সঙ্গীতের জাদুকর একজন লাকি আলী

:: অভীক মুখোপাধ্যায় ::

১৯৯৬ সাল। অদ্ভুত একটা কণ্ঠস্বর ফেমাস হয়ে গেল। গলাধারীর নাম লাকি আলী। গানের এলবামের নাম ‘শুনো’। একটা অপরিশীলিত কণ্ঠে শোনা যাচ্ছিল ‘ও-ও সনম, মুহব্বৎ কি কসম…’। যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে গিয়েছিল গানটা। এবং আমার ব্যক্তিগত ধ্যানধারণায় ওটাই আজ্জ অবধি লাকি আলীর গাওয়া গানগুলোর মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয়।

ইন্ডি-পপ ঘরানার উত্থানপর্ব। চারিদিকে কান পাতলে শোনা যাচ্ছিল ঘষাটে সব কণ্ঠস্বর। গানের ফেরবদল এবং এক্সপেরিমেন্ট তখন তুঙ্গে। সিন্থ আর ব্যাস (bass) নিয়ে সৃষ্টি হচ্ছিল সঙ্গীতের এক সমান্তরাল সংসার। মায়াজগত। অ্যাকিউস্টিক গীটারই তখন ফুসফুস। ব্লুজ, হিপ হপ, সফট রক তখন ককটেলড। তার সঙ্গে গিয়ে মিশছিল ভারতীয়ত্ব। সবটাই হয়ে উঠছিল লোকব্যাপী। তবে এ ধরণের ঘরানা কিন্তু অমরত্বের প্রত্যাশা করেনি। এই ঘরানার গায়কেরা চেয়েছিল অতি অল্প সময়ে ছড়িয়ে পড়তে। কোরোনার মতোই সংক্রমণ ছিল তাদের জন্মগত অভ্যাস। কোনো একটা ব্রাহ্মমুহূর্তের চপল সুরকে ছুঁয়ে ফেলে বাঁচিয়ে রাখতে চাইছিল নিজেকে। বলছিল, ‘মানছি আমার কাছে কানাকড়িটাও নেই, তবুও আমি মেলায় যাবো। যাবোই! মেলার মাঠ থেকে রঙিন পাথর কুড়িয়ে আনতে পারলেও সেটাই আমার লাভ।’

এখন এই নির্বাসনের দিনে মানুষের মন সবথেকে বেশি উচাটন। খালি খালি বলছে, ইহার চেয়ে হতেম যদি আরব বেদুইন। যাযাবরী চাইছে মানুষ। লাকি আলি এই যাযাবরীর প্রতীক। তাঁর প্রায় প্রতিটা মিউজিক ভিডিওতেই ফুটে ওঠে এক অনন্ত পথচলা পথিকের কাণ্ডকারখানা। তিনি এক মুসাফির। একটা বোহেমিয়ান স্পিরিট গ্রাস করে নেয় তাঁর শ্রোতাদের, তাঁর প্রত্যেক দর্শককে। ভিডিওগুলো আরেকবার করে দেখে ঝালিয়ে নিন এই সময়ে। বিচিত্র সব ল্যান্ডস্কেপ। সরে সরে যায়। সুদূর দেশপ্রান্ত। প্রান্তিক সব মানুষের অদ্ভুত এবং অবাক করা মুখচ্ছবি। তৃতীয় বিশ্বের মানচিত্র থেকে ধরে ধরে তুলে আনা এক একটা ভূখণ্ড –মিশর, লাতিন আমেরিকা কিংবা ভারতভূমির গ্রাম-দেহাত।

লাকি আলীর নিজের জীবনটাও এরকমই। চাষ করেছেন। সমুদ্র থেকে তৈল উত্তোলনকারী কোম্পানির চাকরি করেছেন একদা। গালিচা বেচেছেন। ঘোড়া সামলেছেন। তাঁর নীল চোখ, ঘুঙুরের মতো চুল আর ভ্রমরের মতো গুঞ্জনে ভরা কণ্ঠ দিয়ে তিনি সময়ের খাতা ভরে দিয়েছেন স্বাক্ষর দিয়ে। এখনও মাঝেমধ্যেই হিমাচলের উপত্যকায় তাঁকে ঘুরতে দেখা যায়। এক বোহেমিয়ান জীবন। ২০১১ সালের পর থেকে আর কোনো এলবাম আসেনি। ফিল্মে গান গেয়েছেন। অভিনয় করেছেন। কিন্তু কোথাও মন বসেনি। তিন তিনটে বিয়ে, কিন্তু সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি কোনোবারেই। গতিজাড্যই লাকির নিয়তি। ভ্যাগাবন্ড হিসেবে চিহ্নিত মানুষটা স্থাণু কেবল একটা জায়গাতেই—নিজের শিল্পে। যখন তখন লাইভ শো করেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বয়ে যেতে দিয়েছেন। বয়েস লুকোনোর চেষ্টা নেই। আমরা তাঁকে বুড়ো হতে দেখেছি এবং তার জন্য তিনি লজ্জিত নন। অনুতাপ নেই। বয়েস একটা গ্রেস। নয়ের দশকের শেষ দিকের লাকির থেকে আজকের লাকিকে কতখানি আলাদা দেখতে লাগে তা ছবিতে দেখলেই বুঝবেন বন্ধুরা। আসলে লাকির জীবনে কোথাও কোনো গ্রন্থি নেই। বাঁধন হারা নদীর মতো বহমান। অবিরত এক চেতনা।

লাকি আলির একটা ভিডিওর কথা মনে পড়ছে। সেখানে একটি কৃষ্ণাঙ্গ মেয়ের সঙ্গে তাঁর প্রেম হয়। পুনর্জন্মের কথা আসে। একবার করে ফ্ল্যাশব্যাক, আরেকবার বর্তমানের কাহিনি—এভাবেই এগোয়। দর্শক বারবার সঙ্কেত পান যে, এগুলোই আগেই ঘটে গিয়েছিল; আমরা আগেই এখানে এসেছিলাম; এসবই আমাদের দেখা হয়ে গেছে। লাকির গিটার দেখে মনে হচ্ছিল না ওটা কোনো বাদ্যযন্ত্র, মনে হচ্ছিল গিটার তো নয়, ওটা ওঁর হাত। পথে পথে হিচ হাইকিং করতে করতে এগিয়ে চলা এক মানুষ। দীর্ঘ পথ অতিক্রম করা তাঁর প্যাশন। লাকির গলার অশুদ্ধি হাওয়ায় ভাসতে ভাসতে মিশে যাচ্ছিল দূরে, কোনো এক সাগরের জলে। যখন মঞ্চে উঠে তিনি মাইক্রোফোন নিয়ে গান করছিলেন, তখন দেখলে মনে হচ্ছিল প্রেমিকার মুখ নিজের দুই হাতে নিয়ে তার অধরোষ্ঠ চুম্বন করছেন। আবেগে কাঁপছেন থরথর করে।

সৈয়দ আসলাম নূর নামের একজন শায়ের লাকি আলির জন্য গান লিখতেন, লাকিকে সকলেই চিনছিলেন। এবং অতি স্বাভাবিক নিয়মে নূরকে কেউ চিনতেন না। কিন্তু এটা অবিদিত সত্য যে লাকি মূর্তি হলে নূরই ছিলেন তাঁর প্রাণ। লাকির গানের অন্তর্ভাব রচনার শতভাগ কৃতিত্বই নূরের। যতটা মধুর ছিল লাকির মিউজিক, তাঁর কণ্ঠ, ঠিক ততটাই সুন্দর ছিল গানের কথা। এখানে একটা কথা মনে করিয়ে দেওয়া উচিৎ যে, লাকির কিন্তু কোনো প্রথাগত তালিম ছিল না। স্টুডিওর বাইরে লাকিকে শুনলে হয়তো কেউ বিশ্বাসই করবেন না যে লাকি আলি গায়ক হতে পারেন। কিন্তু যে যাই বলুন না কেন, লাকির কণ্ঠের অমোঘ আকর্ষণ এড়ানোর ক্ষমতা বেশিরভাগেরই নেই। আজও। আমরা ভারতবাসী, আমাদের নায়ক মহাআখ্যান থেকে উঠে আসেন। তাঁরা লার্জার দ্যান লাইফ ক্যারেক্টার। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে লাকি আলি বিরল এক প্রতিভা। অদ্ভুত এক চরিত্র। তাঁর গান থেকে তাঁর ব্যক্তি-চরিত্রের এমন এক দিক ফুটে উঠছিল, যার উত্তর – আধুনিক ফ্র্যাগমেন্টেশন ছিল ভারত-দেশের কাছে মহা কৌতূহলের বিষয়। নাগরিকেরা মুগ্ধ হয়ে গেলেন। একটু ফিরে তাকান পাঠক, যে সময়ে লাকি আলি উঠে এসেছেন, তখন গ্লোবালাইজেশন সবে আরম্ভ হয়েছে। বিকশিত হচ্ছে ভারত। আসছে নতুন একটা টার্ম –আর্বান ইন্ডিয়া। কিন্তু আমি দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে বলছি, সেই সময়ে দাঁড়িয়ে রুরাল ইন্ডিয়াতেও লাকি আলির অজস্র ফ্যান-ফলোয়ার জন্ম নিয়েছিল। মুম্বাইয়া সঙ্গীতচর্চা তখনও আটের দশকের পরিপাটি সঙ্গীত নিয়ে মগ্ন, আর তখনই এক মহা বিস্ফোরণ হয়ে এলেন লাকি আলি। ইলেকট্রনিক রেকর্ডিং –এর সর্বোচ্চ প্রয়োগ দিয়ে বদলে দিলেন লক্ষ লক্ষ সমীকরণ। অপরদিকে অবশ্য আরেক তারকাও জন্ম নিচ্ছিলেন – এ আর রহমান। আসলে এঁরা সম্ভবত রবার্ট ফ্রস্টের ওই লাইনটাতে বিশ্বাস রেখেছিলেন –Two roads diverged in the woods, and I took the one less travelled. And that made all the difference…

১৯৯৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পঞ্চাশতম বর্ষপূর্তি ছিল। এই উপলক্ষ্যে একটা নতুন মিউজিক এলবাম এল – মেরি জান হিন্দুস্তান। লাকি আলীও গাইলেন, ‘অনজানি রাহোঁ মেঁ তু কেয়া ঢুঁঢতা ফিরে…।’ ১৯৯৯ সালে এল ‘ভোপাল এক্সপ্রেস’। দুর্দান্ত একটা সিঙ্গেল স্কোর করলেন লাকি আলি –‘তু কৌন হ্যায়।’ পরে সম্ভবত এই গানটা ওঁর এলবাম ‘অকস্’-এও ইনক্লুড করেছেন লাকি। ১৯৯৮ সালে অবশ্য সেকেন্ড এলবাম এসে গিয়েছিল –সিফর। তখন টিভিতে একটা গান দিনরাত চলতো, ‘দেখা হ্যায় অ্যায়সে ভি’। কত তরুণ তরুণী তখন লাকির আবেগে ভেসে ভেবে নিয়েছিল, আজ একটা ব্যাকপ্যাক থাকলে পিঠে তুলে হাঁটা দিতাম। তারা ভেবেছিল অজানা দেশে যাব, অচেনা মানুষের সঙ্গে দেখা করব, প্রথম দেখাতেই প্রেম হবে, ঝর্নার জল হাতে ধরে খাব, ঘুম পেলে ঘাস রয়েছে, জীবনের চোখে চোখ রেখে দেখব, জানব, বুঝব, অনুভব করব। গানেই ফুটে উঠত এই ইচ্ছা –‘সাঁস মেঁ হবা, জান মেঁ জমিঁ, দিল মেঁ খুলা আশমাঁ।’ ইংরেজিতে এটাকে ওয়ান্ডারলস্ট বলা চলে মনে হয়। জার্মান ভাষায় এটাই বান্ডরলুস্ট। বাংলায় ভ্রমণরতি বলি। এটাই লাকি আলির আবেগের ভিত্তি এবং আত্মার স্থাপত্য।

একটা গানে ছিল লাকি আলীর সঙ্গে একজন অপরাধী রমণীর প্রেম হয়ে যাবে। আরেকটা গানে মাটি থেকে গান্ধী-টুপি তুলে নিয়ে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামীর মাথায় পরিয়ে দিলেন লাকি। আরেকটা গান মনে পড়ছে। সম্ভবত ‘সিফর’ নামের এলবামের দ্বিতীয় গান ছিল এটাই। নহিঁ রখতা দিল মেঁ কুছ রখতা হুঁ জুবাঁ পর। গানটার মাধ্যমে সার্কাসে কাজ করা একটি মেয়ের জীবনের দুঃখকষ্টকে দেখানো হয়েছিল। মেয়েটাকে একজন ভালোবাসতো। সে জোকারের কাজ করতো। সার্কাসের রিং মাস্টার মেয়েটাকে এক্সপ্লয়েট করছিল। গানের শেষে দেখা গেল মেয়েটি, ওই জোকার এবং ওই রিং মাস্টার একসঙ্গে খিলখিল করে হাসতে হাসতে চলে গেল। জীবনের প্রতি এমন মায়াবী দর্শন আসলে একটা শিল্প। পৃথিবীতে প্লট বদলে যাচ্ছিল। বদলাচ্ছিল অবস্থা, মুখ, মাটির ছবি। আর তারই মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলেছিল একটা মুখ। এক যাযাবর। যেন কোনো কিছুতেই তার কোনো কিছু যায় আসে না। তার একতাই আপ্তবাক্য – নিজেকে জানো, নিজেকে খোঁজো, নিজের জীবনের প্রাসঙ্গিকতা সন্ধান করো।

লাকি আলির নিজের জীবনটাও এরকমই। চাষ করেছেন। সমুদ্র থেকে তৈল উত্তোলনকারী কোম্পানির চাকরি করেছেন একদা। গালিচা বেচেছেন। ঘোড়া সামলেছেন। তাঁর নীল চোখ, ঘুঙুরের মতো চুল আর ভ্রমরের মতো গুঞ্জনে ভরা কণ্ঠ দিয়ে তিনি সময়ের খাতা ভরে দিয়েছেন স্বাক্ষর দিয়ে। এখনও মাঝেমধ্যেই হিমাচলের উপত্যকায় তাঁকে ঘুরতে দেখা যায়। এক বোহেমিয়ান জীবন। ২০১১ সালের পর থেকে আর কোনো এলবাম আসেনি। ফিল্মে গান গেয়েছেন। অভিনয় করেছেন। কিন্তু কোথাও মন বসেনি। তিন তিনটে বিয়ে, কিন্তু সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি কোনোবারেই। গতিজাড্যই লাকির নিয়তি। ভ্যাগাবন্ড হিসেবে চিহ্নিত মানুষটা স্থাণু কেবল একটা জায়গাতেই—নিজের শিল্পে। যখন তখন লাইভ শো করেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বয়ে যেতে দিয়েছেন। বয়েস লুকোনোর চেষ্টা নেই। আমরা তাঁকে বুড়ো হতে দেখেছি এবং তার জন্য তিনি লজ্জিত নন। অনুতাপ নেই। বয়েস একটা গ্রেস। নয়ের দশকের শেষ দিকের লাকির থেকে আজকের লাকিকে কতখানি আলাদা দেখতে লাগে তা ছবিতে দেখলেই বুঝবেন বন্ধুরা। আসলে লাকির জীবনে কোথাও কোনো গ্রন্থি নেই। বাঁধন হারা নদীর মতো বহমান। অবিরত এক চেতনা।

২০০১ সালে এল ‘অকস্’। ততদিনে লাকির হাজার হাজার ফলোয়ার জন্মেছে। কতজনের জীবন দর্শনে লাকির গান! তখনও অবধি প্রকাশিত হয়েছে তিনটে এলবামের তিরিশটা গান, আর একাধিক সিঙ্গেল। লাকির গানের আদিম ও সজীব বোধ তখন যুবক যুবতীদের আফিম। ধর্মের মতোই। লাকি সেখানে ঈশ্বর। বাংলায় লাকি আলির প্রভাব কতখানি ছিল তা বলা মুশকিল হলেও অবাঙালি বেল্টে কিন্তু নব্যযুবারা লাকির গান শুনে দিশা পেয়েছিল এবং হারিয়েওছিল। জীবন যাপনের নতুন সঙ্কেত আসছিল গানের মধ্যে দিয়ে। আমি নিজেও লাকি আলির গানে প্রভাবিত হয়েছি। বার বার মনে হয়েছে এমন স্টোরি টেলার বিরল। আমার জীবন লাকি আলির মতো অমন তরল নয়। অমন মনের জোর আমার নেই। কিন্তু এই জীবন বহমান তো বটেই। এই শহর থেকে ওই শহরে বাড়ি বদলে যায় নির্দিষ্ট সময়ের অন্তরে। বোহেমিয়ান তো খানিক বটেই। যাত্রার শেষ নেই। অন্তিম বলে কিছু মিলছে না। জীবন বার বার বলছে, তারপর কী হল? অনন্তিম। জীবনে ক্ষত সৃষ্টি হচ্ছে, কেউ বা কারা প্রলেপ দিচ্ছে। কেউ না-থাকলে সময়ই বৈদ্য হিসেবে নিজের কাজ সারছে। কিন্তু কোথাও থামার মতো কোনো গুরুত্বপূর্ণ কারণ পাচ্ছি না। আসলে থামার বা না-থামার সিদ্ধান্ত আমাদের হাতে নেই। সেটা প্রি-টেকেন। জীবনতাকে আশ্চর্যের হাতে সঁপে দিয়ে শুধু বয়ে যাওয়া। সময়ের কলম নিয়ে দেহ, মন আর আত্মা পুরালিপি রচনা করুক। লিখুক, এই তো জীবন!

থোড়া সা গরজ হ্যায়, থোড়ি সি সমঝ হ্যায়

চাহতোঁ কে দায়রে মেঁ ইতনা ফরজ হ্যায়

কোই কেহতা হ্যায় কে ঘোর আ গয়া হ্যায়

আরজু ভি অর্জ্ হ্যায়,

বঢ়তে জানা…

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *