মুক্তিযুদ্ধের সুফল কতটা সার্বজনীন

:: ফারহান আরিফ ::

১৯৭১ সালের ১৬ ই ডিসেম্বরের বিজয়ের মাধ্যমে আমরা পরাধীনতার গ্লানি থেকে মুক্তি পেয়েছি। কিন্তু যে স্বপ্ন ও দাবীগুলো নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিলো, তার কতটুকু পূরণ হয়েছে? যে চেতনা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিলো, তার কতটুকু বর্তমান? মুক্তিযুদ্ধকে, মুক্তিযুদ্ধের সুফল কতটা সার্বজনীন করা গিয়েছে?

এ প্রশ্নগুলো এই মূহুর্তের বাংলাদেশে জ্বলজ্বলে বর্তমান। তবে এই বর্তমান হঠাৎ করে নেমে আসা কোনো অশনী বায়ু নয়। এর পেছনে রয়েছে একটি গোষ্ঠী ও তার দেশি-বিদেশি দোসরদের ধারাবাহিক অপচেষ্টা। মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরই বাংলাদেশ উল্টো রথে যাত্রা শুরু করে।

যেমন বাংলাদেশ চাওয়া হয়েছিলো, বাস্তবে ঘটেছিলো তার উল্টো। একটা রাজনীতিশুন্য পরিস্থিতিও অনেকাংশে এর জন্য দায়ী। মুক্তিযুদ্ধকালে তৎকালীন রাজনৈতিক শক্তির অনুপস্থিতি পুরো জাতিকে অভিভাবকশুন্য করে দিয়েছিলো। কিন্তু এ জাতির ঐতিহাসিক সাহসিকতা টের পেয়েছিলো তৎকালীন বিশ্ব।

যে সমতা, মর্যাদা ও ন্যয়বিচারের জন্য এদেশের মানুষ ঘর ছেড়ে ফেরারি হয়েছিলো, আজ এতোকাল পরেও সে একই লক্ষ্যে এদেশের লাখো মানুষ ঘর ছেড়ে ফেরারি হয়েছে। আগে যেমন পাক হানাদারেরা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বেড়াতো, অবস্থাটা এখনো তদ্রুপ। সময়টা তাই এখন আরেকটি যুদ্ধের। সংগ্রামের একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া পেরিয়ে এখন কেবল চূড়ান্ত লড়াইয়ের অপেক্ষা।

একটি অভিভাবকহীন জাতিও যে কোমর সোজা করে, মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে- তাবত বিশ্বের জন্য সেটি ছিলো এক অনন্য নজীর। দেশপ্রেমিক জনতা নিজ নিজ অবস্থান থেকে কারও অঙ্গুলি নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে নি। ২৫শে মার্চের কালরাত্রিতে যখন জাতি দিশেহারা হয়ে পড়েছিলো, তখন তাদের প্রয়োজন ছিলো একটু আত্মবিশ্বাসের। কালুরঘাট থেকে এলো সেই আত্মবিশ্বাসের বাণী। মেজর জিয়ার কণ্ঠস্বর সেদিন যেমন দিশেহারা জাতিকে উজ্জীবীত করেছিলো, যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মন্ত্রণা দিয়েছিলো; ঠিক তেমনি পলায়নপর রাজনৈতিক নেতাদের জন্য সেটি ছিলো এক চরম চপেটাঘাত। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালে রাজনীতিবিদরা সম্ভবত এই গ্লানিটুকু মন থেকে মুছে ফেলতে পারেন নি। নয় মাসের যে অনুপস্থিতি সেটিকে পূর্ণ করার মতো কোনো মুখও তাদের ছিলো না। তাই তারা একাধারে খড়গহস্ত হলেন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত নায়কদের উপর। মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা সেনাবাহিনী উপেক্ষিত হতে থাকলো। সেনাবাহিনীর সমান্তরালে ভিন্ন একটি রাষ্ট্রীয় বাহিনী গঠনের চেষ্টা করা হলো। যে ক’জন দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদ ছিলেন তাদেরকে উপেক্ষা করা হলো।

মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা তথা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারকে বদলে দিয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক চেতনার বাজার খোলা হলো। আর এসবেরই সামষ্টিক ফলাফল ছিলো বাকশাল। তবে এদেশের মুক্তিকামী জনতা তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের আশা হারায় নি। বারবারই মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনাকে শক্তি করে একটি শোষণবিহীন সমাজব্যাবস্থা এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণে অগ্রসর হয়েছে।

জিয়ার হাত ধরে দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, বাংলাদেশবাদী জাতীয়তাবাদের বিচ্ছুরণ জাতির মনে আশা জাগিয়েছে। কিন্তু জিয়াকে তার দেশপ্রেমের প্রকল্প সমাপ্ত করতে দেয়া হয় নি। আধিপত্যবাদিদের বুলেট তার স্বপ্নের গতিরোধ করতে সচেষ্ট হয়েছে। কিন্তু থামানো কি গিয়েছে? একেবারেই যায় নি; কিন্তু ঝেঁকে বসতে পেরেছে। জিয়া পরবর্তী সময়েও এদেশের মানুষ একাধিকবার সঠিক পথে যাত্রা শুরু করেছিলো। কিন্তু কখনো স্বৈরতন্ত্র, কখনো নব্য বাকশালের রূপে ফ্যাসিবাদ বাংলাদেশে ঝেঁকে বসেছে।

স্বাধীনতার ৫২ বছর পর এসেও এরকমই এক দানবীয় ফ্যাসিজমের বিপরীতে এদেশের মানুষ লড়াই করে যাচ্ছে। দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, সে লড়াইটা কেবল সম্মান রক্ষা কিংবা কোনো রাজনৈতিক প্রতিযোগীতার মধ্যে সীমিত নেই। এই লড়াই এখন ব্যাপৃত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনরুদ্ধারের লড়াইয়ে। যে গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য মানুষ আজ থেকে অর্ধশতাব্দীকাল পূর্বে জীবন দিয়েছিলো, দুঃখজনক হলেও আজও সেই গণতন্ত্রের জন্যই দেশের মানুষকে প্রাণ দিতে হচ্ছে।

যে সমতা, মর্যাদা ও ন্যয়বিচারের জন্য এদেশের মানুষ ঘর ছেড়ে ফেরারি হয়েছিলো, আজ এতোকাল পরেও সে একই লক্ষ্যে এদেশের লাখো মানুষ ঘর ছেড়ে ফেরারি হয়েছে। আগে যেমন পাক হানাদারেরা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে বেড়াতো, অবস্থাটা এখনো তদ্রুপ। সময়টা তাই এখন আরেকটি যুদ্ধের। সংগ্রামের একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া পেরিয়ে এখন কেবল চূড়ান্ত লড়াইয়ের অপেক্ষা।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *