানা মন্তেস ঠিক কতটা ক্ষতি করেছে তাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার। এতবড় অপরাধ সত্ত্বেও মন্তেসের নাম খুব একটা বেশি মানুষ জানেন না। অথবা বলা ভালো, মন্তেসের নাম যুক্তরাষ্ট্রই তাদের নিজেদের স্বার্থে অনেকদিন পর্যন্ত প্রকাশ করেনি।

সাবেক মার্কিন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ ক্রিস সিমন্সের মতে, ‘কিউবা চাইলে যুক্তরাষ্ট্রের মতো সুপারপাওয়ারদের ক্ষতি করতে পারে। কিউবার মতো ছোটো একটি দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর ওই তথ্য গোপনে চীন, রাশিয়া, ইরান, ভেনেজুয়েলা এবং উত্তর কোরিয়ার কাছে বিক্রি করে।’ কিন্তু হঠাৎ করেই মন্তেস এমনটি করলেন কেন? জানা যায় মন্তেস অনেকদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন না এবং তার নিজের মানবীয় সম্পর্কের মাঝেও এই সমস্যা প্রকট আকার ধারন করেছিল। তখনই কিউবার পক্ষ থেকে তার বন্ধুদের কাছে ফিরে যাওয়া, পরিবারকে ফিরে পাওয়া এবং সবচেয়ে বড় নিজের দেশে ফিরে আসার আশ্বাস দেয়। অ্যানা মন্তেসের এই গুপ্তচরবৃত্তি এবং নথি পাচারের ফলে গোটা বিশ্বের এসপিওনাজ জগত একটা বিশাল ধাক্কা খায়। কারণ বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরেই এক লাখেরও বেশি বিদেশি গোয়েন্দা সদস্য বিভিন্ন স্থানে কাজ করছেন। আর এসব তথ্য প্রকাশ হয়ে যাওয়ায় অনেক দেশই সমস্যার মুখোমুখি হয়।

শীতল যুদ্ধ চলাকালীন সময়ের অনেক মেয়ের মতোই বেড়ে উঠেছিলেন মন্তেস। ১৯৫৭ সালে জার্মানিতে অবস্থিত মার্কিন সেনাব্যারাকে জন্ম হয় অ্যানার। সেখান থেকেই অ্যানা উচ্চ বিদ্যালয়ে যান এবং পরবর্তীতে উত্তর ওয়াশিংটনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে মন্তেসের পরিবার। সেখান থেকেই তিনি ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং এক বছর পড়ার পরই তিনি স্পেন চলে যান। আর সেখানেই তিনি পুয়েত্রো রিকান এক শিক্ষার্থী, যার নাম অ্যান কোলনের সঙ্গে পরিচিত হন। আর স্বাভাবিক ভাবেই এই দুই অ্যানা খুব জলদিই বন্ধু হয়ে যান। তাদের এই বন্ধুত্বের সূত্রপাত কোনো রাজনীতি নয়, স্রেফ শেকড়। কিন্তু তখন থেকেই অ্যানা মন্তেসের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী একটা স্পষ্ট মনোভাব লক্ষ্য করা যায়।

অ্যানা মন্তেসের মতে যুক্তরাষ্ট্র মধ্য এবং দক্ষিন আমেরিকার রাষ্ট্রগুলোর সরকারকে দিয়ে দেশগুলোর জনগণদের অত্যাচার করে আসছিল। আর সময়টাও এমন ছিল যে, খোদ যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ প্রজন্ম নিজ দেশের প্রশাসনের বিরুদ্ধেই বক্তব্য দিচ্ছিল। ১৯৮৪ সালের দিকে মন্তেস ওয়াশিংটনের জাস্টিস ডিপার্টমেন্টে দাপ্তরিক কাজে নিয়োজিত হন এবং পাশাপাশি জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি পড়ছিলেন। এফবিআই বিশেষজ্ঞ পিটি ল্যাপের মতে, ‘তখন থেকেই অ্যানা মনে করতো যে, যুক্তরাষ্ট্র চাইলেই অন্য কোনো দেশের উপর নিজের মতামত চাপিয়ে দিতে পারে না।’ ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন অবস্থাতেই তার কিউবার প্রতি আগ্রহ জন্মে এবং সেখান থেকেই একটা সময় কিউবার কেসগুলোর ব্যাপারে তার সাহায্য চাওয়া হয়। ওই একই সময়ে মন্তেস ডিফেন্স ইন্টিলিজেন্স এজেন্সিতে চাকরির জন্য দরখাস্ত করেছিলেন। মজার বিষয় হলো, ১৯৮৫ সালে তিনি মার্কিন গোয়েন্দা বাহিনীতে যোগদান করেন। কিন্তু মার্কিন গোয়েন্দা পিটির মতে, মার্কিন গোয়েন্দা বাহিনীতে যোগ দেয়ার আগেই তিনি কিউবার গুপ্তচর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।

এরপর চাকরির বিভিন্ন মেয়াদে তিনি কিউবাতে মার্কিন গোপন তথ্য পাঠাতে থাকেন বলেন জানা যায়। নিজের বাসায় বা কাজের স্থানে তিনি কখনও গোপন দলিলগুলো রাখতেন না। তার বদলে তিনি সকল তথ্য মনে রাখতেন এবং বাসায় ফিরে তিনি সেই তথ্যাদি স্মৃতি থেকে ল্যাপটপে লিখে রাখতেন। পরবর্তীতে সেই লেখার একটি টাইপ করা কপি তিনি ডিস্কে করে সংরক্ষন করতেন। সেই ডিস্ক তার হাত হয়ে কিউবায় চলে যেন আরও কয়েক হাত ঘুরে। কিন্তু ১৯৯৬ সালের এক রাতে মন্তেসকে পেন্টাগনে ডেকে পাঠানো হয় একটা বিষয়ে আলোচনার জন্য। সেসময় তিনি নিজের প্রোটোকলের বাইরে কিছু কাজ করে ফেললে ডিআইএ অফিসার কারমাইকেলের নজরে আসেন তিনি এবং কারমাইকেল নিজে অ্যানার ব্যক্তিগত ফাইল ঘাটতে শুরু করেন। কিন্তু তখনও তাকে ধরা সম্ভব না হলেও, কারমাইকেলের মনে অ্যানাকে নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। ঠিক তার চার বছর পরেই এফবিআই ডিআইএ’র মধ্যে একজন গুপ্তচর খোজার চেষ্টা করছিল। এরপর একটা সময় এফবিআই অনকে কাঠখড় পুড়িয়ে গ্রেফতার করতে সমর্থ্য হয় অ্যানা মন্তেসকে।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *