:: ফয়েজ আহমদ তৈয়ব ::
বিষয়টা হচ্ছে, আপনি যখন কোন দেশের মাল বর্জন করবেন তার আগে আপনাকে বুঝতে হবে যে- কোনটা ভুসি মাল, কোনটা দরকারি মাল, কোনটা বেদরকারি মাল এবং কোনটা রাজনৈতিক মাল।
সমুদয় মাল এগুলোকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায়- সফট মাল এবং হার্ড মাল।
সফট মালের মধ্যে আছে বুদ্ধিবৃত্তিক মাল, এখানে আছে কিছু রাবীন্দ্রিক ব্যাপার স্যাপারও।
ভারত ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে যে মালগুলো বিক্রি করে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় মাল হচ্ছে ব্রাহ্মণ্যবাদ। পারলে সবার আগে এইটারেই বর্জন করেন।
এখন বলতে পারেন যে তাহলে বাংলাদেশ ভারতের মধ্যকার এই যে ১৬+ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক বাণিজ্য, সেটা কি?
২০১১-১২ অর্থ বছরে ভারত বাংলাদেশে পাঠিয়েছে ৪৭৪ কোটি ডলারের পণ্য। এক দশক পর ২০২১-২২ অর্থবছরে সেটা বেড়ে হয়েছে ১ হাজার ৩৬৯ কোটি ডলারের পণ্যে। পরিবর্তিত বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং ডলারের মূল্যবৃদ্ধিসহ অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ২০২২-২৩ অর্থবছরে আমদানি কিছুটা কমে ১ হাজার ৬৩ ডলার হয়েছে। গত এক দশকে বাংলাদেশ ভারত থেকে আমদানি তিন গুণ বাড়িয়েছে। তবে বাংলাদেশ ভারত থেকে উল্লেখযোগ্য কাঁচামাল আমদানি করে। যদিও নতুন বড় আমদানি (রাজনৈতিক আমদানি) খাত হচ্ছে বিদ্যুৎ (আদানি ও ক্রস বর্ডার)। উল্টোদিকে বাংলাদেশ ২০২১-২২ অর্থ বছরে পাঠাতে পেরেছিল ১৯৯ কোটি ডলারের পণ্য। যা একই উৎস থেকে ঐ বছরের আমদানির ১৪-১৫ ভাগ মাত্র। গত অর্থ বছরে সেটা আরও কমে হয়েছে ১৮৬ কোটি ডলার সমান। (২৩ নভেম্বর ২০২৩, প্রথম আলো)। তবে দশ বছরে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি দ্বিগুণ হয়েছে, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বাণিজ্য ব্যবধান ১৪+ বিলিয়ন ডলার।
ভারত থেকে করা আমদানিকে কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়
ধরেন একটা মনে হচ্ছে দরকারি মাল । বাংলাদেশ ভারত থেকে যে পণ্য আমদানি করে সে পণ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল তুলা, আমাদের নির্মাণ শিল্পের বা সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল। এখানে আছে তুলা, ফ্লাই এশ, বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল, রঙ, এমনকি রান্নার গ্যাস অর্থাৎ এলপি গ্যাসের কাঁচামালও। আছে কিছু মেশিনারি যদিও মূল মেশিনারি চীন থেকে আসে।
যত দিন আপনি এসব উৎপাদন করবে না, ততদিন এধার থেকে ওধার করতে হবে। অর্থাৎ দরকারি ভারতীয় পণ্য বর্জন মানে হচ্ছে চীনের কাছ থেকে আমদানি করতে হবে। এতে চীনারা দাম বাড়িয়ে বেশি লাভ করবে, কারণ তাঁরা জানবে আপনার বিকল্প কমে গেছে। বাজার ডায়নামিক্স।
বাংলাদেশে যে পরিমাণ খাদ্যশস্য আমদানি করে তার শীর্ষস্থানীয় আমদানি হয় ভারত থেকে। সরকারের খাদ্য স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার দাবিকে মিথ্যা প্রমাণ করে জাতিসংঘের বিশ্ব খায় সংস্থা ২০২১ সালে বাংলাদেশে পৃথিবীতে খাদ্য আমদানিকারক দেশ হিসেবে তৃতীয় স্থানে এসেছে। বাংলাদেশ প্রায় সোয়া এক কোটি ম্যাট্রিক টন খাদ্য আমদানি করেছে, স্পষ্টভাবেই চাল ডাল পেঁয়াজ ভুট্টা গম সহ অধিকাংশ কৃষি পণ্য ভারত থেকে আমদানি করেছে। (আমি এটাকে ভাল পাই, এর মাধ্যমে আমরা ভারতের বন্ধ করে দেয়া, সরিয়ে নেয়া পানিটা পরোক্ষভাবে ব্যবহার করি)
তবে বাজার সুবিধার কারণে, গুদামজাত করতে হয় না বলে, সহজ পরিবহণের কারণে এবং দ্রুত এলসি খুলে সহজ আমদানি বলে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ভারত থেকে এ ধরনের খাদ্যপণ্য আমদানি করতে কমফোর্ট ফিল করে, এটাকে আপনি বন্ধ করতে গেলে বিপদ বাড়বে, কমবে না। হ্যাঁ কৃষি পণ্য আমদানি বর্জন করতে হলে, বাংলাদেশের কৃষিতে প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগিয়ে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে হবে, ভূমি ব্যবহার অত্যন্ত দক্ষ করতে হবে। নতুবা ভারত বয়কট মানে হচ্ছে, চীন সহ বিকল্প সোর্স থেকে কেনা। মজুদ ট্রান্সপোর্টেশানের খরচ।
হ্যাঁ গুরুত্বপূর্ণ আমদানির বিকল্প বাজার থাকলে সেটা খুব ভালো হয়, আমদানির উৎস বহুমুখীকরণ করোনার বড় শিক্ষা। ভারত প্রায়ই কিছু কিছু পণ্যে রপ্তানি বন্ধ করে বাংলাদেশে সংকট তৈরি করে। যেমন চাল পেঁয়াজ।
তথাপি এটা একটা বাজার ডায়নামিক্স চাইলেই ব্যবসায়ীদেরকে এখান থেকে সরিয়ে নেয়া যাবে না, পেঁয়াজ বা এজাতীয় আমদানি মিশর বা পাকিস্তান বা ইউরোপ বা চীন থেকে করলে লিড-টাইম বেশি লাগে এবং আপনার স্টোরেজ লাগে সেজন্য এই আমদানি গুলো ভারত থেকে করাকেই ব্যবসায়ীরা প্রাধান্য দেয়।
বাজার ডায়নামিক্স আরও আছে। ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে বাংলাদেশ ও ভারত গত ১১ জুলাই’২৩ দুই দেশের বাণিজ্যে রুপি ব্যবহার শুরু করে। কিন্তু, বছর শেষে লেনদেনের পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, ভারতীয় মুদ্রায় ব্যবসা করায় আগ্রহ কম।বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের আমদানি-রপ্তানির মোট পরিমাণ প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলারের, কিন্তু, ১১ জুলাই ২৩ থেকে ২৬ ডিসেম্বর’২৩ এর মধ্যে শুধু ইস্টার্ন ব্যাংক ও এসসিবি ৩৫ লাখ ১০ হাজার রুপির আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য নিষ্পত্তি করেছে। বাংলাদেশের রপ্তানি কম এবং ভারতে শ্রম বাজার নাই বলে বাংলাদেশের রুপি আয়ের পথ কম বলে, রুপি নাই- তাই ব্যবসায়ীরা রুপিতে বাণিজ্য না করে ডলারেই করছে।
অনেকেই বলে ভারতের একটা কৌশলগত পণ্য হচ্ছে বিদেশি ঋণ কিংবা সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট। আসলে এটা কাজীর গরু, কেতাবে আছে গোয়ালে নাই। ভারত অর্থনৈতিক ভাবে অনুদার এক দেশে। অনেক প্রতিশ্রুতি আছে, কিন্তু ঋণ ছাড় খুবই নগণ্য; তিনটি এলওসির ছাড় মাত্র ১.৪৯ বিলিয়ন ডলার এক দশকে। এসময় শুধু বিশ্বব্যাংক থেকে বাংলাদেশ ঋণ নিয়েছে ২২ বিলিয়ন ডলার।
এ পর্যায়ে আসেন বেদরকারি আমদানির নিয়ে বলি। বলতে পারেন ভারতে ট্রিটমেন্ট এবং মেডিকেল ট্যুরিজম বেদরকারি। ভারতের সিনেমা, বিকল্প থাকা বিভিন্ন ভোগ্য পণ্য এসব বেসরকারি। তবে বিনোদনের লিমিট তো লিমিট বা ব্লক করা যায় না! বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর বিদেশ যাওয়া পর্যটকদের বড় অংশ ‘মেডিক্যাল টুরিস্ট’। ভারতের মোট পর্যটকদের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান এখন দ্বিতীয়। মূলত চিকিৎসার জন্য বেশি গেলেও বিষয়টা ‘মেডিক্যাল ট্যুরিজম’ হয়ে গেছে। অর্থাৎ চিকিৎসার জন্য গেলেও, সেখানে কেনাকাটা ও ঘোরাঘুরিও করেন প্রচুর। এতে বাংলাদেশ থেকে বৈধ-অবৈধ পথে ডলারের আউট-ফ্লো বাড়ছে।
বাংলাদেশ স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করছে না বলে বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা একদিকে অত্যন্ত খরচে অন্যদিকে নিম্নমানের। এই বিষয়টার দুটি দিক আছে- দেশে স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ করে স্বাস্থ্যসেবার মানকে এমন পর্যায়ে উঠানো যেখানে ভারতে কম রুগি যাবে। আর অন্য দিকটা হচ্ছে ভারতবান্ধব বা ভারতের সরকার ক্ষমতায় বলে সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে দেশের স্বাস্থ্য বিনিয়োগ কম করছে যাতে বেশি রোগী ভারতে যেতে পারে। ভারতের বৈদেশিক মুদ্রার ইনফ্লো বাড়াতে পারে। এই যে বর্তমানে নতুন শিক্ষাক্রমের নামে একটা বিপর্যয় তৈরি করা হয়েছে এটাও ভারতের উপর বাংলাদেশের শিক্ষা নির্ভরতা তৈরি করবে, বৈদেশিক মুদ্রার ইনফ্লো বাড়াবে।
একই কথা প্রযোজ্য বাংলাদেশে কর্মরত ভারতীয় দক্ষ শ্রমিকদের বিষয়। যতদিন শিক্ষা দক্ষতায় বিনিয়োগ না হবে, ততদিন ভারতীয় এক্সপার্ট শ্রমিক আসতে থাকবে। বিষয়টা হচ্ছে ভারতের প্রভাবিত বাংলাদেশ সরকার দক্ষতায় পর্যাপ্ত বিনিয়োগ চায় কিনা! বয়কটের সাথে সাথে এই ফয়সালাই আগে দরকার।
পরের পর্যায়ে আছে কিছু রাজনৈতিক পণ্য বা মাল আমদানি। এর মধ্যে প্রথমেই আছে আদানির বিদ্যুৎ টাইপের মাল, দরকার নাই, কিন্তু আমদানিতে বাধ্য। এসব মাল বয়কটা করা বেশি দরকার। যেগুলো ভোটহীন ক্ষমতায় থাকার চাঁদা হিসেবে আওয়ামীলীগকে ভারতকে দিতে হচ্ছে।
ভারতের স্বার্থে বাণিজ্য চুক্তিগুলো যেভাবে হওয়া দরকার, সেগুলো সেভাবে করে দেওয়ার জন্য আমাদের আছে একদল দালাল আমলা। তার পক্ষে সমর্থন তৈরি করার জন্য আছে একদল দালাল সাংবাদিক। ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া চাহিদা যেমন- তিস্তার পানি অধিকার ইত্যাদি না চাওয়ার জন্য দালাল রা এসব এজেন্ডা থেকে বাদ দেয়, সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুইয়েন্সাররা চুপ থাকে। তাদের অনুরোধ করেও এসব নিয়ে বলানো যায় না। এরা অধিকাংশই জাতে ব্রাহ্মণ।
তাই সবকিছুকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশ ভারত থেকে যা কিনে তার মধ্যে সর্ব প্রধান হচ্ছে ভুসিমাল।
ভুসিমালের মধ্যে আছে দালাল আমলা, দালাল সাংবাদিক, দালাল উপদেষ্টা/বুদ্ধিজীবী/সাংবাদিক, এবং অধুনা দালাল সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুইয়েন্সার। র এগুলার কিছুরে পালে। এগুলা ডাবল প্লে করে, সামনে শেখ হাসিনারে গাইলায়, পেছনে শেখ হাসিনার মেকানিজম সেট করে দেয়। এগুলার লাইগা বিরোধীরা স্বাধীন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। এদের কেউ আবার বিনা টাকায় লেবার দেয়। ভারতীয় গোয়েন্দার বইতে এইটারে বলসে ‘কস্ট লেস অপারেশন’ মানে ফাও গোলামি সেবা। এই দালালদের কাজ হচ্ছে, ভারত যেভাবে চায় ঠিক সেভাবে বিরোধী রাজনৈতিক দলের পলিটিক্যাল এজেন্ডা সেট করে দেওয়া। যেমন ধরেন ২০১৪ সালে যদি ভারত চেয়ে থাকে বিএনপি নির্বাচনের বাইরে থাকুক তারা সেভাবেই বিএনপিকে তৈরি করেছে। ২০১৮ সালে বিএনপি নির্বাচনে যাক তারা সেভাবেই তৈরি করেছে ঐক্যফ্রন্টকে। এবং ২০২৪ সালে ভারত আর যুক্তরাষ্ট্র শেখ হাসিনারে ফেলে দিবে এটাও এই উপদেষ্টাদেরই বয়ান। এখন ইউটিউব ব্যবসা বন্ধের উপক্রম হইসে বলে বলা ধরসে, বিএনপি পারে নাই, ভারতের পণ্য বয়কট করো!
তাই বলি বাংলাদেশ ভারত থেকে যত মাল আমদানি করে, সবগুলার মধ্যে মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার নামে এই ভুসি মাল সর্বনিকৃষ্ট মাল। এরা বুদ্ধিবৃত্তিক রাজনৈতিক মাল বিক্রি করে, দেশের বিরোধী রাজনীতিকে পরাজিত করার ক্রমাগত আয়োজন সেরে, তাদের সোশ্যাল ক্রেডিবিলিটি ধ্বংস করে- অন্য সব মাল আমদানির পথ খুলে রাখসে। বিকল্প পণ্য থাকা দরকারি বয়কট আপনি অবশ্যই করবেন। আর সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ভারতীয় পণ্য হচ্ছে বর্তমান সরকার। এই সরকারকে বয়কট করাই, এর বিরুদ্ধে গণ আন্দোলনই সবচেয়ে বড় বয়কট।
এখন বিষয়টা আপনার উপর, আপনি কি ভুসিমাল বয়কট করবেন নাকি দরকারি মাল বয়কট করবেন, শিল্পের কাঁচামাল বয়কট করবেন নাকি ব্রাহ্মণ্যবাদ বয়কট করবেন! সিদ্ধান্ত এবং স্বাধীনতা দুটাই আপনার।
লেখক: টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক ও গবেষক