:: আরিফুল হক ::
পলাশী নামটা মনে পড়লেই, বেঈমান মীরজাফরের নামটা উচ্চারিত হবেই । মীরজাফরের বেঈমানী আমাদের মনে এমন ঘৃণার দড়িতে লেপ্টে দেয়া হয়েছে যে ,আজ ২৬৪ বছর পরও মীরজাফরের বংশধরেরা যে যেখানে বাস করছেন – মুখ লুকিয়ে , আত্মপরিচয় গোপন রেখে বাস করে যাচ্ছেন। যেমন পাকিস্তানের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডন্ট ইস্কান্দার মির্জা (১৯৫৬) মীরজাফরের ৪র্থ অধঃস্তন পুরুষ ছিলেন। অর্থাৎ ইস্কান্দার মির্জার দাদার বাবা ছিলেন মীর জাফর আলি খাঁন। একথা আমরা কয়জন জানতে পেরেছি? জানতে পারিনি কারন তারা লজ্জায় নিজেদের বংশপরিচয় উন্মুক্ত করতে পারতেন না ।
সত্যিই কি পলাশী ষড়যন্ত্রের জন্য মীর জাফর এককভাবে দায়ী? নাকি এটিও এক ষড়যন্ত্রের মধ্যে আরেক ষড়যন্ত্র?
কবি নবীন চন্দ্র সেন (১৮৪৭-১৯০৯) লিখেছেন :-
“ যবন ভারতবর্ষে আছে অবিরত/ সার্দ্ধ পঞ্চশত বর্ষ / এই দীর্ঘকাল …
একই ভরসা মীরজাফর যবন/ যবনেরা যেইরূপ ভীরু প্রবঞ্চক।”
নবীনচন্দ্রের ভাষায় যবনেরা অর্থাৎ মুসলমানেরা মীরজাফরের জাত । তারা ভীরু এবং প্রবঞ্চক । শুধু নবীনচন্দ্রই নন , ঈশ্বর চন্দ্র, বঙ্কিম চন্দ্র , হেম চন্দ্র , গিরিশ চন্দ্র , দ্বিজেন্দ্র লাল, যদুনাথ সরকার , রমেশচন্দ্র মজুমদার, ড সুরেন্দ্র সেন , কালিকিঙ্কর দত্ত প্রমূখ তাবৎ হিন্দু কবি লেখক ঐতিহাসিকগণ পলাশীর যুদ্ধ নিয়ে একই ভাষায় মীর জাফরকে বেঈমান চূড়ামনি প্রতিপন্ন করে সমগ্র মুসলমান জাতিকে হেয় করার চেষ্টা করেছেন । তাদের কথায়, কবিতায়, নাটকে, ইতিহাসে, লেখনে, বচনে একটা কথাই প্রমাণ করতে চেয়েছেন। সেটা হচ্ছে মুসলমানরা বেঈমান, ভীরু এবং প্রবঞ্চক ।
ইংরেজদের হাতে স্বাধীনতা তুলে দেবার ব্যাপারে মুসলমানদের অন্নে পালিত হিন্দু রাজা ,ব্যবসায়ী দেওয়ান, মুন্সেফ মন্ত্রীদের বেঈমানীই যে মূখ্যভূমিকা পালন করেছিল সে সত্য ইতিহাস বাবু বুদ্ধিজীবীদের কৃপন লেখায় পাওয়া যায়না বরং তাদের সংঘবদ্ধ প্রচার প্রচারনার ফলে সাধারন মানুষ শুধু নয় , শিক্ষিত মুসলমানদের মনেও বদ্ধমূল ধারনা জন্মেছে যে, নবাব সিরাজ উদ্দৌলার লাম্পট্য বিলাস এবং মীর জাফরের বেঈমানীর কারনেই ১৭৫৭ খৃষ্টাব্দের ২৩ জুন পলাশী যুদ্ধে সুবে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য্য অস্তমিত হয়েছিল।
সত্যই কি তাই ?
১৭ শতাব্দীর মুর্শিদাবাদের রাজনীতির দিকে তাকালে, আজকের বাংলাদেশের রাজনীতির সাথে কিছুটা মিল খুঁজে পাওয়া যাবে । যেমন – ১৭১৭ সালে মুর্শিদ কুলি খাঁ নওয়াব হওয়ার পর রাজকার্যে এবং ব্যবসা ব্যনিজ্যে হিন্দুদের প্রভাব প্রতিপত্তি অন্তত্য বেড়ে যায় । লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরি ও হল্যান্ডের রাজকীয় আর্কাইভে রাখা সেই সময়ের বাংলার উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারী ও জমিদারদের তালিকা থেকে জানা যায় যে ,নবাব আলীবর্দ্দীর সময় (১৭৫৪) দেওয়ান , তনদেওয়ান , সাব দেওয়ান , বক্সী প্রভৃতি সরকারের ৭টি গুরুত্বপূর্ণ পদের ৬টিই ছিল হিন্দুদের অধিকারে । একমাত্র মুসলমান বক্সী ছিলেন মীর জাফর । আবার রাজ্যের ১৯জন রাজা জমিদারদের মধ্যে ১৮ জনই ছিলেন হিন্দু !(রবার্ট ওরম এর তালিকা ) । নবাব সিরাজুদ্দৌলার সময় সর্বক্ষেত্রে হিন্দু প্রভাব আরও বেড়ে যায় ।রবার্ট ওরম তাঁর মন্ত্যব্য লিখেছেন [The Gentoo(Hindu) Connection become the most opulent influence in his Government, of which it pervaded every department with such efficacy that nothing of moment could move without their participication or knowledge .] অর্থাৎ সরকারের প্রতিটি ডিপার্টমেন্টে হিন্দু প্রভাব এক অধিকমাত্রায় বেড়ে গিয়েছিল যে হিন্দুদের সাহায্য এবং পরামর্শ ছাড়া তাদের এক পা চলাও সম্ভব ছিলনা ।
শাসন ক্ষমতায় হিন্দুদের একচেটিয়া প্রভাব থাকলেও মুসলমানদের কাছ থেকে সিংহাসন দখলে নেয়ার সাহস হিন্দুদের ছিলনা !
তাই মুসলমানদের কাছে থেকে শাসন ক্ষমতা দখল করার ব্যবস্থা হিসাবে তারা ইংরেজ শক্তিকে কাজে লাগাবার কূটনীতি গ্রহন করে ! এবং এ বিষয়ে সম্পূর্ণ নেতৃত্ব দেন মুর্শিদাবাদ নবাব দরবারের সবচাইতে ক্ষমতাধর ব্যক্তি জগত শেঠ ! জগৎশেঠকেই মূলঃত মুর্শিদাবাদ ষড়যন্ত্রের মূল আর্কিটেক্ট বলা যেতে পারে !
কে এই জগত শেঠ !
জগৎশেঠ পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা হীরানন্দ সাহা ছিলেন মাড়োয়ারের (রাজস্থান) অন্তর্গত নাগৌর অঞ্চল থেকে ভাগ্যান্বেষনে আসা পাটনার এক সুদের কারবারি । নবাব মুর্শিদকুলী খাঁনই মাড়োয়ারী হিরানন্দ সাহা পরিবারকে অন্ধকার থেকে তুলে এলে ‘জগত শেঠ ‘ অর্থাৎ বিশ্ব ব্যাংকারে পরিনত করেন! অথচ সেই জগতশেঠই আপন প্রভু মুর্শিদকুলী খানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেই বেঈমানির হাতেখড়ি দেন !
এই বেইমান আপন প্রভু নবাব মুর্শিদকুলী খানের মৃত্যুশয্যার পাশে বসেই , নবাব জামাতা সুজাউদ্দীনকে দিয়ে মুর্শিদাবাদ আক্রমন করায় এবং তাকে নবাবী মসনদ অধিকার করতে সাহায্য করে ।
আবার সুজাউদ্দীনের মৃত্যুর পর তার পুত্র সরফরাজ খান নবাব হওয়ায় কথা থাকলেও এই জগৎশেঠের বিশ্বাসঘাতকতার কলকাঠিতেই সরফরাজ খান নিহত হন ,এবং আলীবর্দী খান নওয়াবী মসনদ দখল করেন ।
আলীবর্দীর মৃত্যু ঘনিয়ে আসার সময় হলে , স্বরূপচাঁদ জগৎশেঠ ও তার ভাই মাহতাব চাঁদ জগৎশেঠ, হিসাব নিকাশ করে দেখে যে আলীবর্দীর পর তরুন, সুশিক্ষিত তেজী দৃঢ়চরিত্রের সিরাজুদ্দৌলা নবাব হলে তাদের অন্যায় অধিকারের অনেকাংশেই ভাঁটার টান পড়বে , তাই তখন থেকেই শুরু করেদেয় সিরাজুদ্দৌলাকে সিংহাসন থেকে উৎখাত করার চক্রান্ত !
আলীবর্দী তখন মৃত্যুশয্যায় । ষড়যন্ত্রকারীরা আলীবর্দীর জেষ্ঠ্য কন্যা, নিঃসন্তান ঘষেটি বেগমকে বোঝালো যে নবাবের কন্যা হিসাবে মসনদ তারই প্রাপ্য ! চক্রান্তকারীদের প্ররোচনায় ঘষেটি বেগম ১৭৫৬ সালের মার্চ মাসে দশহাজার সৈন্য নিয়ে সিরাজের বিরূদ্ধে মুর্শিদাবাদ উপকন্ঠে অবস্থান নেন। পাশে থাকে জগৎশেঠ রাজবল্লভ প্রমূখ বেঈমানরা । সিরাজ বিচক্ষণতার সাথে যুদ্ধ এড়িয়ে খালার সাথে আপোস করার মাধ্যমে বেঈমানদের ষড়যন্ত্রজাল ছিন্ন করতে সক্ষম হন !
জগৎশেঠদের বেঈমানির ইতিহাস এতটুকুতে শেষ নয় । ৩৬ বছর ধরে ,একে একে ৭ জন শাসকের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করার এমন সফল নায়ক পৃথিবীর ইতিহাসে দ্বিতীয়টি আর খুঁজে পাওয়া যাবেনা ! অথচ বাবু নবীনচন্দ্ররা জগৎশেঠকে বিশ্বাসঘাতক বলতে কার্পন্য করে, মীরজাফর কে এককভাবে বেঈমানের প্রতীক বানিয়েছেন ! কারন পরিষ্কার , মুসলমান জাতিকে প্রবঞ্চক বলবেন কিভাবে !
রাজতন্ত্রের যুগে রাজদ্রোহীতা নতুন কিছু ছিলনা । মীরজাফর বেঈমান ছিলেন, রাজদ্রোহী ছিলেন, তিনি জাতিদ্রোহী ছিলেননা । তিনি ছিলেন পরিস্থিতির শিকার !
চলুন পলাশীর চক্রান্তগারটা একটু ঘুরে আসি !
১৭৫৭ সালের ১৯ মে ! আজ পলাশী ষড়যন্ত্রের চুড়ান্ত বৈঠক হচ্ছে । স্থান জগৎশেঠের বাড়ী !ঐ যে মহিলার ছদ্মবেশে পাল্কীতে চেপে ঢুকলেন ইংরেজ দূত মিঃ ওয়াটস ।
ওয়াটস বলছেন, সিরাজের সাথে লড়তে যে প্রস্তুতি এবং বিপুল অর্থের প্রয়োজন বর্তমানে তা আমাদের নেই । জগৎশেঠই আশ্বস্থ করে বলছে , টাকার জন্য চিন্তা করবেন না , টাকা যা দিয়েছি , প্রয়োজন হলে আরও দিয়ে যাব । অর্থাৎ সুবেবাংলা বৃটিশদের হাতে তুলে দেবার জন্য সমস্ত ব্যয়ভার বহন করেছিল ঐ মুনাফেক জগৎশেঠ ।
এবার নবাব সিরাজুদ্দৌলাকে উৎখাত করার চুড়ান্ত চুক্তিপত্র সাক্ষর করার পালা। সেখানেও প্রথম সইটি করলো ঐ বেঈমান জগৎশেঠ ! তারপর মাড়োয়াড়ী ব্যবসায়ী উঁমিচাঁদ , রায়দূর্লভ, রাজবল্লভ প্রমূখ বেঈমান চক্র। মীরজাফর কিন্তু স্বাক্ষর করছেন না । তাকে অনেক লোভ দেখানো হল । তিনি বললেন আমার কিছুটা সময় দরকার, বলে সভা ছেড়ে চলে গেলেন !
বেঈমানচক্র মীরজাফরকে নানান ভাবে ভয়ভীতি দেখাতে লাগলো , বললো ইংরাজদের সাথে তার গোপন মিটিং এর কথা নবাবের কাছে ফাঁস করে দেয়া হবে । অতঃপর অন্যদের সাক্ষরের ১৭ দিন পর অর্থাৎ ৫ই জুন মীরজাফর বেঈমানী চুক্তিতে সাক্ষর করতে বাধ্য হয় !
মীরজাফর আবার মত বদলাতে পারে এই ভয়ে চুক্তি স্বাক্ষরের পর ক্লাইভ আর দেরী করেনি ! ১৩জুন ই মুর্শিদাবাদ অভিযান শুরু করে দেয় ! ১৯ জুন কাটোয়ায় পৌছায় । পলাশী পৌছায় ২২জুন মধ্যরাতে।
ঐ অভিযানে ক্লাইভের সেনাবাহিনীতে ছিল মাত্র ৯০০ ইংরাজ সৈন্য ২১০০ দেশীয় সৈন্য !
স্ক্র্যাফটন লুটেরার মতে নবাব বাহিনীতে ছিল ৫০হাজার অশ্বারোহী , ৫০টি কামান । দুঃখের বিষয় নবাবের বিশাল সেনাবাহিনীর ৪৫০০০ সেনাই ছিল মীরজাফর , রায়দূর্লভ , প্রমূখ বেঈমান সেনাপতিদের অধীন । যারা সেদিন যুদ্ধ করেনি , স্বাধীন বাংলা শৃঙ্খলিত হওয়ার দৃশ্য উপভোগ করছিল !
৭১১ সালে সিন্ধুর উপকূলে মুহম্মদ বিন কাসিম মুসলমানদের যে বিজয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন , ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীতে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের মধ্যদিয়ে সেই পতাকা ভুলুন্ঠিত হল।
ঐতিহাসিকরা বলেছেন, Plassey is the achievement of Treachary .লর্ড ক্লাইভ লিখছেন (১৭৫৭ সালের ৩০ এপ্রিল ক্লাইভের চিঠিপত্র) , কয়েকজন্য শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি এই চক্রান্তের পেছনে থাকলেও আসল নেতৃত্ব দিয়েছিল জগৎশেঠ নিজেই ।ঐতিহাসিক তপন মোহন চট্টাপাধ্যায় তাঁর পলাশীর যুদ্ধ বইতে লিখেছেন,- ‘ষড়যন্ত্রটা আসলে হিন্দুদেরই ষড়যন্ত্র ।
সুতরাং নবীনচন্দ্র বাবুরা যাই বলুকনা কেন, পলাশী চক্রান্তের নায়ক মীরজাফর ছিলনা, পলাশী চক্রান্তের মূল হোতা ছিল জগৎশেঠ ।এবং নবাবদের দাক্ষিন্যে ফুলে ফেঁপে ওঠা ব্যাংকার জগৎশেঠের সাঙ্গপাঙ্গ , ঢাকার ধনকুবের ভিখনলাল পান্ডে , ধনকুবের উঁমিচাঁদ ,দেওয়ান রামজীবন , রাজা রাজবল্লভ, উপপ্রধান সেনাপতি রায়দূর্লভ , সেনাপতি মানিকচাঁদ , সেনাধ্যক্ষ নন্দকুমার ,কাশিমবাজারের মহারাজা , নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণদেব রায় চৌধুরী , নাটোরের রানী ভবানী প্রমুখ !
আজ বাংলাদেশের মানুষের সামনে আর একটি পলাশী উপস্থিত । জানিনা তারা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে সামনের যুদ্ধে জয়ী হতে পারবে কিনা ।
লেখকঃ নাট্য ও চলচ্চিত্রের একসময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা