ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাকে নিয়ে আমাদের আশ্চর্য আবেগ

:: কাদের গনি চৌধুরী ::

ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা তো আমাদের কাছে কেবল দুটো দেশ না। মেসি-নেইমার কেবল দুটো নাম না। বরং আমাদের আশ্চর্য আবেগ। আমাদের হৃদয়ের অবাক অনুভূতি। তাইতো এ দু’দলের খেলা হলে আমাদের স্নায়ুর চাপ বেড়ে যায়। এর প্রতিফলন আমরা ক’দিন ধরে দেখছি ফেসবুকে। আর কয়েক ঘন্টা বাকি। এমন এক ফাইনালের জন্য সবার অপেক্ষা। প্রজন্মের প্রতীক্ষা। কোপা আমেরিকার শিরোপা লড়াইয়ে মুখোমুখি যে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা! সেখানে কি লিওনেল মেসি নামে অত্যাশ্চর্য ফুটবল জাদুকরের ক্যারিয়ারের ‘চাঁদের কলঙ্ক’ ঘুচবে? নাকি নেইমারের অর্জনের আকাশে আঁকা হবে সূর্যের ছবি? এই যে ফাইনালে মুখোমুখি মেসি-নেইমার কিংবা আরও বড় ক্যানভাসে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, তাতে রোমাঞ্চের ঢেউ খেলে যাচ্ছে আমাদের লাল-সবুজের মানচিত্রেও। বাংলাদেশের গ্রামে কি শহরে করোনার অতিমারিতেও উড়ছে লাল সবুজের পতাকার পাশাপাশি ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার পতাকা। পৃথিবীর মানচিত্রের অন্য প্রান্তে পড়ে আছি আমরা। সকালের সূর্য যখন রাঙিয়ে দেয় ছোট্ট এ ব-দ্বীপ, গোলার্ধের অন্য দিকের ব্রাজিল-আর্জেন্টিনায় তখন সন্ধ্যার অস্তরাগ।

ওই অত দূরের দেশ দুটোর জন্যও আমাদের সমর্থনের কী পাগলপারা অনুরাগ! ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার মুখোমুখিতে আমরা তাই উত্তেজনায় কাঁপি। উন্মাদনায় ভাসি। বলুন তো, কী হবে, যদি প্রিয় মেসির হাতে কোপার ট্রফি না ওঠে? কিংবা প্রিয় ব্রাজিল যদি আরেক মারাকানা-ট্র্যাজেডির শিকার হয়? হয়তো কিছুই না। কিন্তু সমর্থনের ব্যাপারটাই তো এমন! যে কারণে প্রিয় দলের ব্যর্থতার আশঙ্কায় সর্বস্ব হারানোর ভয় করি। কিংবা সাফল্য-সম্ভাবনায় যাপিত জীবনের সমস্ত গ্লানি মুছে যাওয়ার আশা দেখি। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার জন্য ভালোবাসায় পুরো পৃথিবীতেই আমরা তুলনাহীন। যার শেকড় ‘পেলে-ম্যারাডোনায়’। যা ডালপালা ছড়ায় ‘মেসি-নেইমারে’। সমকাল ছাড়িয়ে মহাকালের সেরাদের মধ্যে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন মেসি। সেটিও ঢের আগে। বল পায়ে তিনি শিল্পী। ফুটবল মাঠে তিনি কবি। মাঠের সবুজে অপূর্ব সব কাব্যগাঁথা লিখে চলেন পায়ের কারিকুরিতে। আবার নেইমারের পায়ে ফুটবল মানে ছন্দখেলে। ছন্দে ছন্দে তিনি যেন আমাদের নিয়ে যান অন্য জগতে। নেইমার পা দিয়ে নয়, যেন হৃদয় দিয়ে ফুটবল খেলেন।নেইমারের পায়ে ফুটবল মানে ছন্দ। নেইমারের পায়ে বল মানে প্রতিপক্ষের বুকে কম্পন। ক্লাব বার্সেলোনার হয়ে দু’কূল উপচানো সাফল্য আসে; আসতেই থাকে। ব্যক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতিগুলো অবিরাম তার প্রতিভায় কুর্নিশ করে; করতেই থাকে।

প্রিয় দলের জন্য। প্রিয় খেলোয়াড়ের জন্য। তবে আমাদের এতো অবেগ আর ভালোবাসাকে আমরা যেন কলঙ্কিত না করি উশৃংখল আচরণে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতো হিংস্রতার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে। হিংস্রতাতো পশুদের মানায় মানুষকে নয়। কই যাদের এই খেলা তাদের দেশেতো এমন হিংস্রতা দেখিনা। বিজয়ী ও বিজিত দলের খেলোয়াড়রাতো খেলা শেষে একে অন্যের সাথে হাতে হাত বা বুকে বুক মিলিয়ে শুভেচ্ছা জানায়। তারা পারলে আমরা কেন পারবো না?

সাফল্যের সেই স্বর্ণমুকুটেও কাঁটার খচখচানি কেবল এক জায়গায়। আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের হয়ে যে কখনো কোনো ট্রফি উঁচিয়ে ধরা হয়নি মেসির! জীবন তাকে সে সুযোগ তো কতবারই দিল! একবার, দুবার, বারবার। ২০০৭ সালের কোপা আমেরিকার ফাইনালে যখন খেলেন মেসি, তখন না হয় ক্যারিয়ারের কেবল উন্মেষকাল! কিন্তু ২০১৪ বিশ্বকাপ? কিংবা ২০১৫ কোপা আমেরিকা? অথবা ২০১৬ সালের ওই লাতিন শ্রেষ্ঠত্বের আসর? ততদিনে তো মেসির ক্যারিয়ার পূর্ণ আভায় উদ্ভাসিত। ফাইনাল জিতে পূর্ণতার ছবি আঁকার উপলক্ষ ছিল প্রতিবার। মেসি পারেননি। পর পর তিন বছর। পর পর তিন ফাইনালে। নিজে ব্যর্থ। সতীর্থরা আরও বেশি যেন। ফাইনালে গনজালো হিগুয়াইন যদি অমন সহজ সুযোগগুলো গোল করতে না পারেন, তাতে কী-ই-বা করার থাকে তার? আবার টাইব্রেকারের ভাগ্য পরীক্ষায় যদি ফুটবল-বিধাতা বিমুখ করেন, তখনো যেন নিয়তির কাছে আত্মসমর্পণের বিকল্প থাকে না। মেসি তবু হাল ছাড়েন না। ক্যারিয়ারের গোধূলি বেলায় নিজের সর্বস্ব ঢেলে দেন আরেকটিবার। এবারের কোপা আমেরিকায় আর্জেন্টিনার জার্সিতে পারফরম্যান্সের মশাল জ্বালান। চার-চারটি গোলে; পাঁচ-পাঁচটি অ্যাসিস্টে। সেমিফাইনালে পেরুর বিপক্ষে রক্তাক্ত হন তিনি। কিন্তু হাল ছাড়েন না। হৃদয়ের রক্তক্ষরণ দূর করার সংকল্পে শিল্পী থেকে হয়ে ওঠেন যোদ্ধা। লড়াই করে যান দাঁতে দাঁত চেপে। শেষে টাইব্রেকার বীরত্বে মেসির স্বপ্নটা বাঁচিয়ে রাখেন সতীর্থ গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেজ। অর্জন আর বিসর্জনের অভিন্ন বিন্দুতে তাই দাঁড়িয়ে মেসি আর নেইমার।

ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা। তাদের জন্য বিশ্ব ফুটবল মানচিত্রের এই ছোট্ট বিন্দু বাংলাদেশে থরথর উত্তেজনা। ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে মেসির চির দুঃখ, চিরন্তন হাহাকার, চিরতরে মুছে ফেলার সুযোগ এসেছে তাই আবার। আরেকবার। কাজটি সহজ নয়। প্রতিপক্ষ ব্রাজিল বলে কথা। যে দলের প্রাণ ভোমরা আরেক ফুটবল জাদুকর নেইমার। বিশ্ব ফুটবলের রাজত্বটা এক সময় যার হবে বলে ক্যারিয়ারের শুরু থেকেই প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অর্জন নেহায়েত কম নয় নেইমারের। বিশেষত জাতীয় দলের জার্সিতে বরাবরই উজ্জ্বল। কোনো কোনো জায়গায় হয়তো মেসির চেয়েও বেশি। গোলে। অ্যাসিস্টে। কিংবা ধরুন, ওই ২০১৩ কনফেডারেশনস কাপের ট্রফি জয়ে। অথবা ২০১৬ অলিম্পিক স্বর্ণপদক জয়ের অভিযানে। এ পদক মেসিও জিতেছেন। তবে তা মূল জাতীয় দলের হয়ে তার ব্যর্থতাগুলোই যেন প্রকট করে আরও। নেইমারের বেলায় সেটিই বীরত্ব হয়ে যায় সর্বোচ্চ পাঁচটি বিশ্বকাপ জেতা ব্রাজিলের ফুটবল ইতিহাসের প্রথম অলিম্পিক স্বর্ণপদক জয় বলে! তবে বিশ্বকাপ কিংবা কোপা আমেরিকা নেইমারের জন্যও দুঃখ গাঁথা। ব্যর্থতায়; লাল কার্ডে; ইনজুরিতে; অভিনয়ের সমালোচনায়। সেসব পিছু ফেলে নতুন ইতিহাস ডাকছে নেইমারকে।

কোপার ফাইনালে মারাকানার মঞ্চে ট্রফির হাতছানি তার সামনেও। অর্জন আর বিসর্জনের অভিন্ন বিন্দুতে তাই দাঁড়িয়ে মেসি আর নেইমার। ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা। তাদের জন্য বিশ্ব ফুটবল মানচিত্রের এই ছোট্ট বিন্দু বাংলাদেশে থরথর উত্তেজনা। তুমুল তর্ক আর বিরামহীন বিতর্ক। এর মধ্যেও আমাদের সবার মনের কোণে বেজে চলে প্রার্থনার আবহ সঙ্গীত। প্রিয় দলের জন্য। প্রিয় খেলোয়াড়ের জন্য। তবে আমাদের এতো অবেগ আর ভালোবাসাকে আমরা যেন কলঙ্কিত না করি উশৃংখল আচরণে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতো হিংস্রতার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে। হিংস্রতাতো পশুদের মানায় মানুষকে নয়। কই যাদের এই খেলা তাদের দেশেতো এমন হিংস্রতা দেখিনা। বিজয়ী ও বিজিত দলের খেলোয়াড়রাতো খেলা শেষে একে অন্যের সাথে হাতে হাত বা বুকে বুক মিলিয়ে শুভেচ্ছা জানায়। তারা পারলে আমরা কেন পারবো না?

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *