পোশাক শিল্পের উৎপাদনশীলতা কম কেন?

:: ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব ::

বাংলাদেশের কস্ট অফ প্রোডাকশন বেশি। মূল্যস্ফীতি ড্রিভেন ইকোনোমিতে প্রতি বছরই উৎপাদন খরচ কিছু বাড়ে, বাংলাদেশ তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু বাংলাদেশের পণ্য আন্তর্জাতিক মূল্য প্রতিযোগিতায় পারে না। কেন?

হাস্যকরভাবে এর উত্তরে দেশের এনজিও ফিডেড অপদার্থ বুদ্ধিজীবীরা কারণ বর্তায় মাসে ৭২-৭৫ ডলারের সস্তা শ্রমিকের উপর। তারা বিদ্যুৎ ও জ্বালানির বেইজ প্রাইস দেখে না, রাস্তার যানজট দেখে না, চাঁদাবাজি ও উচ্চ পরিবহণ খরচ, ভাড়া, শ্রমিকদের জাঁতা কলে দিতে ভাড়া করে আনা ভারত শ্রীলংকার ম্যানেজারের কস্ট, প্রশাসনের ঘুষ তদবির, মশা ও জীবাণুর দূষিত শহরে স্বাস্থ্য দুর্গতি ও স্বাস্থ্য ব্যয়ে পকেট থেকে খরচের হার ইত্যাদিসহ প্যাসিভ রেন্ট সিকিং কস্ট দেখে না। নির্মম হচ্ছে, নির্বিচার পরিবেশ দূষণ করে, শোধনে খরচ না করেই এই অবস্থা।

আমরা উৎপাদনশীলতার বৈশ্বিক বেঞ্চমার্ক ছুতে পারছি না, এর কারণ নির্বোধ পলিসি, শ্রমিক নয়। হ্যাঁ অপরাপর অনুঘটক ঠিক করলে উদ্ভাবন, প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে উৎপাদনশীলতা বাড়ে। কিন্তু বাংলাদেশের পোশাক শিল্প মেশিনারিতে পিছিয়ে আছে এই দাবি মিথ্যা। অনেক কিছুই স্বয়ংক্রিয় মেশিনে হচ্ছে।

এশিয়ান প্রোডাক্টিভিটি অর্গানাইজেশন-এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, মূল্যের দিক থেকে একজন বাংলাদেশি পোশাককর্মীর ঘণ্টায় উৎপাদনশীলতা দাঁড়ায় ৩.৪ ডলারে। উৎপাদনশীলতার এ হার প্রতিযোগী দেশগুলোতে তুলনামূলকভাবে বেশি—মায়ানমারে ৪.১ ডলার, ভিয়েতনামে ৪.৭ ডলার, ভারতে ৭.৫ ডলার, ফিলিপাইনে ৮.৭ ডলার, চীনে ১১ ডলারের বেশি এবং শ্রীলঙ্কায় প্রায় ১৬ ডলার।

জীবনযাপনের ব্যয় বৃদ্ধির জাঁতাকলে নিম্ন মজুরির শ্রমিকদের শহরে থাকাই মুশকিলের বিষয় হয়ে গেছে, টিকতে না পেরে শ্রমিকরা গ্রামে ফায়ার যাচ্ছেন, যেখানে আছে বেকারের মিছিল ও ছদ্ম বেকারত্ব। এমতাবস্থায় সঠিক মজুরির সমন্বয় না করে আউটপুট/ ইফিসিয়েন্সির প্রত্যাশা জুলুমের কথা। উচ্চ মূল্যস্ফীতির দীর্ঘ সময়ে, বছর শেষে কস্ট অফ লাইফ বা মজুরি সমন্বয়ের প্রক্রিয়া নাই। রক্ত ও প্রাণের বিনিময়ে ৫ বছর পর পর সহিংস আন্দোলন করে ২০-৩০ ডলার মজুরি বাড়াতে হয়। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় এসব পশ্চাৎপদ এবং শোষণ মূলক পদ্ধতিগত সমস্যা বন্ধ করে সর্বোচ্চ ২ বছর পর পর নতুন মজুরি কাঠামো, ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্স করা ভাতা ও সুবিধা, শ্রমঘণ্টা বিন্যাস নতুন করে সংজ্ঞায়িত না হলে, বাংলাদেশের শিল্পে উচ্চ উৎপাদনশীলতা আসবে না ।

নিম্ন উৎপাদনশীলতা নিয়েও, দিনে গড়ে ১৪-১৫ ঘন্টা কাজ করা শ্রমিকের মাসে উৎপাদন ১৪০০-১৪৩০ ডলার। মালিক তাকে বেতন দেয় ৭০-৮০ ডলার প্লাস ৩০-৪০ ডলার ওভার টাইম। মোটে ১৩০-১৪০ ডলার। ১৪০০ ডলারের শ্রমের বিপরীতে ওভারটাইম সহ ১৪০ ডলার মজুরি। অভিযোগটা ঠিক কোথায়?

প্রশ্ন হচ্ছে অত্যন্ত কম মজুরির সংস্কৃতি জারি রেখে, ছুটি ও ভাতা না দিয়ে, ওয়ার্ক আওয়ারে এমনকি চা-কফি-বিস্কুট-নিরাপদ খাবার পানি না দিয়ে, অন্য কোন জব ফ্যাসিলিটি না দিয়ে দিনে একজন শ্রমিককে দিয়ে দুই জনের সমান শ্রমঘণ্টা কাজ করানোর চর্চা থেকে উৎপাদনশীলতা আশা করা বোকামি। নিন্ম উৎপাদনশীলতা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় হচ্ছে স্বচ্ছন্দে বাঁচার মত সঠিক মজুরি, ওয়ার্ক লাইফ ব্যালান্স, ছুটি ও ভাতা এবং কর্ম পরিবেশে স্বচ্ছন্দ। সন্তানের নিরাপত্তা এবং সুস্বাস্থ্য।

উৎপাদনশীলতা বাড়াতে শ্রমিকদের দুপুরে একটা লাঞ্চ বক্স দিন, যেখানে তার দৈনিক ক্যালরি (আমিষ ও পুষ্টির) একটা যোগান থাকবে। কয়েক কিলো হেটে আসা শ্রমিকের বাস ভাড়ার একটা অংশ দিন, যাতায়াতের সুবিধা দিন- দেখেন উৎপাদনশীলতা কোথায় যায়!

বাংলাদেশের তৈরী পোশাক শিল্পের উৎপাদনশীলতা কম হবার বড় কারণ ট্রেনিং এন্ড ডেভেলপমেন্টে অর্থ ব্যয় না করা। গ্রাম কিংবা নিন্মবিত্ত প্রান্তিক পরিবার থেকে আসা স্বল্প শিক্ষিত নতুন শ্রমিককে ট্রেনিং দিতে গেলে অর্থ ও শ্রমঘণ্টার অপচয় হবে ভেবে কুঞ্জুস মালিকরা (শ্রম উৎপাদনশীলতায় কৌশলগত জ্ঞানে নির্বোধ) শুরুতেই তাদের হেলপার হিসেবে নিয়োগ দেয়। দক্ষতা তৈরির বিধিবদ্ধ কাঠামো না করে, পেটেভাতে কাজ শিখানোর এই নিচুতা মালিকরা ছাড়তে পারেনি। হেলপার সংস্কৃতির ফলে কারখানার ওভারঅল হেড কাউন্ট বেড়ে মাথাপিছু উৎপাদনশীলতা কম দেখায়। বাস্তবে উৎপাদনশীলতা মোটেই কম নয়। সুবিধাহীন শ্রান্ত-পরিশ্রান্ত শ্রমিক মেশিন নয় যে তাকে চুষে উৎপাদনশীলতা পয়দা হবে।

২০ লক্ষ শ্রমিকের শিল্প অথচ কারিগরি দক্ষতা তৈরির জন্য কোন ট্রেনিং সেন্টার নাই। ৫০ বিলিয়ন ডলারের শিল্পে শিক্ষা ও গবেষণা নাই। এভাবে ‘মানকি সি, মানকি ডু’ সিস্টেমে তারা উচ্চ উৎপাদনশীলতা আশা করে কীভাবে?

একটা সত্য কথন হচ্ছে, দেশে আবাসিক কওমি মাদ্রাসা না থাকলে পোশাক শিল্পের উৎপাদনশীলতা আরও কম হত। মধ্যবয়সী নারী ও পুরুষ শ্রমিকরা ছেলে-মেয়েদের মাদ্রাসায় দিয়ে কাজে যান। এইসব মাদ্রাসায় সরকারের বিনিয়োগ শূন্য। অথচ শিল্প শ্রমের দক্ষতা বলুন কিংবা সন্তাদের শিক্ষা ও ডে-কেয়ার টাইপের সুবিধা, অবকাঠামো বন্দোবস্ত করার কথা ছিল সরকার-মালিক নেক্সাসের।

শিল্পের বাবস্থাপনা এবং শ্রম দক্ষতা নিয়ে খোলনলচে পাল্টাতে হবে, নাইলে দেশের শিল্পপতিদের মেকিকান্না থামবে না। আর হ্যাঁ, শ্রম দক্ষতা ও উৎপাদন বৃদ্ধির একাডেমিক ও বাজার গবেষণাগত ব্যাখ্যা গুলোকে আমলে না নিলে সরকার-মালিক পক্ষের নির্বোধ সব আচরণে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো অসম্ভব।

জীবনযাপনের ব্যয় বৃদ্ধির জাঁতাকলে নিম্ন মজুরির শ্রমিকদের শহরে থাকাই মুশকিলের বিষয় হয়ে গেছে, টিকতে না পেরে শ্রমিকরা গ্রামে ফায়ার যাচ্ছেন, যেখানে আছে বেকারের মিছিল ও ছদ্ম বেকারত্ব। এমতাবস্থায় সঠিক মজুরির সমন্বয় না করে আউটপুট/ ইফিসিয়েন্সির প্রত্যাশা জুলুমের কথা। উচ্চ মূল্যস্ফীতির দীর্ঘ সময়ে, বছর শেষে কস্ট অফ লাইফ বা মজুরি সমন্বয়ের প্রক্রিয়া নাই। রক্ত ও প্রাণের বিনিময়ে ৫ বছর পর পর সহিংস আন্দোলন করে ২০-৩০ ডলার মজুরি বাড়াতে হয়। মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় এসব পশ্চাৎপদ এবং শোষণ মূলক পদ্ধতিগত সমস্যা বন্ধ করে সর্বোচ্চ ২ বছর পর পর নতুন মজুরি কাঠামো, ওয়ার্ক-লাইফ ব্যালান্স করা ভাতা ও সুবিধা, শ্রমঘণ্টা বিন্যাস নতুন করে সংজ্ঞায়িত না হলে, বাংলাদেশের শিল্পে উচ্চ উৎপাদনশীলতা আসবে না।

লেখক: টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *