:: মুজতবা খন্দকার ::
মেট্রোরেলেের একটি স্টেশন জাতীয় প্রেসক্লাবের নামে করতে সরকারের কাছে চিঠি দিয়েছেন ক্লাবের স্থায়ী সদস্যদের একটি অংশ। চিঠিটা আমারও দৃষ্টিগোচর হয়েছে। চিঠিটা পড়ে মনে হয়েছে। ক্লাবের ইতিহাস নিয়ে অগ্রহনযোগ্য কিছু তথ্য বিকৃতি ঘটানো হয়েছে। যা কোনোভাবেই প্রত্যাশিত ছিলোনা। চিঠিতে, তোপখানা রোডের মেট্রো স্টেশনকে প্রেসক্লাব নামকরন কেন করা যৌক্তিক তার বিশদ ব্যাখা দেয়া হয়েছে। ওই ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এক জায়গায় চিঠিতে লেখা হয়েছে, বর্তমান প্রেসক্লাবের জায়গাটি বরাদ্দ দিয়েছিলেন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। তথ্যটি শুধু কেবল বিভ্রান্তিমূলক তাই নয়, ভয়ংকর ইতিহাসবিকৃতিও বটে। কারন জাতীয় প্রেসক্লাব বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। শুধু তাই নয়, এই চিঠির মাধ্যমে তরুন প্রজন্ম কিম্বা প্রেসক্লাবের যারা নবীন সদস্য তাদেরকেও ভুল বার্তা দেয়া হবে। আর সেকারনে ক্লাবের একজন স্থায়ী সদস্য হিসেবে, প্রকৃত তথ্য তুলে ধরা জরুরী বলে মনে করছি।
বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের অতন্দ্র প্রহরী ও রাস্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদক্ষেত্রের প্রাণকেন্দ্র জাতীয় প্রেসক্লাব।
১৯৫৪ সালের অক্টোবরে সাংবাদিকদের এই প্রিয় প্রতিষ্ঠানটি দেশের ইতিহাসে তার অভিযাত্রা শুরু করে। ১৮, তোপখানা রোড, এর সরকারি ভবনটি তখন পূর্ব পাকিস্তান প্রেসক্লাব হিসেবে পরিচিত ছিল যা মাসে ১০০ টাকা ভাড়ায় প্রেসক্লাবের নামে বরাদ্দ দেয়া হয়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কাল রাতে হানাদার বাহিনী প্রেসক্লাব ভবনে মর্টারশেল নিক্ষেপ করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রেসক্লাব সংশোধন করে নাম রাখা হয় জাতীয় প্রেসক্লাব। এ সময় প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিলেন আবদুল আউয়াল খান; সম্পাদক ছিলেন এ এস এম হাবিবুল্লাহ।
এক পর্যায়ে সাংবাদিকরা তৎকালীন সরকার প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে জাতীয় প্রেসক্লাবের বর্তমান জায়গাটি স্থায়ী বরাদ্দ চেয়েছিলেন। সে সময় তিনি জায়গা বরাদ্দ না দিয়ে বলেছিলেন, ‘সচিবালয়ের প্রয়োজনে জায়গাটি সাংবাদিকদের দেয়া যাবে না।’ তিনি সাংবাদিকদেরকে বর্তমান জায়গা থেকে প্রেসক্লাবকে সরিয়ে শিল্পকলা একাডেমির কাছে একটি জায়াগা নিতে বলেছিলেন। কিন্তু শিল্পকলা একাডেমির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের জয়গা ছাড়তে রাজি হয়নি এবং বাঁধার সৃষ্টি করে। এভাবে নানা টালবাহানায় সময় চলে যায় এবং শেখ মুজিবুর রহমানেই সময়কালে প্রেসক্লাবের জন্য স্থায়ী কোন জায়গা বরাদ্দ হয়নি।
পরে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সরকার আসার পর সাংবাদিকরা তাঁর কাছে জাতীয় প্রেসক্লাবের জন্য স্থায়ী জমি বরাদ্দ দেয়ার অনুরোধ জানায়। অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে জিয়াউর রহমান জাতীয় প্রেসক্লাব পরিদর্শন করেন। ১৯৭৮ সালে তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবের জন্য বর্তমান স্থানেই এক দশমিক ১২ একর জায়গা ৩০ বছরের জন্য বরাদ্দ দেন।
এদিকে বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে ১৯৭৮ সালে ঢাকা সফর করেন আগা খান উন্নয়ন নেটওয়ার্কের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান এবং ইসমাইলি সম্প্রদায়ের ৪৯তম ইমাম প্রিন্স করিম আগা খান। ঢাকা সফরকালে তিনি জাতীয় প্রেসক্লাবে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। মতবিনিময়কালে প্রিন্স আগা খান জাতীয় প্রেসক্লাবের ভবন নির্মাণে অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন। প্রিন্স আগা খান প্রেসক্লাবের ভবন নির্মাণের জন্য টাকা দিতে চান এটি জানতে পেরে প্রেসিডেন্ট জিয়া তৎকালীন প্রেসক্লাব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, প্রেসক্লাব জাতীয় প্রতিষ্ঠান। তাই বিদেশীদের টাকায় নয় এই প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন রাষ্ট্রের টাকায় হওয়া উচিত । ফলে প্রিন্স আগা খানের টাকা আর নেয়া হয়নি ।
১৯৭৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি জমির উপর জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। ক্লাবের নতুন ভবন নির্মাণের জন্য প্রেসক্লাবকে তিনি ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেন। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে জাতীয় প্রেসক্লাবের স্থায়ী ভবন উদ্বোধনের সময় প্রেসক্লাবের সভাপতি ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের তৎকালীন সম্পাদক আনোয়ার হোসেন মঞ্জু।
বিএনপি সরকারের আমলেই ১৯৯৫ সালে জাতীয় প্রেসক্লাবের পতাকা ও প্রতীক নির্বাচন করা হয়। ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ছিল জাতীয় প্রেসক্লাবের সুবর্ণজয়ন্তী অর্থাৎ প্রেসক্লাব প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর পূর্তি। প্রেসক্লাবের অর্ধশতবছরপূর্তি উপলক্ষে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া ২০০৪ সালের ২৭ নভেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবের বহুতল মিডিয়া কমপ্লেক্স ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। একই অনুষ্ঠানে বেগম খালেদা জিয়া প্রেসক্লাবের দখলে থাকা অতিরিক্ত আরো দশমিক ৮৯ একর জায়গাসহ মোট ১ দশমিক ৯৯ একর জমি ৯৯ বছরের জন্য মাত্র ১ লাখ ১ টাকার নামমাত্র মূল্যে জাতীয় প্রেস ক্লাবের নামে স্থায়ী বরাদ্দ দেন। এরপর ২০০৪ সালের ২৭ নভেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জাতীয় প্রেসক্লাবের বহুতল মিডিয়া কমপ্লেক্স ভবনের নকশাও উদ্বোধন করেন।
সুতরাং, স্বাধীন বাংলাদেশে জাতীয় প্রেসক্লাবের উন্নয়ন ও বিকাশে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এবং বেগম খালেদা জিয়া দু’জনের অবদানই অনস্বীকার্য। অথচ এখন ভুলেও তাদের নাম মুখে আনে না ক্লাব কতৃপক্ষ। এমনকি, ওই চিঠিতে বিভিন্ন সময় ক্লাবে বিভিন্ন সরকার প্রধান এসেছিলেন বলে শুধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে.. যা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ও দুর্ভাগ্যজনক।
লেখক: বেসরকারি টিভি চ্যানেলের এনটিভির বার্তা সম্পাদক