বিদায় কবি আসাদ চৌধুরী

:: এহসান মাহমুদ ::

প্রায় ১০-১১ বছর আগের ঘটনা। বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ থেকে লঞ্চে করে ভাসানচরে যাচ্ছি ফুফুর বাড়িতে। আমার অবস্থা তখন এই মাদারীপুরে গ্রামের বাড়িতে, এই সাভারে, এই বরিশাল, ঢাকায় যাত্রা বিরতি আবার রাজশাহী। এরই মাঝে বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পে অংশ নেওয়া। সেদিন পাতারহাট থেকে ছোট্ট দেড়তলা লঞ্চে রওনা দিয়েছি, ভরদুপুরে হঠাৎ আকাশ মেঘ করে ঘন কালো হয়ে পড়ল। মাঝ নদীতে ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির পানিতে ডেকের যাত্রীরা সব মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে। আমিও ভিড়ের মধ্যে শরীর ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। শরীরের নিচের অংশ পায়ের দিকটা, জুতো ভিজে চুপচুপে হয়ে গেল। এরই মাঝে চোখ পড়ল ডেকের একদম কিনারে চেয়ারে একজন বসে আছেন। বৃষ্টি নিয়ে তার প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না! একটু পরে খেয়াল করে দেখলাম কাঁধে থাকা ব্যাগ থেকে পানের বাটা বের করলেন। খুব ধীরে সুস্থে পান ভাঁজ করে মুখের মধ্যে নিলেন। পানির একটি বোটায় চুন লাগিয়ে নিলেন আরো ধীরে সুস্থে খুব যত্ন করে। আমার আশেপাশের কয়েকজনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম তারাও খুব মনোযোগ দিয়ে এই দৃশ্য খেয়াল করছেন। একটা সময় দেখলাম তিনি পানের পিক ফেলার জন্য ঘাড় বাঁকা করে মুখ নিচু করলেন। ব্যাক ব্রাশের সাদা চুল, থুতনির নিচে সামান্য দাড়ি। আরে এটাতো আসাদ ভাই দেখছি!

আজকেও সকাল থেকে ঢাকায় বৃষ্টি হচ্ছে , এই বৃষ্টির মধ্যেই খবর পেলাম কানাডায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন আসাদ ভাই। গত কয়েক বছর ধরেই আসাদ ভাই কানাডা প্রবাসী হয়েছিলেন। শেষবার যখন ঢাকায় ফিরলেন তখনও শরীরে বেশ অসুস্থতা নিয়েই ফিরেছিলেন। একবারের জন্য দেখা করতে গিয়েছিলাম। আগের মত খলবলিয়ে হাসতে দেখা গেল না সেদিন। পাশে বসার পরে আমার হাতটি টেনে নিয়ে ধরে রাখলেন কিছুক্ষণ। তাতেই মনে হলো, আমার প্রতি তার স্নেহ ও প্রশ্রয় আগের মতই আছে।

দেরি না করে বৃষ্টির দিকে এগিয়ে গেলাম। আরে তুমি যে এহসান! দেখো কি সুন্দর বৃষ্টি! আসাদ ভাই আরেকটি চেয়ার দেখিয়ে দিলেন, বৃষ্টির মধ্যে সেই চেয়ারে বসে পড়লাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো। আসাদ ভাই শুরু করলেন তাদের উলানিয়ার কথা। মিনিট পাঁচেক পরে আমার কাছে জানতে চাইলেন, তা তুমি কি মনে করে, কোন দিকে যাচ্ছ?

জানালাম ফুফুর বাড়িতে যাচ্ছি ভাসানচরে। আমার ফুফার নাম জানতে চাইলেন, বললাম মাওলানা নুরুল ইসলাম হাওলাদার। আসাদ ভাই বললেন, শিক্ষকতা করেন না? আমি মাথা নাড়লাম। এরপরে আমাকে তিনি উলানিয়া নিতে চাইলেন সঙ্গী করে। আমি অপরাগতা প্রকাশ করলাম। বললেন, বহুদিন পরে এরকম ঘুরে বেড়াচ্ছি বরিশালের নদী মাঝে।

বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পের সূত্র ধরে এবং আরো পরে পত্রিকায় কাজের সুবাদে আসাদ ভাইয়ের সঙ্গে অসংখ্যবার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে। ঢাকায় তার কল্যাণপুরের বাসায় বহুদিন সকালে নাস্তা খেয়েছি। কিন্তু বরিশালে নদীর মাঝে বৃষ্টির মধ্যে লঞ্চে যেভাবে আসাদ ভাইকে পেয়েছিলাম, সেটা একেবারেই অন্যরকম! নদীর মতো খলবলে এমনিতেই তার হাসি ছিল, সঙ্গে মিষ্টি জর্দার সুবাস। আসাদ ভাইকে সেদিন নদীপুত্র মনে হয়েছিল।

আজকেও সকাল থেকে ঢাকায় বৃষ্টি হচ্ছে , এই বৃষ্টির মধ্যেই খবর পেলাম কানাডায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন আসাদ ভাই। গত কয়েক বছর ধরেই আসাদ ভাই কানাডা প্রবাসী হয়েছিলেন। শেষবার যখন ঢাকায় ফিরলেন তখনও শরীরে বেশ অসুস্থতা নিয়েই ফিরেছিলেন। একবারের জন্য দেখা করতে গিয়েছিলাম। আগের মত খলবলিয়ে হাসতে দেখা গেল না সেদিন। পাশে বসার পরে আমার হাতটি টেনে নিয়ে ধরে রাখলেন কিছুক্ষণ। তাতেই মনে হলো, আমার প্রতি তার স্নেহ ও প্রশ্রয় আগের মতই আছে।

আজকে ঢাকায় যখন বৃষ্টির মধ্যে আসাদ ভাইয়ের মৃত্যুর খবর পেলাম, তখন মনে হলো – বরিশালের উলানিয়াতে কি এখন বৃষ্টি হচ্ছে?

বিদায় আসাদ ভাই, বিদায় কবি আসাদ চৌধুরী!

লেখক: সাংবাদিক

সম্পর্কিত লেখা:

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *