শান্তিপূর্ণ সমাবেশ বিএনপির জন্য বড় একটি অর্জন

:: মাহবুব মোর্শেদ ::

যারা ভেবেছিলেন ১০ ডিসেম্বর সরকার পতন হবে, তারা কিছুটা হতাশ হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে।

বিএনপি নেতা আমান উল্লাহ আমান যেদিন এ বিষয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন সেদিন আমি এর সমালোচনা করেছিলাম।

আমার মনে হয়েছিল, ডেটলাইন ঘোষণা করে সরকার পতনের হুমকি দিয়ে তা অর্জন করা খুব কঠিন।

শেষ পর্যন্ত এগুলো বাগাড়ম্বর ছাড়া আর কিছুই নয়।

আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল জলিলের ৩০ এপ্রিলের ডেটলাইনের কথা মনে রেখে আমার মনে হয়েছিল আমানুল্লাহ আমান কথাটি বলে ঠিক করেননি।

তখন অবশ্য অনেকেই বলার চেষ্টা করেছেন, ১০ ডিসেম্বর যেহেতু মানবাধিকার দিবস এবং গত বছরের স্যাংশনের বর্ষপূর্তি সেহেতু কিছু একটা ঘটতে পারে। তাছাড়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে বাগাড়াম্বর খুব অপরিচিত বিষয় নয়। অনেক সময় এগুলো জনগণকে মোটিভেট করার কাজে লাগে।

পরে ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশকে কেন্দ্র করে দেশে-বিদেশে যে জোরদার প্রচারণা তৈরি হয়েছিল তাতে অনেকেই মোটিভেটেড হয়েছেন।

সরকারও দিনটিকে খুব সিরিয়াসলি নিয়েছিল।

সকল হুমকি-ধামকি বিবেচনায় নিয়ে তারা ক্ষমতা রক্ষা করার জন্য সব রকমের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল।

শীর্ষস্থানীয় বিএনপি নেতারা ১০ ডিসেম্বর বিষয়ে নিরব ছিলেন এবং এটি যে তাদের সাধারণ একটি গণসমাবেশ এ কথা বারবার বলে গেছেন।

কিন্তু সরকারের প্রতিক্রিয়া ও প্রস্তুতি এবং বিএনপির বন্ধু বলে পরিচিত লোকদের হুংকারের কারণে ১০ ডিসেম্বর অনেক বড় একটি ব্যাপারে পরিণত হয়েছিল।

অনেকেই ভাবতে বসেছিলেন, সরকার পতন না হোক একটা বড় কিছু ১০ ডিসেম্বর ঘটবেই।

তেমন কিছু ঘটেনি।

এমনকি নতুন স্যাংশনও আসেনি।

অবশ্য এটা ভাবা খুব কঠিন যে যেদিন সরকারবিরোধী একটি বড় সমাবেশ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে সেদিনই ওয়াশিংটন থেকে একটি স্যাংশন আসবে।

এরকম ঘটনা ঘটলে সেটা স্বাভাবিকভাবে খুব খারাপ হতো। সমাবেশটি উগ্র ও বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিত। গণতন্ত্রমনা ও মানবাধিকারপন্থী যুক্তরাষ্ট্র তেমনটি কখনো চাইবে না।

গোলাপবাগের সমাবেশে যারা উপস্থিত হয়েছিলেন তাদের একটি অংশ হয়তো সরকার পতনের উদ্দেশ্য নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন।

তেমন কোনো ঘটনা তো ঘটেইনি এমনকি নয়াপল্টনের অফিস পর্যন্ত তারা যেতে পারেননি। উল্লেখ করার মতো কোনো সংঘাতও ঐদিন ঘটেনি।

ফলে এই অংশটা হতাশ হতেই পারে।

তবে আমার মনে হয়েছে, ১০ ডিসেম্বর গোলাপবাগে শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করতে পারা বিএনপির জন্য বড় একটি অর্জন।

বিএনপি সরকার, নির্বাচন, ভোটচুরি আগের রাতের ভোট ইত্যাদি নিয়ে অনেক কথা বললেও এতদিন ধরে তাদের এমপিরা সংসদে গিয়ে এসব কথাকে প্রকারান্তরে ভুলই প্রমাণ করেছেন। সংসদের বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা তাদের উপস্থিতির মাধ্যমে শক্তিশালী হয়েছে। ফলে এটি বিএনপি’র জন্য একটি বড় দুর্বলতা ছিল। সংসদ থেকে পদত্যাগের মধ্য দিয়ে বিএনপি যে নিজেদের দুর্বলতা থেকে বের হয়ে আসতে পারল এটা ১০ ডিসেম্বরের সবচেয়ে বড় অর্জন। আমার কাছে মনে হয়, সামনের দিনগুলোতে সরকার বিএনপি’র সঙ্গে বসার জন্য প্রস্তুত হবে। আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও গঠিত হবে।

২০১৪ সালের পর এত বড় সমাবেশ বিএনপি ঢাকায় করতে পারেনি।

শুধু তাই নয়, রাজনৈতিকভাবে এত সফল কর্মসূচিও বিএনপি পালন করতে পারেনি।

ঢাকার আগে দেশব্যাপী যে নয়টি সমাবেশ হয়েছে সেগুলোর সফলতা নিয়ে কারো কোনো প্রশ্ন নেই।

আমি বলবো, ঢাকার সমাবেশটি সবগুলোর চেয়ে সফল হয়েছে।

সকল বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে বহু মানুষ এতে সমবেত হতে পেরেছেন।

স্থান ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মুহূর্তের মধ্যে প্রায় নেতৃত্বহীন এবং সরকারের আক্রমণে বিপর্যস্ত ও অপ্রস্তুত একটি দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী যেভাবে গোলাপবাগে সমবেত হয়েছেন তা ছিল একটা বিস্ময়।

পরদিন সমাবেশ ছিল স্বতঃস্ফূর্ত কিছুটা অগোছালো হলেও এই সমাবেশ ঢাকাবাসীকে জানিয়ে দিতে পেরেছে বিএনপি নতুন করে জেগে উঠেছে। সবচেয়ে বড় কথা, বিএনপি স্বনির্ভর নেতাকর্মীর দল হয়ে উঠেছে। আগে যেকোনো সময়ের তুলনায় তারা খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের সমর্থন পাচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, সরকারের প্রতিক্রিয়া এবং পুরো ঢাকা শহর জুড়ে প্রায় হরতাল ও অবরোধ পরিস্থিতি ছিল বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় বিষয়। সরকারের এই অতিরিক্ত সতর্কতা সাধারণ মানুষ পাঠ করতে পেরেছে। মোবাইল ফোন নিয়ে অনেককে নাজেহাল হতে হয়েছে। চলাফেরা করতে গিয়ে কষ্ট পেতে হয়েছে। আর এসবের জন্য বিএনপিকে কেউ গালি দিয়েছেন সেটা শোনা যায়নি।

৭ তারিখে নয়াপল্টনে বিএনপি’র অফিসে পুলিশ ও দলীয় লোকদের হামলা, সেদিন ও গভীর রাতে নেতাদের গ্রেফতার সরকারের ভুল পদক্ষেপ বলেই মনে হয়েছে।

এ কারণে সরকার বেশ খানিকটা বিদেশি চাপের মুখোমুখি পড়েছে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ৭ ও ১০ ডিসেম্বর ব্যাপক কাভারেজ পেয়েছে। যা নিকট অতীতে ঘটেনি।

তৃতীয়ত, ক্রিকেট ও ফুটবল নেশায় আক্রান্ত কোমাগ্রস্ত ফূর্তিবাজ সুখী মধ্যবিত্ত কিছুটা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পেরেছে। লাখো বিএনপি কর্মী ঢাকায় আসার পরও বাকীরা যে ভয় না পেয়ে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল এটাই একটা বড় ঘটনা বলে মনে হয় আমার কাছে। বিএনপির সঙ্গে ইসলামকে জড়িয়ে ভিক্টিমাইজ করার চেষ্টাও করা হয়েছে সেটা সফল হয়নি। আপাত অর্থে নেতৃত্বহীন বিএনপি নেতাকর্মীরা অনেক উস্কানি সত্ত্বেও মারমুখী হননি।

আমার মনে হয়েছে, বিএনপি সংঘাতে না গিয়ে খুব ভালো কাজ করেছে। সংঘাতে গেলে তারা বড়জোর নয়া পল্টন অফিস উদ্ধার করতে পারতো। এ যাবত যে ৮-১০ জন মারা গেছেন তাদের জায়গায় মৃত্যুর সংখ্যা হয়তো ২০ হতো। কিন্তু এতে সরকার পতন হতো না।

কিন্তু অল্প ক্ষতির ওপর দিয়ে বিএনপিতে অর্জন করতে পারলো সেটা অনেক বড়।

আমার মনে হয়, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকার পতনের দিন শেষ হয়ে এসেছে। শ্রীলংকার অভিজ্ঞতা এক্ষেত্রে শিক্ষনীয় হতে পারে। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বড় জোর রাজাপাকসের বদলে বিক্রমাসিংহে আসতে পারে। এর বেশি কিছু হওয়ার সম্ভাবনা আমি দেখি না।

ফলে খানিকটা ধীর হলেও আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে পরিবর্তন হওয়া ভালো। এক্ষেত্রে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারপন্থী পশ্চিমা বন্ধুরা যথেষ্ট সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মনে হয়।

পশ্চিমা বন্ধুরা এবার যে সিরিয়াসনেস দেখিয়েছেন তা আগামীতে বাড়বে বলে মনে হয়। নিউটনের পঞ্চম সূত্র মতে, চীন যত কাছে আসবে, পশ্চিম তত বেঁকে বসবে।

বাজার, অর্থনীতি, ডলার, জ্বালানি ইত্যাদি সংকটের মধ্যে আলাপ আলোচনাগুলো ফলপ্রসূ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি।

আমার কাছে মনে হয়েছে, ১০ ডিসেম্বরের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা সংসদ থেকে বিএনপির এমপিদের পদত্যাগ।

বিএনপি সরকার, নির্বাচন, ভোটচুরি আগের রাতের ভোট ইত্যাদি নিয়ে অনেক কথা বললেও এতদিন ধরে তাদের এমপিরা সংসদে গিয়ে এসব কথাকে প্রকারান্তরে ভুলই প্রমাণ করেছেন। সংসদের বৈধতা ও গ্রহণযোগ্যতা তাদের উপস্থিতির মাধ্যমে শক্তিশালী হয়েছে। ফলে এটি বিএনপি’র জন্য একটি বড় দুর্বলতা ছিল।

সংসদ থেকে পদত্যাগের মধ্য দিয়ে বিএনপি যে নিজেদের দুর্বলতা থেকে বের হয়ে আসতে পারল এটা ১০ ডিসেম্বরের সবচেয়ে বড় অর্জন।

আমার কাছে মনে হয়, সামনের দিনগুলোতে সরকার বিএনপি’র সঙ্গে বসার জন্য প্রস্তুত হবে। আলাপ আলোচনার মধ্য দিয়ে সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারও গঠিত হবে।

লেখক: সাংবাদিক, কবি ও কথাসাহিত্যিক

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *