প্রসঙ্গ: শিক্ষা ও শিক্ষিত মানুষ

:: আরিফুল হক ::

শিক্ষা কাকে বলে ? এ বিষয়ে বহু দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদ এবং গুনীজন বহুভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।
আমি এখানে কোরান হাদিসের আলোকে শিক্ষার পরিভাষা নিয়ে দু একটা কথা বলব। কথাগুলো অনেকেরই জানা তবে বলা বা আলোচনা হয়না।

ইসলাম পাঁচটি শব্দের আবহ দিয়ে শিক্ষার পরিভাষা নির্নয় করেছে।

১) তারবীয়া ২) তালীম ৩) তাদীব ৪)তাদরীব ৫) তাদরীস ।


১) তারবীয়া অর্থ , to grow, অর্থাৎ প্রবৃদ্ধি , মানুষকে বড়করে তোলা ।
২) তালীম , মানে information অর্থাৎ তথ্য জ্ঞানে সমৃদ্ধ করে তোলা।
৩) তাদীব , অর্থাৎ মানুষকে প্রস্ফুটিত করা, পূর্ণতা দান করা। সংস্কৃতিবান করে তোলা।
৪) তাদরীব , habitation অর্থাৎ উজ্জীবিত করা বা জাগিয়ে তোলা।
৫) তাদরীস , অর্থাৎ গড়েতোলা , মানুষ হিসাবে নির্মান করা বা মানুষ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে দেয়া।

ইসলামে শিক্ষা সম্পর্কিত উপরোক্তো পরিভাষা ব্যাপক অর্থবোধক। এগুলো বিশ্লেষন করলে শিক্ষার সূদূরপ্রসারী উদ্দেশ্য ও ব্যপক পরিধি সম্পর্কে ধারনা করা যায়।

যেমন ইসলামে শিক্ষার উদ্দেশ্য হচ্ছে, শিক্ষার্থীকে লালনপালন করে বড় করে তোলা। তাকে উন্নত পথে চলার মত শিক্ষা দান করা । মানুষের সদাচার, সদগুন গুলো হাতেকলমে শেখান, অনুশীলন করানো, অভ্যাস করানো এবং তাকে সুসভ্য মানুষ করে গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনে শাসন করা। তাকে সঠিকভাবে ইহকালীন ও পরকালীন পথের সন্ধান দেওয়া।

শিক্ষার্থীকে উপযুক্ত সংবাদ, তথ্য , বৈশ্বিক ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান দানের মাধ্যমে তার অন্তর্নিহিত শক্তিকে বিকশিত করে, সমৃদ্ধ মানুষ হিসাবে গড়ে তোলা। নিখুঁত কর্মদক্ষতা, ও কর্ম কৌশল শিখিয়ে দেশ গড়ার মানুষে পরিনত করা।


শিক্ষার্থীকে শালীনতা , শোভনতা , শিষ্টাচার, নম্রতা, ভদ্রতা বিনয়ী হওয়ার মত উন্নত জীবনপ্রনালী শিক্ষাদানের মাধ্যমে , উন্নত মানসিক, নৈতিক ও শারীরিক মান সম্পন্ন মানুষ হিসাবে গড়ে তোলাও ইসলামি শিক্ষা কারিকুলামের অংশ। বিচার বিবেচনায়, চিন্তাভাবনায়, গবেষনা কাজে, উদ্ভাবনী কাজে স্ফুরণ ঘটানর মত মানসিক গঠন সৃষ্টি করে দেওয়াও ইসলামি শিক্ষার ব্যবস্থার অন্তর্গত বিষয়।

তাইতো আমরা দেখি ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থায় শিক্ষিত জাবীর ইবনে হাইয়ান শুধু ধর্মীয় পন্ডিতই ছিলেন না। তিনি ছিলেন বৈজ্ঞানিকদের পিতা, ইস্পাত তৈরি, ধাতুর শোধন, লেখার কালি তৈরি, ওয়াটারপ্রুফ ইত্যাদি তারই আবিষ্কার।


ম্যাঙ্গানিজ ডাই অক্সাইড থেকে কাঁচ তৈরির প্রথম চিন্তাবিদ, বরফ তৈরি পদ্ধতি আবিষ্কার যার অক্ষয় কীর্তি, সেই বিজ্ঞানী আর রাজী (পশ্চিমী দুনিয়ায় Razes) শুধুই বৈজ্ঞানিক ছিলেন না। তিনি ছিলেন গনিতজ্ঞ এবং ইতিহাস প্রসিদ্ধ চিকিৎসক।


জগৎবিখ্যাত কবি ওমরখৈয়াম শুধুই কবি ছিলেন না , তিনি ছিলেন বিখ্যাত গনিত বিশারদ । গনিতে ০শূন্যের মান তাঁরই আবিষ্কার । আবু সিনা, হাজ্জাজ, তুসী, আল বিরুনী প্রমূখ শতশত নাম বলা যায় যাদের বাদ দিয়ে ইতিহাস ভূগোল বিজ্ঞান কল্পনা করা যায়না। এসবই ইসলামি শিক্ষা বব্যস্থায় শিক্ষাগ্রহনের ফসল।


দার্শনিক কবি ড: আল্লামা ইকবাল তাই ঠিকই বলেছিলেন “ পূর্ণাঙ্গ মুসলিম তৈরি করাই হবে প্রকৃত শিক্ষার উদ্দেশ্য।”

আজ কোথায় শিক্ষা আর কোথায় মুসলমান ?

আগের যুগে শিক্ষার সাথে দীক্ষা কথাটা জুড়ে দেওয়া হত। বলা হত শিক্ষাদীক্ষা। আজকাল শিক্ষার সাথে দীক্ষা নেই। দীক্ষাহীন শিক্ষা, সে তো চুরি ডাকাতির শিক্ষাও হতে পারে। দীক্ষাহীন শিক্ষা ব্যবস্থার ফলেই দেশজুড়ে আজ শিক্ষিত চোর , লুটেরা , ব্যাংক ডাকাত , ব্যাংকহ্যাকার, টাকা পাচারকারি, ঘুষ খোর, কমিশন খোর, নার্কোটিকস ব্যবসায়ী, শেয়ার বাজার লুন্ঠনকারি, খাদ্যেভেজালকারী, শিক্ষিত প্রমোদবালা, প্রভৃতি সৃষ্টি হয়ে দেশকে বিষাক্ত করে ফেলেছে। আজকের শিক্ষাব্যবস্থায় শুধুই সার্টিফিকেটধারী শিক্ষিত তৈরি করা হচ্ছে, শিক্ষিত মানুষ সৃষ্টি হচ্ছেনা। সুতরাং দেশকে প্রকৃত মানুষের দেশে পরিনত করতে হলে, সার্টিফিকেটধারীর পরিমান বাড়ালে চলবেনা, শিক্ষিত মানুষের মান বাড়াতে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে।

লেখকঃ নাট্য ও চলচ্চিত্রের একসময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *