ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ মারা গেছেন

:: নাগরিক নিউজ ডেস্ক ::

ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ৯৬ বছর বয়সে মারা গেছেন। সত্তর বছর ধরে যুক্তরাজ্য শাসন করে আসা রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ বৃহস্পতিবার মারা যান বলে বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে জানানো হয়েছে।

রানি বালমোরাল প্রাসাদে ছিলেন। তার অসুস্থতার খবরে এদিন সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন প্রিন্স চার্লসসহ তার সন্তান-সন্ততিরা।

এক বিবৃতিতে বাকিংহাম প্যালেস বলেছে, ‘রানি আজ বিকেলে বালমোরালে মারা গেছেন।’

রানি গ্রীষ্মকালীন বিশ্রামে ছিলেন এবং গত জুলাই মাস থেকে স্কটল্যান্ডের বারমোরাল প্রাসাদে অবস্থান করছিলেন। সেখানেই তার মৃত্যু ঘটেছে।

প্রায় একবছর ধরেই রানির স্বাস্থ্য ভাল যাচ্ছিল না। তার চলাফেরায় সমস্যা হওয়ার কথা জানানো হয়েছিল বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে।

অসুস্থতার কারণে গত শরৎ থেকে তিনি বহু অনুষ্ঠানেই অংশ নিতে পারেননি। রানির পক্ষ থেকে তার ছেলে প্রিন্স চার্লস ওইসব দায়িত্ব পালন করে এসেছেন।

গতকাল স্বাস্থ্য নিয়ে ‘উদ্বেগ’ প্রকাশ করে চিকিৎসকরা রানীকে মেডিকেল নজরদারির মধ্যে রাখার সুপারিশ করেন। বাকিংহাম রাজপ্রাসাদ থেকে এ তথ্য জানানোর পর রানীর স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছিল ক্রমশ। খবর পাওয়ার পর সিংহাসনের পরবর্তী উত্তরাধিকারী প্রিন্স চার্লস সহ রানীর সব সন্তান রুদ্ধশ্বাসে ছুটে যান বালমোরালে। এর মধ্যে আছেন প্রিন্স অ্যানড্রু, প্রিন্সেস অ্যান এবং প্রিন্স এডওয়ার্ড। দাদি ও রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথকে দেখতে ছুটে যান প্রিন্স উইলিয়াম। সন্তানদের দেখভালের জন্য বাকিংহামে থেকে যান প্রিন্সেস কেট মিডলটন। ওদিকে প্রিন্স হ্যারি ও তার স্ত্রী মেগান মার্কেল বালমোরালে পৌঁছার কথা। রানীর স্বাস্থ্যের অবনতির  খবর দিনের শুরুতে রাজপরিবারের সব সদস্যকে জানিয়ে দেয়া হয়। ফলে পরিবারের সদস্যরা রানীর শয্যাপাশে অবস্থান নিতে ছুটে যান। 
রানী এলিজাবেথ অবস্থান করছিলেন স্কটল্যান্ডের বালমোরাল ক্যাসেলে। বছরের এ সময়টাতে তিনি সেখানে অবস্থান করেন। গতকাল যখন হৃদয় ভেঙে যাওয়ার মতো খবর প্রকাশ পায়, তখন বালমোরালে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছিল। যেন শোক জানিয়ে গলে গলে পড়ছিল মেঘ। প্রকৃতিকে ভিজিয়ে শোকের এক আবহ রচিত হয় চারদিক। এই বালমোরাল ক্যাসেল থেকেই ৬ই সেপ্টেম্বর রানী নতুন প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসকে নিয়োগ করেন। তখন তাকে বেশ হাসিখুশি দেখা যায়। তিনি গ্রিনরুমে স্বাগত জানান ট্রাসকে। এর আগে তিনি বিদায় জানান বরিস জনসনকে। এএফপি লিখেছে, গত বছর অক্টোবর থেকেই স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছিলেন রানী। এসব সমস্যার কারণে তার হাঁটতে এবং দাঁড়িয়ে থাকতে কষ্ট হয়। তাকে বিশ্রামে থাকতে বলার পর বুধবার রাতে সিনিয়র রাজনৈতিক উপদেষ্টাদের সঙ্গে পরিকল্পিত প্রাইভি কাউন্সিলের বৈঠক বাতিল করতে বাধ্য হন রানী। ভার্চ্যুয়ালি জুমের মাধ্যমে এই বৈঠক করার কথা ছিল। বাকিংহাম প্যালেস থেকে তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে গতকাল বিবৃতিতে বলা হয়, বৃহস্পতিবার সকালে আরও মূল্যায়নের পর রানীর চিকিৎসকরা তার স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তারা তাকে আরও মেডিকেল তত্ত্বাবধানে থাকার সুপারিশ করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। সবাইকে কাঁদিয়ে চিরবিদায় নিলেন তিনি। 

চিকিৎসকদের সতর্কতার পর পরই প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস এবং তার পার্লামেন্টারি টিমের সিনিয়র সদস্যদের কাছে নোট পাঠানো হয়। এতে দ্রুত তাদেরকে চেম্বার ছেড়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করা হয়। তখন জ্বালানি ইস্যুতে পার্লামেন্টে বিতর্ক চলছিল। এ সময় প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের কাছে ওই নোট হস্তান্তর করেন নাদিম জাহাবি। চলমান অধিবেশনের মধ্যেই এ নিয়ে তাদের দু’জনকে কথা বলতে দেখা যায়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস টুইট করেন। তিনি লিখেছেন, বৃহস্পতিবার মধ্যাহ্নভোজের সময় বাকিংহাম প্রাসাদ থেকে যে খবর পাওয়া গেছে, তাতে পুরো দেশ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এই সময়ে রানী ও তার পরিবারের প্রতি আমাদের এবং পুরো বৃটেনের মানুষের প্রার্থনা। 

দুপুরের দিকে হাউজ অব কমন্সে নতুন সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে চমৎকার বিতর্ক চলছিল। এমন সময় প্রধানমন্ত্রীর কাছে নাদিম জাহাবি রানীর স্বাস্থ্যগত উদ্বেগের কথা তুলে ধরেন। এরপরই এসএনপি ওয়েস্টমিনস্টারের নেতা ইয়ান ব্লাকফোর্ডের বক্তব্যে ছেদ ঘটান স্পিকার স্যার লিন্ডসে হোইলি। তিনি এমপিদের জ্বালানি নিয়ে বিতর্কের মধ্যে জানান- পুরো হাউজের পক্ষ থেকে আমি কথা বলছি। রানীর শুভ কামনা করছি আমরা। এই মুহূর্তে তিনি এবং রাজ পরিবারের প্রতি আমাদের প্রার্থনা। 

এ নিয়ে বৃটিশ মিডিয়ায় উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ে। সব মিডিয়াই তাদের নিয়মিত খবর পরিবেশনের পরিবর্তে এই খবরকে প্রাধান্য দিয়েছে। সংবাদের শীর্ষ শিরোনাম হয়েছেন রানী। নিয়মিত প্রোগ্রামের সম্প্রচার স্থগিত করে বিবিসি ওয়ান। বালমোরালে রানী মেডিকেল তত্ত্বাবধানে আছেন, রাজপরিবারের সদস্যরা তার কাছে রুদ্ধশ্বাসে ছুটে যাচ্ছেন- এমন ঘোষণার পর পরই বিবিসি তাদের নিয়মিত প্রোগ্রাম স্থগিত করে দেয়। এর পরিবর্তে তারা সম্প্রচার করে বিবিসি নিউজ স্পেশাল। এতে উপস্থাপক হিউ এডওয়ার্ড কালো পোশাক পরে উপস্থিত হন। তার গায়ে সাদা শার্ট। গলায় কালো টাই। যখন রাজ পরিবারের কোনো সদস্য মারা যান, তখন বিবিসি এমন পোশাক কোড ব্যবহার করে। এর মধ্য দিয়ে মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। 

চার্চ অব ইংল্যান্ডের প্রধান আর্চবিশপ অব ক্যান্টারবারি বলেছেন, রানীর জন্য পুরো দেশবাসীর প্রার্থনা আছে। জাস্টিন ওয়েলবি টুইটে বলেছেন, রানীর সঙ্গে আছে আমার, পুরো চার্চ অব ইংল্যান্ড এবং দেশবাসীর প্রার্থনা। ঈশ্বর তাকে, তার পরিবারকে এবং যারা বালমোরালে রানীর সেবা করছেন, তাদেরকে শক্তি এবং স্বস্তি দিন। 

বিবিসি’র রাজপরিবার বিষয়ক সাবেক প্রতিনিধি রিচার্ড সামনার বলেছেন, রাজপ্রাসাদ থেকে দেয়া বিবৃতিতে সতর্কতার সঙ্গে শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এতে বোঝা যায় মারাত্মক কিছু ঘটছে। আশা করছি এটি একটি ক্ষণস্থায়ী ঝড়, যা কাটিয়ে উঠা যাবে। কিন্তু অবশেষে তা আর হলো না। ডেইলি মেইল লিখেছে, গত বছর অক্টোবরে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে সার্ভিসে রানী হাঁটার সময় লাঠি ব্যবহার করেন। বড় কোনো অনুষ্ঠানে তিনি প্রথমবার এমনটা করেন। এর এক সপ্তাহ পরে তাকে বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা এবং উত্তর আয়ারল্যান্ড সফর বাতিল করার পরামর্শ দেন। তার প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য গোপনে হাসপাতালে ভর্তিও করা হয়। একই বছর তিনি হাসপাতালে প্রথম রাত কাটিয়েছেন ২০ অক্টোবর। পরের দিন তিনি উইন্ডসরে নিজের টেবিলে হাজির হন। হালকা ধরনের কাজ চালিয়ে যান।

১৯৫২ সালে বৃটেনের রানি হিসেবে দ্বিতীয় এলিজাবেথের অভিষেক হয়। মৃত্যুর পর তার জ্যেষ্ঠ পুত্র চার্লস বৃটেনের নতুন রাজা হচ্ছেন।

৯৬ বছর বয়সের রানি এলিজাবেথ ১৯৫২ সাল থেকে টানা ৭০ বছর ধরে সিংহাসনে আসীন ছিলেন। ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের দীর্ঘ ইতিহাসে তিনিই সবচেয়ে দীর্ঘ সময় সিংহাসনে অধিষ্ঠিত থেকেছেন। তাঁর শাসনামলে ১৬ জন প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের পুরো নাম এলিজাবেথ আলেকজান্দ্রা মেরি উইন্ডসর। তিনি ১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল লন্ডনের বার্কলে স্কয়ারের কাছে একটি বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। যুক্তরাজ্য এবং আরও ১৫টি কমনওয়েলথ রাজ্যের রানি ছিলেন তিনি। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের দীর্ঘ শাসনামল তাঁর দৃঢ় কর্তব্যবোধ এবং তাঁর সিংহাসন এবং জনগণের জন্য তাঁর জীবন উৎসর্গ করার দৃঢ় সংকল্পকারী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ যেমন বিশ্বে ব্রিটিশ প্রভাব ব্যাপকভাবে কমতে দেখেছেন, তেমনি দেখেছেন সমাজের দ্রুত পরিবর্তন। একই সঙ্গে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হতেও দেখেছেন। তবে অনেক ঝড়ঝঞ্ঝাতেও রাজতন্ত্রকে রক্ষা করেছেন সফলতার সঙ্গে।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ ব্রিটিশ রাজা জর্জ এবং রানি এলিজাবেথের প্রথম সন্তান। তাঁর বাবা ১৯৩৬ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন। সেই সময় থেকেই এলিজাবেথ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী ছিলেন। রাজকুমারী হিসেবে জীবনের প্রথম দিনগুলো পিকাডিলি, লন্ডন ও রিচমন্ড পার্কের হোয়াইট লজে পার করেন তিনি। ১৯৪০ সালে নিরাপত্তার জন্য উইন্ডসর ক্যাসেলে রাখা হয় রাজপরিবারের সদস্যদের। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়টা সেখানেই কাটে তাঁর। রাজকুমারী এলিজাবেথ এবং তাঁর ছোট বোন প্রিন্সেস মার্গারেট ওই বাড়ি থেকে লেখাপড়া করেন।

১৯৪৭ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ গ্রিক ও ডেনমার্কের প্রিন্স ফিলিপকে (ডিউক অব এডিনবরা) বিয়ে করেন। ফিলিপ গত বছরের ৯ এপ্রিল ৯৯ বছর বয়সে মারা যান। এলিজাবেথ-ফিলিপ দম্পতির চার সন্তান। তাঁরা হলেন ওয়েলসের যুবরাজ চার্লস (তিনি ব্রিটেনের নতুন রাজা); প্রিন্সেস অ্যান; ইয়র্কের ডিউক যুবরাজ অ্যান্ড্রু এবং আর্ল অব ওয়েসেক্স যুবরাজ এডওয়ার্ড।

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাবা রাজা জর্জ মারা গেলে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ সিংহাসনে বসেন এবং কমনওয়েলথের প্রধান হন। তাঁর রাজ্যাভিষেক বিশ্বজুড়ে টিভি রেকর্ড গড়ে। এ ছাড়া রাজতন্ত্র ও ব্রিটিশ কমনওয়েলথের জন্য একটি নতুন যুগের সূচনা করেন তিনি।

১৯৫০–এর দশককে রানির জন্য স্বর্ণযুগ হিসেবে দেখা যেতে পারে। রাজপরিবার ও রানির প্রতি মানুষের ব্যাপক শ্রদ্ধা ছিল। তরুণ দ্বিতীয় এলিজাবেথকে তখন রূপকথার রাজকুমারীর মতো দেখাত। তবে পরবর্তী কয়েক দশকে ব্যাপক সামাজিক পরিবর্তনের ফলে রাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা কমতে থাকে। এ ছাড়া সম্প্রচারমাধ্যমের নতুন যুগ ও গণমাধ্যমের প্রচারের কারণে রাজপরিবারের অনেক ঘটনা সামনে চলে আসে। রানি সন্তানদের বৈবাহিক সমস্যা এবং এ–সম্পর্কিত কেলেঙ্কারির বিষয়গুলো গণমাধ্যমের শিরোনামে জায়গা করে নেয়। এরপরও মানুষ রানির কারণে রাজপরিবারের প্রতি উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *