যেমন দেখেছি কাজী শাহেদ আহমেদকে

:: মুজতবা খন্দকার ::

পিতার অপরাধের ক্ষমা চেয়ে একুশ বছর পর হাসিনার আওয়ামী লীগ ঐক্যমতের সরকারের আড়ালে দেশ শাসন শুরু করার প্রথম দিকেই সরকারী ট্রাস্টের চারটি পত্রিকা বন্ধ করে দেয়। আমি ছিলাম দৈনিক বাংলার সবচেয়ে কনিষ্টতম রিপোর্টার। দৈনিক বাংলা বন্ধ করে দিলে, আমি কাজী শাহেদ আহমেদের আজকের কাগজে চাকরি নিই। এর আগে পত্রিকাটির সহযোগী সাপ্তাহিক প্রকাশনা খবরের কাগজে টুকটাক কন্ট্রিবিউট করি। মারুফ চীনু ভাই তখন খবরের কাগজ দেখাশোনা করতেন। তখন খবর কাগজের এখনকার মত এত বাড়বাড়ন্ত ছিলো না।

যাই হোক, আমি আজকের কাগজে জয়েন করি সম্ভবত ১৯৯৭ সালের মার্চ এপ্রিলের দিকে। আমি কলিগ হিসেবে পাই, অনেককে। বাদল আরেফিন,আবু বকর, মাহবুব আলম, মেসবাহ আহমেদ, আনিস আলমগীর ,শহীদুজ্জামান, আমিনুর রহমান তাজসহ আরো অনেকে। যাদের নাম এই মুহুর্তে মনে পড়ছেনা।কাজী ছিলেন মালিক সস্পাদক, তার বড়পুত্র (কাজী নাবিল আহমেদ এখন বিনাভোটে হাসিনার এমপি) নির্বাহী সম্পাদক এবং ফারুকুল হাসান নামে একজন ছিলেন ব্যবস্থাপনা সস্পাদক। জিগাতলা রাইফেল স্কোয়ারের পাশে ছিলো অফিস। আমি তিনছর সেখানে কাজ করি। এরপর মতিউর রহমান চৌধুরী একটি দুর্দান্ত যোগফল হিসেবে বাংলাবাজার পত্রিকা ছেড়ে তার অনুগত সহকর্মীদের নিয়ে মানবজমিন বের করার উদ্যোগ নিলে আমিও তাদের সে উদ্যোগে শরীক হই।

কাজীর স্বপ্ন ছিলো, এমপি হওয়া। কিন্তু কেন জানি হাসিনা তাকে কখনো নমিনেশন দেয়নি.. একবার মনে পড়ে, নমিনেশন না পেয়ে অফিসে এসে অফিসের সামনের লনে ভাস্কর রাসা নির্মিত শেখ মুজিবের ভাস্কর্যে.. হাতির লাঠি দিয়ে বার কয়েক মৃদু আঘাত করেন আর বিড় বিড় করে কি যেন বলতে থাকেন। অফিসের সবাই তখন, ভয়ে সিটিয়ে গেছে!

যা বলছিলাম,আজকের কাগজে আমার সাংবাদিকতা খুব একটা সুখকর ছিলোনা। সাবেক আর্মি কর্নেল মতান্তরে চাকরীচ্যুত কাজী শাহেদ আহমেদ,আমাদের সময়ে সাংবাদিকদের কাজে অনেক মাথা ঘামাতেন,ইন্টারফেয়ার করতেন। অনেক সময় রিপোর্টারদের তার রুমে ডেকে নিয়ে ডিক্টেট করতেন, বকাবাজি করতেন। এই রকম ব্যবহারে আমি মোটেও অভ্যস্ত ছিলাম না। কারন আমি এর আগে এমন এক প্রতিষ্ঠারে কাজ করে এসেছি। যেটা সরকারী ট্রাস্টের পত্রিকা হলেও সেখানে মোটামুটি সবাই স্বাধীনভাবে সাংবাদিকতা করতে পারতেন, মুক্ত পরিবেশে নিজের মত প্রকাশ করতেন। দৈনিক বাংলার সস্পাদক ছিলেন আহমেদ হুমায়ুন। বার্তা বিভাগে নির্মল সেন, মাহফুজ উল্লাহ, কনিকা মাহফুজ, রেজোয়ান সিদ্দিকী, সৈয়দ আব্দুল কাহহার। চীফ রিপোর্টার ছিলেন জহিরুল হক। ডাক সাইটে সব রিপোর্টার ছিলো দৈনিক বাংলায়। মনজুর আহমদ,মাশির হোসেন, শওকত আনোয়ার, নজরুল ইসলাম আরো অনেক নাম।

যাই হোক, এমন পরিবেশে এমন বিখ্যাত সাংবাদিকদের স্নেহ ধন্য এই আমি আজকের কাগজে এসে মনে হচ্ছিলো আমি আর্মি নিয়স্ত্রিত কোনো প্রতিষ্ঠানে এসেছি। আজকের কাগজকে আমার কোনো সংবাদপত্র অফিস মনে হতো না। মনে হতো কোনো মিনি ক্যান্টনমেন্ট।সবাই তটস্থ থাকতেন। কখন আবার কাজী সাহেব কার কি ভুল ধরেন।

কাজী শাহেদ সপ্তাহে একদিন নিউজ রুমে সবাইকে নিয়ে মিটিং করতেন। মিটিংয়ে তিনি এ টু জেড সবাইকে নিয়ে কথা বলতেন। প্রত্যেক মিটিংয়ে সবার সামনে কাউকে না কাউকে নানাভাবে,নানা ভাষায় হেনস্থা করতেন। আর তার সেনাবাহিনীর বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা সবাইকে শোনাতেন,বলতেন সেইভাবে চলতে.. মোট কথা তিনি সেনাবাহিনীর রুলস খবরের কাগজে কম বেশী অ্যাপ্লাই করার চেষ্টা করতেন। যেটা আমার কাছে খুব অস্বাভাবিক মনে হতো।

আমার সময়ে আজকের কাগজে সাংবাদিকতার কোনো এথিকস মেনে চলতে খুব কম দেখেছি। মোটামুটি হাসিনাপন্থী একটা কাগজ ছিলো.. বিএনপিকে প্রতিদিন নির্দয়ভাবে গালিগালাজ করতো পত্রিকাটি। নিজের তাল্লো নামে একটি তেল গ্যাস কোম্পানি ছিলো.. কিছুদিন পর পর সেটা নিয়ে রিপোর্ট করতে হতো..সেটার আবার ডিক্টেশন কাজী নিজে দিতেন। কাজী শাহেদ আহমেদের বউ কাজী আমিনা আহমেদ ছিলেন, রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী.. প্রত্যেক সপ্তাহাস্তে কাজীর ধানমন্ডি লেক পাড়ের বাসায় জলসা বসতো.. সমাজের এলিট শ্রেনীরা সেখানে আসর গুলজার করতেন। অনুষ্ঠানে গান গাইতেন আমিনা আহমেদ। সেটা কাভার করতে প্রতি স্বপ্তাহে কোন না কোনো রিপোর্টারকে যেতে হতো.. আমাকেও অনেকবার যেতে হয়েছে.. সেটা ছিলো একটা বিব্রতকর অভিজ্ঞতা…

কাজীর স্বপ্ন ছিলো এমপি হওয়া। কিন্তু কেন জানি হাসিনা তাকে কখনো নমিনেশন দেয়নি.. একবার মনে পড়ে, নমিনেশন না পেয়ে অফিসে এসে অফিসের সামনের লনে ভাস্কর রাসা নির্মিত শেখ মুজিবের ভাস্কর্যে.. হাতির লাঠি দিয়ে বার কয়েক মৃদু আঘাত করেন আর বিড় বিড় করে কি যেন বলতে থাকেন। অফিসের সবাই তখন,ভয়ে সিটিয়ে গেছে!

হাসিনা অনেক হাবিজাবি লোককে এমপি বানিয়েছেন, কাজী শাহেদকে একবার বানালে কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হতোনা.. কিন্ত কেন কাজী শাহেদকে হাসিনা পছন্দ করতেন না,সেটা একটা রহস্য!

কাজী শাহেদকে সবাই স্যার বলে সন্মোধন করতো। কিন্তু আমি কখনো তাকে স্যার বলিনি। আমার বিবেকে,রুচীতে আটকাতো… কোনো কারনে আমাকে ডাকলে.. আমি কাছে গিয়ে জানতে চাইতাম….

তিনবছর চাকরী করেছি.. এই স্বল্প সময়ে… আমি আজকের কাগজের সাংবাদিকতা এবং মালিক পক্ষের ইন্টাফেয়ারেন্স অন্য কোথাও আমি এত দেখিনি।

আনিস আলমগীর। একজন স্বাধীনচেতা মানুষ হিসেবে যার পরিচিতি আছে। অফিসে তিনি আর আমি পাশাপাশি চেয়ারে বসতাম। তাকেও দেখতাম কাজীকে স্যার স্যার বলে ডাকতে।

আমি যেদিন আজকের কাগজ থেকে রিজাইন দেই, সেদিন কাজী আমাকে ডেকেছিলেন… কথা প্রসঙ্গে বলেছিলাম, যশোরে কাজীপাড়ায় চমৎকার একটা বাড়ি বানিয়েছেন.. কিন্তু ইলেকট্রিসিটি নাই.. সব ঘরে হারিকেন। শহরে গ্রামের পরিবেশ জোর করে হয়না. ওর চেয়ে দূরে কোথাও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাংলো বাড়ি বানিয়ে সেখানে গ্রামীন পরিবেশ আনুন। আমাকে,কাজী জিজ্ঞেস করলেন? তোমার বাড়ি যশোরে.. কই কখনো তো বলোনি? আমি উত্তর দিয়েছিলাম, যশোরে আমার শৈশব, কৈশোর কেটেছে কিন্তু আমার জন্ম নড়াইলে.. তা হোক, তবু.. আমি বলেছিলাম, প্রয়োজন মনে করিনি।

লেখক: বার্তা সম্পাদক, এনটিভি

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *