:: নাগরিক নিউজ ডেস্ক ::
বৈশ্বিক মন্দায় ডিজিটাল মুদ্রা হিসাবে ব্যাপক পরিচিত বিটকয়েনের বড় ধরনের দরপতন ঘটেছে। গত বছরের নভেম্বরে প্রতিটি বিটকয়েনের দাম বেড়ে সর্বোচ্চ ৬৪ হাজার ৪০০ ডলার উঠেছিল। মঙ্গলবার তা কমে ১৯ হাজার ৭১ ডলারে নেমেছে।
বৈশ্বিক মন্দার কারণে এর দাম আরও কমার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) মঙ্গলবার প্রকাশিত গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি রিপোর্ট বা বিশ্ব আর্থিক স্থিতিশীলতা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিটকয়েন বা ডিজিটাল মুদ্রার দাম যেভাবে কমছে এতে আর্থিক খাতে ঝুঁকির মাত্রা আরও বেড়ে গেছে। কেননা বিশ্বের অনেক দেশে আন্তর্জাতিক লেনদেনে বিটকয়েন ব্যবহৃত হচ্ছে। এছাড়া সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে বিটকয়েন অন্যতম একটি উপকরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আইএমএফের ওই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার একদিন পরেই বাংলাদেশ ব্যাংক বিটকয়েন বা যে কোনো ডিজিটাল মুদ্রায় সব ধরনের লেনদেন বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে।
একই সঙ্গে এসব মুদ্রায় ডিজিটাল সম্পদ স্থানান্তর বা হস্তান্তর করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কেননা বাংলাদেশে বিটকয়েন বা ডিজিটাল মুদ্রা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এ বিষয়ে বুধবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একটি সার্কুলার জারি করে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের কাছে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তদন্তে দেশের কয়েকটি ব্যাংকের মাধ্যমে ডিজিটাল মুদ্রায় লেনদেনের তথ্য পাওয়া গেছে। বিভিন্ন দেশের ভার্চুয়াল সার্ভিস প্রোভাইডার তাদের ওয়েবসাইট বা অ্যাপের মাধ্যমে বাংলাদেশে কর্মরত কোনো কোনো তফসিলি ব্যাংকের গ্রাহকের হিসাব ব্যবহার করে ডিজিটাল মুদ্রার সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় করে ক্রয়-বিক্রয় বা সম্পদ স্থানান্তর করেছেন।
বিটকয়েনের যাত্রা শুরুতে ২০০৯ সালে এর দাম ছিল ১ ডলার বা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬২ টাকা। ওই বছর থেকেই এর দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে এর দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৯৯ ডলারে। ২০১৫ সালের নভেম্বরে ৩২৭ ডলার বা ২৬ হাজার ১৬০ টাকা। ২০১৬ সালের নভেম্বরে দ্বিগুণ বেড়ে হয় ৭৩৫ ডলার। ২০১৭ সালের নভেম্বরে নয়গুণ বেড়ে হয় ৮ হাজার ৭৯৫ ডলার।
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে প্রায় আড়াই গুণ বেড়ে দাঁড়ায় ১৯ হাজার ৬৫০ ডলারে। এরপর এর দাম কমতে থাকে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে দাম কমে ৩ হাজার ১৮৩ ডলারে দাঁড়ায়। ২০১৯ সালে আবার এর দাম বাড়তে থাকে। ওই বছরের জুলাইয়ে দাম বেড়ে হয় ১১ হাজার ৩৭০ ডলার। ২০২০ সালের মার্চে আরও বেড়ে হয় ৫ হাজার ১৬৫ ডলার। ২০২০ সালের নভেম্বরে দাম তিনগুণ বেড়ে হয় ১৯ হাজার ১৩৫ ডলার।
২০২১ সালের মার্চে আড়াই গুণ বেড়ে হয় ৪৮ হাজার ৯০৯ ডলার। ২০২১ সালের জুলাইয়ে দাম আবার কমে ৩৩ হাজার ৫১৫ ডলারে নেমে যায়। একই বছরের নভেম্বরে বিটকয়েনের দাম এর ইতিহাসে সর্বোচ্চ বেড়ে ৬৪ হাজার ৪০০ ডলারে উঠে। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫৫ লাখ ৩৮ হাজার টাকা। এর মধ্যে করোনার নেতিবাচক প্রভাব প্রকট হয়ে উঠলে বিশ্ব মন্দা শুরু হয়ে যায়। ফলে বিটকয়েনের দামও কমতে থাকে।
চলতি বছরের শুরুতে দাম কমে অর্ধেকে নেমে আসে। এ বছরের জানুয়ারিতে এর দাম দাঁড়ায় ৩৫ হাজার ৭০ ডলারে। এপ্রিলে কিছুটা বেড়ে ৪৫ হাজার ৮৫৭ ডলারে উঠে। জুনে দাম আরও কমে ১৮ হাজার ৯৪৮ ডলারে নেমে যায়। আগস্টে সামান্য বেড়ে ২৪ হাজার ৪৬১ ডলারে উঠে। মঙ্গলবার এর দাম কমে ১৯ হাজার ৭১ ডলারে দাঁড়ায়। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ২০ লাখ ৪১ হাজার টাকা।
আলোচ্য সময়ে এর দাম ব্যাপকভাবে ওঠানামা করেছে। তবে দাম কমার চেয়ে বেড়েছে বহুগুণ বেশি। যে কারণে বিটকয়েনে বড় ঝুঁকি নিয়ে যারা বিনিয়োগ করেছেন তাদের অনেকে রাতারাতি ধনী হয়েছেন। বিটকয়েন থেকে অন্য মুদ্রায় রূপান্তর করে তা দিয়ে করেছেন বাড়ি-গাড়ি। সূত্র জানায়, বিটকয়েন বা ডিজিটাল মুদ্রায় বিনিয়োগ করে দ্রুত সম্পদ বাড়ার কারণে ও সহজে লেনদেন করার সুযোগে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
এতে বড় বিনিয়োগকারীরা যেমন অর্থ লগ্নি করছেন, তেমনি একে আন্তর্জাতিক লেনদেন ও সঞ্চয়ের উপকরণ হিসাবেও ব্যবহার করছেন। কর ফাঁকি দিয়ে সম্পদ গোপন করার ক্ষেত্রেও বিটকয়েন ব্যবহৃত হচ্ছে। এর দাম অনেক বেশি। দ্রুত দাম বাড়ে। পুরোটাই অদৃশ্যভাবে বা ডিজিটাল ফরমে রাখা যায় এ কারণে সম্পদ গোপন করতে এর কদর বেশি। এছাড়া অর্থ পাচার, চোরাচালানের দেনা পরিশোধেও বিটকয়েন ব্যবহৃত হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন দেশ, কানাডা, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়াসহ ৭২টি দেশে বিটকয়েনের ব্যবসা চলছে। ভারতেও এর ব্যবসার পরিধি বাড়ছে। জার্মানিতে বিটকয়েন ‘ব্যক্তিগত মুদ্রা বা প্রাইভেট কারেন্সি’ হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। চীন তাদের দেশে ব্যক্তিগত কারেন্সি হিসাবে বিকল্প ভার্চুয়াল মুদ্রা বাজারে ছেড়েছে। ভারত নিজস্ব ডিজিটাল মুদ্রা বাজারে ছাড়ার উদ্যোগ নিয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্কুলারে বলা হয়েছে, ইতোমধ্যে ভার্চুয়াল সম্পদ ও ভার্চুয়াল মুদ্রা লেনদেন এবং তাদের বিনিময়, স্থানান্তর, বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত ব্যবসা ও এ সংক্রান্ত যে কোনো ধরনের কার্যক্রমে সহায়তা প্রদান থেকে বিরত থাকতে হবে। পাশাপাশি এ বিষয়ে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করে মনিটরিং কার্যক্রম বাড়াতে ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে।
নির্দেশনায় আরও বলা হয়, এখন থেকে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়, সব শাখা, উপশাখা ও এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেটগুলোতে দর্শনীয় স্থানে জনসাধারণের অবগতির লক্ষ্যে তাদের বোধগম্য করে নোটিশ বোর্ডে প্রদর্শন এবং ওয়েবসাইটের হোম পেজে প্রকাশ করে তা নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি প্রশিক্ষণ প্রোগ্রামে প্রশিক্ষণার্থীদের সার্কুলারটির বিষয়গুলো জানাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।