শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ডের মূল হোতা খন্দকার মোশতাক

:: শাহরিয়ার শিমূল ::

শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে জড়িয়ে ইতিহাস বিকৃতি ও নোংরা মিথ্যাচার: ইতিহাসের আলোকে মিথ্যাচারিতার জবাব

– “এ প্রসঙ্গে বলে নেয়া ভালো যে, ফারুক-রশীদ মনে করতে পারে যে তারাই ঘটনার মূল শক্তি ও নিয়ন্ত্রক এবং তারাই খন্দকার মোশতাককে রিক্রুট করেছে। প্রকৃত প্রস্তাবে বলা যেতে পারে “More accurate it was Mustaque Ahmed and his political nexus who had taken them on board.” (সূত্রঃ ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, পৃষ্ঠা- ১১০ এবং Bangladesh: The Unfinished Revolution, Lawrence Lifschultz, Page- 102)

– শাফায়াত জামিলের বর্ণনা অনুযায়ী, ভোরবেলায় জিয়াউর রহমানের বাসায় গিয়ে হত্যাকাণ্ডের সংবাদ জানাবার পর তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল এরকম- “So what? President is dead? Vice-President is there. Get your troops ready. Uphold the Constitution.” (সূত্রঃ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, কর্নেল শাফায়াত জামিল, পৃষ্ঠা- ১০৩)। ঘটনার অন্য দুই প্রত্যক্ষদর্শী মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমদ ও আমীন আহম্মেদ চৌধুরীও একইরকম বিবরণ দিয়েছেন।

এখানে লক্ষ্যনীয় বিষয় হচ্ছে, জিয়াউর রহমান সংবিধান অনুসরণ করার কথা বলেছেন, সংবিধানের নির্দেশনা অনুযায়ী উপরাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেয়ার কথা বলেছেন। সেসময় উপরাষ্ট্রপতি ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মোশতাক নয়। একজন সুশৃঙ্খল সেনানায়ক হিসেবে জিয়াউর রহমান সংবিধান অনুসরণের সময়োপযোগী ও সাহসী দিকনির্দেশনাই দিয়েছিলেন। যদিও বিদ্রোহীদের পূর্বপরিকল্পনা, আওয়ামীলীগের নিষ্ক্রিয়তা ও বাহিনী প্রধানদের রহস্যময় ভূমিকার কারণে উপরাষ্ট্রপতি নয়, শপথ নিয়েছিলেন মোশতাক।

– ঘটনার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী আমীন আহম্মেদ চৌধুরীর বর্ণনা অনুযায়ী- “আমরা ড্রয়িংরুমে ঢুকলাম। শাফায়াত জামিল কোনায় গিয়ে দাঁড়ালেন। জিয়া স্লিপিং পোশাকে প্রায় দৌড়ে এলেন। তিনি তখন শেভ করছিলেন। এক গালে শেভ করছেন, অন্য গালে সাবান। এসেই বললেন, ‘শাফায়াত, হোয়াট হেজ হ্যাপেন্ড?’ শাফায়াত জামিল বললেন, ‘অ্যাপেরেন্টলি টু ব্যাটালিয়ন হ্যাজ স্টেজ আ কু।’ জিয়া বললেন, ‘শাফায়াত, উই আর নট ডেকোর, গেট ব্যাক দ্য ট্যাংকস।’ অর্থাৎ আমরা তো বসে থাকার জন্য এখানে আসি নাই, ট্যাংকগুলো এখনই ফেরত নিয়ে আসো। এ কথা বলার পরপরই শাফায়াত বললেন, ‘এইমাত্র রেডিওতে ঘোষণা করা হচ্ছে, দে হ্যাভ কিলড দ্য প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান’, অর্থাৎ ‘তারা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করেছে।’ ‘সো হোয়াট, লেট ভাইস প্রেসিডেন্ট টেক ওভার’, অর্থাৎ ‘তাতে কী হয়েছে, উপরাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতা গ্রহণ করতে দিন।’ এই কথাগুলো যখন হচ্ছিল, তখন কিন্তু রশিদ আরেকটা দরজার সামনে পিস্তল নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।” (সূত্রঃ ১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন, আমীন আহম্মেদ চৌধুরী, পৃষ্ঠা- ১৫৮)

এখানে তিনটি বিষয় লক্ষ্যনীয়। প্রথমত, বিদ্রোহের কথা শোনার সাথেসাথেই জিয়াউর রহমান ঢাকার ব্রিগেড কমান্ডার শাফায়াত জামিলকে ট্যাংক ফিরিয়ে আনার নির্দেশ দিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, এখান থেকেও জানা গেল যে, জিয়াউর রহমান সংবিধান অনুযায়ী উপরাষ্ট্রপতির ক্ষমতা গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন। তৃতীয়ত, এই আলোচনা চলার সময়ে হত্যাকারীদের অন্যতম নেতা রশিদ পিস্তল হাতে পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সেই মুহুর্তের পরিস্থিতিগত বাস্তবতায় জিয়াউর রহমানের অতিবিপ্লবী হবার সুযোগ ছিল না। তাই তিনি কথোপকথনের ক্ষেত্রে কৌশলী ছিলেন, তবে নির্লিপ্ত নয়।

– এসম্পর্কে সেনাবাহিনীর তৎকালীন ঢাকা স্টেশন কমান্ডার লে. কর্ণেল (অব.) এম. এ. হামিদ সাহেবের জবানিতে কিছু কথা শোনা যাকঃ

‘‘কিন্তু জিয়ার অবস্থাও ছিল বেশ নড়বড়ে। চতুর খোন্দকার মোশতাক জেনারেল ওসমানীকে তার সামরিক উপদেষ্টা নিয়োগ করলেন। একই সাথে মেজর জেনারেল খলিলুর রহমানকে ‘চীফ অব ডিফেন্স স্টাফ’ করে জিয়ার উপরে স্থান করে দিলেন। মোশতাক সামরিক ব্যাপারে জেনারেল ওসমানীকেই প্রাধান্য দিতেন। জিয়াকে তেমন পাত্তা দিতেন না। সরাসরি কথাও বলতেন না। এতে জিয়া ভেতরে ভেতরে প্রেসিডেন্ট মোশতাকের ওপর খুবই নাখোশ ছিলেন। এছাড়া জেনারেল ওসমানী ও খলিলুর রহমানের সাথেও জিয়ার এমনিতেই বনিবনা ছিল না। অথচ মোশতাক এদের কিনা তার উপরে স্থান দিয়ে তার ক্ষমতা খর্ব করার প্রয়াস পাচ্ছিলেন।

এ সময় আমি ছিলাম স্টেশন কমান্ডার। এই সুবাদে প্রায়ই জিয়ার সাথে এসব নিয়ে কথাবার্তা হতো। তার অফিসে গেলেই জিয়া রাগে গরগর করত। ওসমানী ও খলিলুর রহমানকে কড়া ভাষায় সমালোচনা করত। আমাকে কয়েকবার ওসমানীর কাছে গিয়ে সরাসরি বুড়োকে সরে দাঁড়াবার কথা বলতে বলল। আমি শুধু হেসে তার রাগ থামাবার চেষ্টা করতাম। জিয়ার অবস্থা তখন খাঁচাবন্দি ব্যাঘ্রের মতো।’’ (সূত্রঃ তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা, লে. কর্ণেল (অব.) এম. এ হামিদ, পৃষ্ঠা- ১১৬-১১৭)

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার প্রতিবাদে মিছিল হবে, ককটেল ইত্যাদি ফুটবে। কোনো কিছুই সেদিন হয়নি। ঢাকা মহানগরী তখন নীরবতা পালন করছিল। একমাত্র কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম তাঁর অনুসারীদের নিয়ে এ হত্যার প্রতিবাদ করতে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে নবগঠিত প্রায় পাঁচ হাজার সদস্য ছিল। তারা এ নৃশংস হত্যার প্রতিবাদে সেদিন একটি গুলিও ছোড়েননি।’

এছাড়া জিয়াউর রহমান ১৯৭৬ সালে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের ক্ষমতা গ্রহণ করার পর অনতিবিলম্বে সেদিনই খন্দকার মোশতাককে গ্রেফতার করেন। এসম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ লিখেছেন- “জিয়াউর রহমান সরকারপ্রধানের ক্ষমতা গ্রহণ করলেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর একটি গ্রেফতার দিয়ে তাঁর কাজের অভিষেক হলো। ২৯ নভেম্বর সন্ধ্যা সাতটায় ঢাকা থেকে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর একটা দল পাঠিয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদকে তাঁর গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হলো।” (সূত্রঃ বিএনপি সময়-অসময়, মহিউদ্দিন আহমদ, পৃষ্ঠা- ৮৯)

এসম্পর্কে জিয়া বিদ্বেষীরা বরাবরই এন্থনি মাসকারেনহাসের সাথে রশিদ ও ফারুকের কথিত এক‌টি সাক্ষাৎকারের উল্লেখ করেন। কিন্তু এ প্রসঙ্গে রশিদ-ফারুক গংয়ের বক্তব্য খুবই বিভ্রান্তিকর। লে. কর্নেল এম. এ. হামিদ তাঁর বইতে উল্লেখ করেছেন- ‘‘অভ্যুত্থানের মূল নায়ক মেজর ফারুকুর রহমান অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তার গোপন পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলেন। অবাক হলেও সত্যি, তিনি তার পরিকল্পনার কথা ১২ আগস্টার আগে পর্যন্ত কাউকে জানাননি, অথবা কারো সাথে পাকাপাকি আলোচনাও করেননি। কারণ বাইরে ভেতরে যে অবস্থা ছিল, তাতে কাউকে বিশ্বাস করার উপায় ছিল না। যদিও ওই সময়ে বেশ কিছু বিক্ষুব্ধ তরুণ অফিসার প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ খুঁজছিল। এদের মধ্যে কর্নেল আমিন, মেজর হাফিজ, গাফফার, নাসের, ডালিম, নূর প্রমুখ ছিলেন। মেজর রশিদ অবশ্য এতে দ্বিমত পোষণ করেছেন। তিনি বলেন, ফারুকের মন্তব্য সঠিক নয়; তিনি নিজেই আলাদাভাবে বহু আগে থেকেই বিভিন্ন সমমনা আর্মি অফিসার এবং কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তির সাথে গোপন আলোচনা চালিয়ে আসছিলেন।

১২ আগস্ট ১৯৭৫। দিনটি ছিল মেজর ফারুকের বিবাহবার্ষিকী। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অফিসার মেসে বেশ বড় রকমের পার্টির আয়োজন করে মেজর ফারুক। অন্যান্যের মধ্যে আমিও উপস্থিত ছিলাম। সবার অজ্ঞাতে ওই দিনই প্রথম ফারুক তার ভায়রা মেজর রশিদকে তার গোপন পরিকল্পনার কথা ব্যক্ত করে। রশিদ প্রথমে চমকে যায়, কিন্তু পরে ফারুকের সাথে একাত্ম হয়। বলা যেতে পারে, ফারুকের প্রস্তাব কিছুটা বাধ্য হয়েই তাকে গ্রহণ করতে হয়। ফারুকের ভাষ্য অনুযায়ী, আমি যখন রশিদকে প্রস্তাব দেই তখন কিছুটা চমকে উঠলেও যখন তাকে বলি, দেখ রশিদ, আমি ঘটনা ঘটাতে যাচ্ছিই, মরি আর বাঁচি। তখন ধরা পড়লে আমি তোমার নাম বলবই কারণ তোমার সাথে এ নিয়ে কথা বলেছি। অতএব ভালো হয় যদি তুমিও যোগ দাও তোমার ইউনিট নিয়ে, তাহলে সাফল্য নিশ্চিত হবে। পার্টি শেষে অনেকক্ষণ তাদের মধ্যে আলোচনা হয়। রশিদের কথা ছিল, এই কাজে আরও কিছু অফিসার দরকার এবং তা গ্রহণ করতে হবে। ফারুক তাতে রাজি হয়। সরকার উৎখাত অপারেশন পরিকল্পনার পুরো দায়িত্বভার মেজর ফারুকের হাতে থাকে এবং রাজনৈতিক দিক মেজর রশিদের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়। এটা অবশ্য মেজর ফারুকের ভাষ্য।” (সূত্রঃ তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা, লে. কর্নেল এম. এ. হামিদ, পৃষ্ঠা- ৩১ ও ৩২)।

পনেরাে আগস্টের অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে এরশাদের ঘনিষ্ঠতা ও তাদের প্রতি তার সহমর্মিতা লক্ষণীয়। পরবর্তী সময়ের দুটো ঘটনা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমটি, খুব সম্ভবত, মেজর জেনারেল জিয়ার সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেয়ার পরবর্তী দ্বিতীয় দিনের ঘটনা। আমি সেনাপ্রধানের অফিসে তার উল্টোদিকে বসে আছি। হঠাৎ করেই রুমে ঢুকলেন সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত ডেপুটি চিফ মেজর জেনারেল এরশাদ। এরশাদের তখন প্রশিক্ষণের জন্য দিল্লিতে থাকার কথা। তাকে দেখামাত্রই সেনাপ্রধান জিয়া বেশ রূঢ়ভাবে জিগ্যেস করলেন, তিনি বিনা অনুমতিতে কেন দেশে ফিরে এসেছেন। জবাবে এরশাদ বললেন, তিনি দিল্লিতে অবস্থানরত তার স্ত্রীর জন্য একজন গৃহভৃত্য নিতে এসেছেন। এই জবাব শুনে জিয়া অত্যন্ত রেগে গিয়ে বললেন, আপনার মতাে সিনিয়র অফিসারদের এই ধরনের লাগামছাড়া আচরণের জন্যই জুনিয়র অফিসাররা রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করে দেশের ক্ষমতা দখলের মতাে কাজ করতে পেরেছে। জিয়া তার ডেপুটি এরশাদকে পরবর্তী ফ্লাইটেই দিল্লি ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তাকে বঙ্গভবনে যেতেও নিষেধ করলেন। এরশাদকে বসার কোনাে সুযােগ না দিয়ে জিয়া তাকে একরকম তাড়িয়েই দিলেন। পরদিন ভােরে এরশাদ তার প্রশিক্ষণস্থল দিল্লিতে চলে গেলেন ঠিকই, কিন্তু সেনাপ্রধান জিয়ার নির্দেশ অমান্য করে রাতে তিনি বঙ্গভবনে যান।

তাহলে এক্ষেত্রে অবধারিত প্রশ্ন আসে, অভ্যুত্থানের মূল পরিকল্পনাকারী ফারুক যদি ১২ আগস্টের আগে কাউকে কিছু না বলে থাকে, তাহলে জিয়া পূর্বে থেকে এরকম কিছু জানবেন কিভাবে?

জিয়াউর রহমানের সমালোচকেরা বারবার যার বই ও সাক্ষাৎকারের রেফারেন্স ব্যবহার করে থাকে সেই এন্থনি মাসকারেনহাস নিজেই একজন বিতর্কিত সাংবাদিক। জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী তাঁর বইতে লরেন্স লিপশুলজ ও এন্থনি মাসকারেনহাস সম্পর্কে লিখেছেন- ‘‘লন্ডনে থাকাকালীন আমার সঙ্গে বাংলাদেশ বিষয়ক দুজন প্রথিতযশা বিদেশি সাংবাদিকের ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়। এদের একজন লরেন্স লিপশুলজ এবং অন্যজন অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস। লরেন্স লিপশুলজের লেখা ‘বাংলাদেশ দি আনফিনিশড রেভুলিউশন’ বইটি অনেকেই পড়ে থাকবেন। আমার মনে হয়, ওই বইতে অনেক ভুল তথ্য আছে এবং তাঁর মতামতের সঙ্গে আমি একমত নই। এ সম্বন্ধে লন্ডনে থাকাকালীন তাঁর সঙ্গে আমার বিস্তারিত আলাপ হয়েছিল। এমনকি তাঁর ওই বইয়ের ওপর আমাকে মতামত দেওয়ার জন্যও তিনি অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু আমি একজন সরকারি কর্মকর্তা, তাই কোনো মতামত দিতে অপারগতা জানাই। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং অন্যান্য ঘটনার প্রতি লিপশুলজের উৎসাহ থাকায় তাঁকে আমার ব্যক্তিগতভাবে ভালো লাগতো। তাঁর রাজনৈতিক ধ্যানধারণায় আমার মনে হতো তিনি মার্কসবাদী। অবশ্য তাঁর বাবা-মা অনেক ধনী ছিলেন এবং তাঁদের সঙ্গে লন্ডনে আমার পরিচয় হয়, যখন তাঁরা আমেরিকা থেকে সেখানে বেড়াতে আসেন। ঠাট্টাচ্ছলে আমি লিপশুলজকে প্রায়ই বলতাম, আমার বাবা-মা ধনী হলে আমিও তোমার মত মার্কসবাদী হতাম।

অ্যান্থনি ম্যাসেকারেনহাস বাংলাদেশে সমাধিক পরিচিত। বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর লেখা রেপ অফ বাংলাদেশ বইটি এবং ‘৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভূমিকার জন্য তাঁর এই ব্যাপক পরিচিতি। ১৯৭১ সালে তিনি পাকিস্তানের করাচিতে একটি পত্রিকায় কাজ করতেন। এপ্রিল মাসে পালিয়ে লন্ডনে এসে সানডে টাইমস পত্রিকায় বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনীর নৃশংসতা, বর্বর হত্যাযজ্ঞের বিবরণী লিখে বিশ্ব-জনমতকে সজাগ করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তিনি বাংলাদেশ এবং উপমহাদেশ সম্বন্ধে সানডে টাইমসে লিখতেন।

আমি লন্ডনে যাওয়ার পর বছরখানেকের মধ্যে লন্ডনস্থ সোনালী ব্যাংক ইউনিয়ন ও ব্যবস্থাপনা পরিষদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বাঁধে। এর তদন্তের ভার দেওয়া হয় আমাকে। তদন্তের একপর্যায়ে সোনালী ব্যাংক ও ম্যাসেকারেনহাসের কিছু তথ্য আমার নজরে আসে। ম্যাসকারেনহাস সোনালী ব্যাংক থেকে প্রায় ২০ হাজার পাউন্ড ঋণ নিয়েছিলান। পরে তা সুদসহ ২৪ হাজার পাউন্ডে দাঁড়ায়। সেদিনের হিসেবে এই টাকার অংক বেশ বড়। ঋণ দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের নির্দেশে। তাঁকে ওই ঋণ পরিশোধের কথা বলা হলে তিনি তা ফেরত দিতে পরোক্ষভাবে অস্বীকৃতি জানান এবং তাঁকে তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ উপরমহলের নির্দেশে ওই অর্থ দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। এসব বিষয় জানার পর এবং অন্যান্য আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণের পর তাঁর সম্পর্কে আমার ধারণা অনেকটা বদলে যায়।

এ পর্যায়ে আমি সরকারকে অবহিত করি, তাঁকে যেন বাংলাদেশে তেমন গুরুত্ব দেয়া না হয়। পরে তাঁকে আর ঢাকাতে ততো গুরুত্ব কিংবা বিশেষ সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়নি, যা বিদেশি সাংবাদিকদের ক্ষেত্রে সচরাচর দেওয়া হয় দেশে এলে। ম্যাসকারেনহাস সে সময় বাংলাদেশ থেকে ঘুরে গিয়ে মনঃক্ষুন্ন হয়ে কর্নেল ফারুকের এক‌টি সাক্ষাৎকার ছাপান। ওই সাক্ষাৎকারের উদ্দেশ্য ছিল তদানীন্তন জিয়া সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করা। আমি দূতাবাসের প্রেস কাউন্সিলর মাহবুবুল আলমের মাধ্যমে (বর্তমানে ঢাকায় ইন্ডিপেন্ডেন্ট পত্রিকার সম্পাদক) সানডে টাইমস পত্রিকার সম্পাদককে স্বাধীনতার পরপর ম্যাসকারেনহাস বাংলাদেশ থেকে যে আর্থিক সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করেছিলেন সে সম্পর্কে পরোক্ষভাবে অবহিত করি। এসব জানার পর সানডে টাইমস পত্রিকার প্রধান সম্পাদক তাঁকে আর বাংলাদেশ সম্পর্কিত বিষয় নিয়ে ওই পত্রিকায় লিখতে দেননি।

ইতিমধ্যে একদিন ম্যাসকারেনহাস প্রেস কাউন্সিলর মাহবুবুল আলমকে টেলিফোনে খুব রাগান্বিত হয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। তাঁর ভাষা ছিল, ‘হোয়াই মইন ইজ ট্রায়িং টু ও্যয়ারি মি?’ এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়, পরবর্তী সময়ে ১৯৮৬ সালে তৎকালীন এরশাদ সরকারের পরোক্ষ মদদে ও পৃষ্ঠপোষকতায় ম্যাসকারেনহাস লেগ্যাসি অফ ব্লাড নামে আর এক‌টি পুস্তক রচনা করেন। বইটি ভালোভাবে পর্যালোচনা করলে তাঁর লেখার উদ্দেশ্য ও প্রেরণা সহজেই অনুধাবন করা যায়।’’ (সূত্রঃ এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য স্বাধীনতার প্রথম দশক, মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী বীরবিক্রম, পৃষ্ঠা- ১০০-১০১)

মাসকারেনহাসের বইয়ের উদ্ধৃতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ফারুক লে. হামিদকে বলেছিল- ‘‘ও ব্যাটা মিথ্যাবাদী, আন্ধা হাফিজ এটা-ওটা যা-তা গল্প বানিয়েছে।’’ (সূত্রঃ তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা, লে. কর্নেল এম. এ. হামিদ, পৃষ্ঠা- ৫৬)

জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশু ২৪ ফেব্রুয়ারী ১৯৯১ সালে তাঁর বাসভবনে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে বলেন-

১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারি/মার্চে আমি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের লবিতে বসে চা পান করছিলাম। আমার সাথে আরও দু’জন বেসামরিক আমলা। পেছনের টেবিলে বসে ২ বিদেশী ও অন্য একজন বাংলাদেশী চা পান করছেন। হঠাৎ আমার বন্ধুটি পেছনের টেবিলের এক বিদেশীর দিকে ইঙ্গিত করে জিজ্ঞেস করলেনঃ

Do you know him?

আমি বললাম, না চিনি না।

তিনি বললেন, আশ্চর্য! তুমি চেননা! ইনি বিখ্যাত ব্যক্তি, A Legacy of Blood-এর লেখক এন্থনী ম্যাসকারেনহাস।

সাথে সাথে আমার রক্ত মাথায় উঠে গেল। আমি সাথে সাথে উঠে সোজাসুজি তার কলার চেপে ধরলাম এবং বললামঃ

Do you know me?

সে উত্তর দিল ‘No’.

রাগে উত্তেজনায় আমি কাঁপছি। বললাম তুমি জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশুকে চিন না। অথচ তোমার বইতে লিখেছ তুমি কয়েক ডজন সামরিক অফিসারের সাক্ষাৎকার নিয়েছো। বিদেশ গিয়ে ফারুক রশীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছো। তারা বলেছে বাংলাদেশে ১৭/১৮ টি ক্যু হয়েছে। জেনারেল জিয়া শত শত সৈনিককে ফাঁসি দিয়েছেন। অথচ তুমি আমাকে চিন না! আমার চেয়ে জিয়ার সময়ের ঘটনাবলী আর কে বেশী জানে?

তোমাকে এই সমস্ত মিথ্যা লেখার জন্য কে কত টাকা দিয়েছে আমি জানতে চাই। নতুবা তোমাকে আমার বাসায় নিয়ে বন্দী করে রাখব। দেখি কোন বাপের বেটা তোমাকে ছাড়াতে আসে। এ বলে তাকে আমি হেঁচড়াতে হেঁচড়াতে ১০/১২ ফুট নিয়ে এলাম। এর মধ্যে অনেক লোক জড়ো হল। অবশেষে ম্যাসকারেনহাস সমবেত লোকদের সামনে তার দোষ স্বীকার করল এবং কার প্ররোচনায় এসব মিথ্যা কথা লিখেছে তাও বলল। অঙ্গীকার করলো সে তার বইয়ের পরবর্তী সংস্করণে সব সত্য কথা লিখবে। কিন্তু তা আর হয়নি। বাংলাদেশ থেকে ইংল্যান্ডে যাওয়ার কিছুদিন পর ম্যাসকারেনহাস মারা যায়।

এ সম্পর্কে জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরীর বক্তব্যটি প্রনিধানযোগ্য- ‘‘মুক্তিযুদ্ধের সময় পদোন্নতিপ্রাপ্ত লে. কর্ণেল, কর্ণেল ও পরে ব্রিগেডিয়ার শফিউল্লাহকে পদোন্নতি দিয়ে মেজর জেনারেল করা হয় এবং সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। জিয়াউর রহমান এবং শফিউল্লাহ একই দিনে পাকিস্তান মিলিটারি অ্যাকাডেমি কাকুলে যোগদান করেন ও একই দিনে কমিশন পেয়ে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে নিয়োগ পান। (তখন নিয়মিত কমিশনের জন্য সামরিক অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষণের মেয়াদ ছিল দুবছর, পরে আমাদের সময়ে তা বাড়িয়ে আড়াই বছর করা হয়)। আর্মিতে অফিসারদের জ্যেষ্ঠতা নির্ণয় করা হয় তাঁদের সামরিক প্রশিক্ষণের সার্বিক ফলাফলের ভিত্তিতে। একই দিনে জিয়াউর রহমান ও শফিউল্লাহ কমিশন পেলেও প্রশিক্ষণের ফলাফলের ভিত্তিতে জিয়াউর রহমানকে জ্যেষ্ঠতা প্রদান করা হয়। জেনারেল জিয়া জ্যেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে আর্মিতে রেখে জেনারেল শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করায় নৈতিক দিক দিয়ে সেনাবাহিনী পরিচালনায় স্বভাবতই তাঁর দূর্বলতা থাকার কথা।

এ নিয়োগ সম্পর্কে পরবর্তীকালে আমি কথা প্রসঙ্গে জেনারেল রবকে জিজ্ঞাসা করি। উত্তরে তিনি আমাকে জানান, প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী শেখ মুজিবের কাছে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সিনিয়র অফিসারদের তালিকা তিনি এবং জেনারেল ওসমানী নিয়ে গেলে শেখ মুজিব শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করেন। এ ব্যাপারে তাঁর এবং জেনারেল ওসমানীর কোনো সুপারিশ ছিল না বলে তিনি আমাকে জানান।’’ (সূত্রঃ এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য স্বাধীনতার প্রথম দশক, মেজর জেনারেল মইনুল হোসেন চৌধুরী বীরবিক্রম, পৃষ্ঠা- ৪০-৪১)

এ প্রসঙ্গে মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমদ বলেছেন- ‘‘চিফ শফিউল্লাহ ও ডেপুটি চিফ জিয়ার মধ্যে মানসিক দূরত্ব ক্রমবর্ধমান ছিল। ডেপুটি চিফ অব স্টাফ পদটি এ সময় অলংকারিক রূপ পরিগ্রহ করে। সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ কোনো ফাইল জিয়ার কাছে আসতো না। চিফ তাঁকে বাইপাস করে সিজিএস এবং দুজন পিএসও (প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার) এজি, সিওএলের মাধ্যমে যাবতীয় কাজ পরিচালনা করতেন। প্রকৃতপক্ষে কর্মহীন জিয়ার একমাত্র দায়িত্ব ছিল চারটি ক্যাডেট কলেজের গভর্নিং বডির চেয়ারম্যানরূপে দায়িত্ব পালন করা। এ দায়িত্বকে জিয়া সিরিয়াসলি নিয়েছিলেন। প্রতি মাসেই তিনি একটি ক্যাডেট কলেজ ভিজিট করতেন এবং কলেজের দৈনন্দিন কার্যক্রম, পাঠ্যক্রম, শৃঙ্খলা ইত্যাদি বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে খতিয়ে দেখতেন।’’ (সূত্রঃ সৈনিক জীবন গৌরবের একাত্তর রক্তাক্ত পঁচাত্তর, হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম, পৃষ্ঠা- ১৪১-১৪২)

জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন সুশৃঙ্খল সেনানায়ক। সেনাবাহিনীতে কখনোই তিনি কোন বিশৃঙ্খলাকে প্রশ্রয় দেননি। মেজর ডালিমের সাথে আওয়ামীলীগ নেতা গোলাম মোস্তফার ছেলের আলোচিত দ্বন্দ্বের ঘটনায় উস্কানি দেয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তিনি তা না করে বরং সেনা শৃঙ্খলা বজায় রাখতে তৎপর ছিলেন। ঘটনাটি ছিল এরকম- ‘‘এক সন্ধ্যায় মেজর ডালিমের একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেনাবাহিনীতে তোলপাড় সৃষ্টি হলো। ইস্কাটন লেডিস ক্লাবে ডালিমের এক আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান চলছিল। তাঁর বিদেশ-প্রত্যাগত লম্বা চুলধারী শ্যালক অনুষ্ঠান উপভোগ করছিল। ঢাকা নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি গাজী গোলাম মোস্তফার পুত্র ডালিমের শ্যালকের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করলে ডালিম শ্যালকের পক্ষ নিয়ে গাজীপুরকে চড় মারেন। পুত্রের নালিশের পরিপ্রেক্ষিতে গাজী সাহেব একটি মাইক্রোবাসে দলবল নিয়ে এসে ডালিমকে চুল ধরে মাইক্রোবাসে তুলে নেন। ডালিমের স্ত্রী নিম্মি স্বামীকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে এলে তাঁকেও জোর করে গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়। ডালিমের শাশুড়ি বঙ্গবন্ধু পরিবারের সঙ্গে ঘনিষ্ট ছিলেন। এই সুবাদে ডালিমেরও ৩২ নম্বরে যাতায়াত ছিল। গাজী একপর্যায়ে বিষয়টি মীমাংসার জন্য সস্ত্রীক ডালিমকে ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে নিয়ে যান। ইতিমধ্যে ডালিমকে অপহরণ করা হয়েছে মর্মে খবর পেয়ে সেনানিবাসে মিলিটারি পুলিশের অফিসার কমান্ডিং মেজর আমিনুল ইসলাম গাজী গোলাম মোস্তফার বাড়িতে গিয়ে ডালিমকে উদ্ধারের জন্য তল্লাশি চালান।

৩২ নম্বরে গিয়ে ক্রন্দনরত ডালিমের স্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর কাছে গাজীর বিরুদ্ধে নালিশ জানান। প্রধানমন্ত্রী উভয়কে সান্ত্বনা দেন এবং বাড়িতে ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন।

পরদিন সকালে ডালিম সেনা হেডকোয়ার্টারে এসে অফিসারদের কাছে কাঁদতে কাঁদতে তাঁর ও তাঁর স্ত্রীর প্রতি আগের রাতের দুর্ব্যবহারের বর্ণনা দিলে সব অফিসার উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। তাঁরা এর প্রতিকারের জন্য দলবদ্ধভাবে সিনিয়র অফিসারদের কাছে ধরনা দেন। ডালিম জনা দশেক মেজর পদবীর অফিসারকে সঙ্গে নিয়ে অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ঘরে ঢুকে তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে দুর্বৃত্তদের দুর্ব্যবহারের ঘটনা বর্ণনা করেন। এরশাদ উত্তেজিত স্বরে বলেন, ‘This is too much.’ আমি চিফকে বলেছি আপনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে শক্ত প্রতিবাদ জানান। আমরা এনশিওর করব যে আপনাকে (চিফকে) সরিয়ে দিলে কোন সেকেন্ড লেফটেন্যান্টও চিফের চেয়ারে বসবে না। ক্ষুব্ধ অফিসাররা এরশাদকে অনুরোধ করেন তিনি যেন তাঁদের ডিসিএএস ও সিএএসের অফিস রুমে নিয়ে যান।

এরশাদ ক্ষুব্ধ অফিসারদের নিয়ে ডিসিএএস জিয়ার রুমে প্রবেশ করেন। আমিও পেছন পেছন গেলাম। ডালিম গত রাতের ঘটনা জিয়ার কাছে বর্ণনা করেন। জিয়া খুবই বিরক্ত, তাঁর সামনে উপবিষ্ট কর্নেল এরশাদকে বললেন, ‘এতে হইচই করার কী আছে। আপনি নিজে শৃঙ্খলা বিধানের দায়িত্বপ্রাপ্ত এজি, অথচ আপনিই তো শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছেন। Go back to your place for work.’’ (সূত্রঃ সৈনিক জীবন গৌরবের একাত্তর রক্তাক্ত পঁচাত্তর, হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীর বিক্রম, পৃষ্ঠা- ১৫২-১৫৩)

– এসম্পর্কে লে. কর্নেল হামিদ তাঁর বইতে লিখেছেন- ‘‘…ডেপুটি চীফ হিসেবে তাঁর ক্ষমতা ছিল সীমিত এবং তখনকার সময় প্রায় ক্ষমতাহীন ও একঘরে। এছাড়া তাঁর ওপর টিকটিকিদের ছিল কড়া নজর।’’ (সূত্রঃ তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা, লে. কর্নেল এম. এ. হামিদ, পৃষ্ঠা- ২৯) এরকম নজরদারীর মাঝে ও কোনঠাসা পরিস্থিতিতে কোন ষড়যন্ত্রের সাথে জড়িত হওয়ার প্রশ্ন তোলা নিতান্তই বাতুলতা।

সেনাবাহিনীর সেসময়কার পরিস্থিতি বুঝতে সেদিনের বিডিআর প্রধান ও শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন মেজর জেনারেল এম খলিলুর রহমানের এক‌টি বর্ণনা শোনা যাক- ‘‘তবে পঞ্চম বেঙ্গলে যাওয়ার ও আসার সময় এক‌টি দৃশ্য দেখে মনটা আঁতকে উঠেছিল। যাওয়ার সময় এক‌টি প্রশিক্ষণ মাঠের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। কিছুসংখ্যক সৈনিক সেখানে প্রশিক্ষণরত ছিল। তাদের প্রায় সবাই দেখলাম লুঙ্গি পরা। কেউ লুঙ্গি কাছামারা অবস্থায় কেউ বা লুঙ্গিটা খাটো করে হাঁটু অবধি তুলে রাইফেল ধরে প্রথামাফিক দাঁড়িয়ে আছে। সবার হাতেই রাইফেল, যদিও পুরোনো মডেলের। খালি পা, লুঙ্গি ও গেঞ্জি অথবা হাফশার্ট পরা, রাইফেল হাতে নিয়মিত সৈনিক আমি ইতিপূর্বে দেখিনি। চমকে উঠে সালামকে জিজ্ঞেস করাতে তিনি বললেন, ‘‘এদের এখনো উর্দি দেয়া সম্ভব হয়নি। কাপড়ের অভাব।’’ (সূত্রঃ কাছে থেকে দেখা ১৯৭৩-১৯৭৫, মেজর জেনারেল এম খলিলুর রহমান, পৃষ্ঠা- ২৪)

সশস্ত্র বাহিনীর বেতন নির্ধারণেও গাফিলতি ছিল দৃশ্যমান। এসম্পর্কে খলিলুর রহমান বলেন- ‘‘সশস্ত্র বাহিনীর বেতন স্কেল নির্ধারণের জন্য কমিটি গঠন সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের আরও একটি উদাহরণ। সারা বিশ্বেই সশস্ত্র বাহিনীর বেতনকাঠামো সিভিল সার্ভিসের বেতন কাঠামো থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে। এর প্রধান কারণ সৈনিকেরা বিনা মূল্যে খাদ্য ও বাসস্থান পায়, যাতে যেকোন মুহুর্তে হঠাৎ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেও সম্মুখযুদ্ধরত সৈনিকের আহার সরবরাহ ঠিক থাকে ও তাদের ফেলে আসা পরিবারগুলোর জন্য দুঃশ্চিন্তা থেকে তারা সম্পূর্ণভাবে মুক্ত থাকতে পারে। এ ছাড়া তিন বাহিনীর পদকাঠামো, যোগ্যতা ও পেশাকাঠামো ইত্যাদির মধ্যেও ভিন্নতা আছে, যে কারণে এদের বেতন নির্ধারণ অনেকটা জটিল এবং সিভিল কর্মচারীর বেতনকাঠামো, গ্রেড ইত্যাদি থেকে একেবারেই আলাদা। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, স্বাধীন বাংলাদেশের কর্মচারীদের জন্য যে জাতীয় বেতন কমিশন গঠন করা হয়, সেই একই কমিশনকে সশস্ত্র বাহিনীর বেতনকাঠামো নির্ধারণেরও দায়িত্ব দেয়া হয়। এ ছিল এক অদ্ভূত সিদ্ধান্ত।

…সৈনিকদের একদল মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল আর বাকি সৈনিকেরা পাকিস্তানে আটক অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, অর্থাৎ সাধারণ সৈনিকেরা অর্থনৈতিকভাবে চরম দুরবস্থার ভেতর দিয়ে দিন কাটাচ্ছিল। অথচ বেতন বোর্ডের কাজের অগ্রগতির কোনো লক্ষণই দেখা যাচ্ছিল না।’’ (সূত্রঃ কাছে থেকে দেখা ১৯৭৩-১৯৭৫, মেজর জেনারেল এম খলিলুর রহমান, পৃষ্ঠা- ২৪)

সেনাবাহিনীর ক্ষুব্ধতার আরেকটি কারণ ছিল- রক্ষীবাহিনী। ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত এসম্পর্কে বলেছেন- ‘‘পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তনের পরই প্রথম দেখলাম জাতীয় রক্ষীবাহিনী নামক অত্যন্ত সুসজ্জিত, সুশৃঙ্খল এক‌টি বাহিনী যার গায়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম, হাতে ভারতীয় আধা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল ও অন্যান্য সরঞ্জাম। রক্ষীবাহিনীর সব অফিসারই শুধু মুষ্টিমেয় সামরিক অফিসার ছাড়া ভারতের দেরাদুনের ব্যাটল স্কুল থেকে প্রাথমিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এবং সরাসরি রক্ষীবাহিনীর ব্যাটালিয়নগুলোতে নিয়োজিত করা হতো। তবে নিয়োগের পূর্বে সাভারের রক্ষীবাহিনী ট্রেনিং ক্যাম্পে কিছুদিন অন্যান্য প্রশিক্ষণ দেয়া হতো। প্রতিটি ব্যাটালিয়ন তখনকার সেনা ব্যাটালিয়নগুলো থেকে সুসংগঠিত ছিল। প্রসঙ্গত ১৯৭৫ সালে রক্ষীবাহিনীতে ১৭ ব্যাটালিয়ন আর সেনাবাহিনীতে ১৬ টি ইনফেনট্রি ব্যাটালিয়ন ছিল।

…সেনাবাহিনীতে প্রায়ই অফিসার ও জওয়ানদের মধ্যে রক্ষিবাহিনীর বিরূপ প্রতিক্রিয়ার আভাস পাওয়া যেত। অনেক ক্ষেত্রে সোচ্চার হতেও দেখা যেত। বিশেষ করে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যবৃন্দ ছুটি কাটিয়ে ইউনিটে ফেরত আসার পর রক্ষীবাহিনী কর্তৃক গ্রামে-গঞ্জের নিরীহ জনগণকে হয়রানি করার খবর গল্পের আকারে সৈনিকদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ত। অনেক ক্ষেত্রে সেনাসদস্যদের পরিবার পরিজনের উপর অত্যাচারেরও অভিযোগ লিখিতভাবে উত্থাপিত হতো, কিন্তু কখনই প্রতিকার পাওয়া যেতো না। সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা এবং অমুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে মানসিক দূরত্ব থাকলেও রক্ষীবাহিনীর কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সবাই একমত পোষন করত। সব সদস্যেরই দৃঢ় বিশ্বাস রক্ষীবাহিনীর budget, defence budget থেকে অনেক বেশি ছিল। রক্ষীবাহিনীর রসদ থেকে শুরু করে সব সরঞ্জামের প্রাধিকার ছিল অন্যান্য বাহিনীর উর্ধ্বে। তখন সেনাবাহিনীতে ইউনিফর্মের ঘাটতি পূরণের জন্য কিছু কিছু ভারত থেকে আনানো হলেও এগুলোর সাইজ এত ছোট ছিল যার বেশির ভাগই সঠিক মাপে লাগত না। গুজব রটানো হলো যে, ভারত ইচ্ছে করে সে দেশের সেনাবাহিনীর বাতিলকৃত পোশাক পাঠায় বলেই এরূপ অবস্থা। তবে এটা সত্য যে, তখন জুতা থেকে রাইফেল পর্যন্ত প্রচুর ঘাটতি ছিল আর এ ঘাটতি মিটাতে এসব সরঞ্জাম আমদানি করা হতো ভারত থেকে যার বেশির ভাগ দ্রব্যই ছিল নিম্নমানের। প্রসঙ্গত বলতে হয় যে, এ প্রচারণা এত বেশি বেশি হতে থাকল যে, আস্তে আস্তে সমগ্র সেনাবাহিনী ভারতবিদ্বেষী হয়ে উঠল’’ (বাংলাদেশ রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-৮১, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন, পৃষ্ঠা- ৩০-৩১)

শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর জ্যেষ্ঠতার সাধারণ নিয়ম অনুযায়ীই জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধানের পদে অধিষ্ঠিত হন। কিন্তু মোশতাক সরকার ও বিদ্রোহী অফিসারদের সাথে তাঁর ভাল সম্পর্ক ছিল না। এক্ষেত্রে দুটি ঘটনা প্রণিধানযোগ্যঃ

‘‘১৯ আগস্ট সেনাসদরে আরেকটি মিটিং হয়। বেশ উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হলাে মিটিংয়ে। সেনাপ্রধান সভায় ঢাকাস্থ সকল সিনিয়র অফিসারকে তলব করেন। তিনি মেজর রশিদ ও ফারুককে সঙ্গে করে কনফারেন্স রুমে এলেন। বললেন, প্রেসিডেন্ট মােশতাকের নির্দেশে রশিদ ও ফারুক সিনিয়র অফিসারদের কাছে অভ্যুত্থানের বিষয়টি ব্যাখ্যা করবে। রশিদ তার বক্তব্য শুরু করলো। সে বললাে, সেনাবাহিনীর সব সিনিয়র অফিসার এই অভ্যুত্থানের কথা আগে থেকেই জানতেন। এমন কি ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডারও (অর্থাৎ আমি) এ বিষয়ে অবগত ছিলেন। রশিদ আরাে দাবি করলাে, প্রত্যেকের সঙ্গে আগেই তাদের আলাদাভাবে সমঝােতা হয়েছে। উপস্থিত অফিসারদের কেউই এই সর্বৈব মিথ্যার কোনাে প্রতিবাদ করলেন না। একটি শব্দও উচ্চারণ করলেন না কেউ। কিন্তু আমি চুপ করে থাকতে পারলাম না। নীরব থাকা সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে। ফারুক-রশিদের মিথ্যে বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে আমি সেদিন বলেছিলাম, “You are all liars, mutineers and deserters. You are all murderers. Tell your Mustaque that he is an usurper and conspirator. He is not my President. In my first opportunity I shall dislodge him and you all will be tried for your crimes.” আমার কথা শুনে তারা বাক্যহীন হয়ে পড়ে এবং বিষন্ন মুখে বসে থাকে। পরবর্তী সময়ে জীবন বাজি রেখে সে কথা রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করি আমি। যাই হােক, আমার তীব্র প্রতিবাদের মুখে মিটিং শুরু হতে-না-হতেই ভেঙে গেলাে। সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ উঠে গিয়ে তার কক্ষে ঢুকলেন। উপপ্রধান জিয়া অনুসরণ করলেন তাকে। আমি তখন স্বভাবতই বেশ উত্তেজিত। তাদের দুজনের প্রায় পেছনে পেছনেই গেলাম আমি। সেনাপ্রধানের কক্ষে ঢুকতেই জিয়া আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, “শাফায়াত, একেবারে ঠিক আচরণ করেছে ওদের সঙ্গে। একদম সঠিক কাজটা করেছে। কিপ ইট আপ। ওয়েল ডান!” (সূত্রঃ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, কর্নেল শাফায়াত জামিল, পৃষ্ঠা- ১১১)

উপরোক্ত বইয়ের ১২০ ও ১২১ নং পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে- ‘‘পনেরাে আগস্টের অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে এরশাদের ঘনিষ্ঠতা ও তাদের প্রতি তার সহমর্মিতা লক্ষণীয়। পরবর্তী সময়ের দুটো ঘটনা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রথমটি, খুব সম্ভবত, মেজর জেনারেল জিয়ার সেনাপ্রধানের দায়িত্ব নেয়ার পরবর্তী দ্বিতীয় দিনের ঘটনা। আমি সেনাপ্রধানের অফিসে তার উল্টোদিকে বসে আছি। হঠাৎ করেই রুমে ঢুকলেন সদ্য পদোন্নতিপ্রাপ্ত ডেপুটি চিফ মেজর জেনারেল এরশাদ। এরশাদের তখন প্রশিক্ষণের জন্য দিল্লিতে থাকার কথা। তাকে দেখামাত্রই সেনাপ্রধান জিয়া বেশ রূঢ়ভাবে জিগ্যেস করলেন, তিনি বিনা অনুমতিতে কেন দেশে ফিরে এসেছেন। জবাবে এরশাদ বললেন, তিনি দিল্লিতে অবস্থানরত তার স্ত্রীর জন্য একজন গৃহভৃত্য নিতে এসেছেন। এই জবাব শুনে জিয়া অত্যন্ত রেগে গিয়ে বললেন, আপনার মতাে সিনিয়র অফিসারদের এই ধরনের লাগামছাড়া আচরণের জন্যই জুনিয়র অফিসাররা রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করে দেশের ক্ষমতা দখলের মতাে কাজ করতে পেরেছে। জিয়া তার ডেপুটি এরশাদকে পরবর্তী ফ্লাইটেই দিল্লি ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। তাকে বঙ্গভবনে যেতেও নিষেধ করলেন। এরশাদকে বসার কোনাে সুযােগ না দিয়ে জিয়া তাকে একরকম তাড়িয়েই দিলেন। পরদিন ভােরে এরশাদ তার প্রশিক্ষণস্থল দিল্লিতে চলে গেলেন ঠিকই, কিন্তু সেনাপ্রধান জিয়ার নির্দেশ অমান্য করে রাতে তিনি বঙ্গভবনে যান। অনেক রাত পর্যন্ত তিনি সেখানে অবস্থানরত অভ্যুত্থানকারীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এর থেকেই মনে হয় এরশাদ আসলে তাদের সঙ্গে সলাপরামর্শ করার জন্যই ঢাকায় এসেছিলেন।”

জিয়াউর রহমান বিদ্রোহী অফিসারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। তিনি প্রেসিডেন্ট মোশতাকের নির্দেশ সত্ত্বেও বিদ্রোহী অফিসারদের সেনানিবাসে ফিরিয়ে নিতে রাজি হননি (বিএনপি সময় অসময়, ৬৫ নং পৃষ্ঠা দ্রষ্টব্য)। আবার বিদ্রোহীরাও জিয়াউর রহমানের ট্যাংক সেনানিবাসে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ অগ্রাহ্য করেছিল। তবে দেশের সামগ্রিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে জিয়াউর রহমান বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে কিছুটা সময় নিচ্ছিলেন। সেসময়কার অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে যেকোন ভুল পদক্ষেপের পরিণতিতে গৃহযুদ্ধেরও শঙ্কা ছিল। কিন্তু শাফায়াত জামিলের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য এক‌টি নতুন ব্রিগেড গঠন ও খালেদ মোশাররফকে অবসর দেয়ার গুঞ্জনের প্রেক্ষাপটে তারা জরুরীভাবে একটি ব্যবস্থা গ্রহণে অসহনশীল হয়ে ওঠেন।

এসম্পর্কে শাফায়াত জামিল বলেন- ‘‘২৯ অক্টোবর রাত ১১টায় জিয়া আমাকে তাঁর অফিসে ডাকলেন। ডেকে আমাকে তিনি ক্ষোভের সঙ্গে জানালেন, প্রতিরক্ষা বিভাগের একজন সিনিয়র কর্মকর্তার সুন্দরী স্ত্রীর সঙ্গে মেজর শাহরিয়ার অশালীন ব্যবহার করেছে। জিয়া বললেন, এরা অত্যন্ত বাড়াবাড়ি করছে। ট্যাঙ্কগুলো থাকাতেই ওদের এতো ঔদ্ধত্য। তুমি একটা এক্সারসাইজের আয়োজন করে ট্যাঙ্কগুলো সাভারের দিকে নিয়ে যাও। আমি উৎসাহিত হয়ে জানতে চাইলাম, কবে নাগাদ এটা করবো। জবাবে জিয়া বললেন, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে করো। আমি চুপসে গেলাম। আমরা ভাবছিলাম দু’একদিনের মধ্যেই কিছু করার কথা, আর জিয়া কি না ট্যাংক বাইরে নিতে বললেন আরো ২/৩ মাস পর! আমার মনে হলো, জিয়াকে নিয়ে কিছু করা যাবে না। বরং খালেদ মোশাররফের সঙ্গেই কাজ করা যাক।” (সূত্রঃ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, কর্নেল শাফায়াত জামিল, পৃষ্ঠা- ১৩২)

বিদ্রোহী সেনা অফিসারদের যখন বিদেশে পাঠানো হয়, জিয়াউর রহমান তখন গৃহবন্দী। ক্ষমতার নাটাই তখন খালেদ মোশাররফ-শাফায়াত জামিলদের হাতে। এসম্পর্কে শাফায়াত জামিলের স্বীকারোক্তি- ‘‘৩ নভেম্বর ভাের থেকে শুরু হয় ১৫ আগস্টের হত্যাকারী বিদ্রোহী অফিসার তথা ক্ষমতা দখলকারীদের সঙ্গে টেলিফোনে আমাদের বাক-যুদ্ধ। আমাদের দিকে খালেদ মােশাররফ এবং ওদিকে পর্যায়ক্রমে রশিদ, জেনারেল ওসমানী, সর্বোপরি, খন্দকার মােশতাক। দুপুরের পর আমাদের পক্ষ থেকে একটি negotiation team পাঠানাে হয় বঙ্গভবনে ৩/৪ জন অফিসারের সমন্বয়ে। খুনিরা আমাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তারা সংঘাতের পথ বেছে নেয়। প্রথমে তারা গরম গরম কথা বললেও সারা দিন হেলিকপ্টার ও মিগের মহড়া দেখে ক্রমশ বিচলিত হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত সন্ধ্যার দিকে প্রেসিডেন্ট মােশতাক কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে ওসমানী বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের দেশত্যাগের জন্য সেফ প্যাসেজের অঙ্গীকার দাবি করলেন। সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ, রক্তক্ষয় ও বেসামরিক নাগরিকের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানাের জন্য অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাদের দেশত্যাগের সেফ প্যাসেজ দিতে রাজি হলাম আমরা। সে-সময় এটা আমাদের মনে ছিল যে, বিদেশে চলে গেলেও প্রয়ােজনে পরে ইন্টারপােলের সাহায্যে তাদের ধরে আনা যাবে। ঠিক হলো, ফারুক-রশিদ গংকে ব্যাঙ্কক পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করবে বিমানবাহিনী প্রধান এম. জি. তাওয়াব।” (সূত্রঃ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, রক্তাক্ত মধ্য-আগস্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর, কর্নেল শাফায়াত জামিল, পৃষ্ঠা- ১৩৫-১৩৬)

১৯৭৯ সনের ৪ঠা আগস্ট, 8 Days পত্রিকায় ‘দি ম্যান হু কিলড মুজিব’, শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। উক্ত পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে মেজর রশীদ বলেছেনঃ তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশকে ইসলামিক রাষ্ট্রে পরিণত করা (সূত্রঃ ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, পৃষ্ঠা- ১২১)। অথচ জিয়াউর রহমানের অবস্থান ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারের বিরোধী ছিলেন।

শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল না। একাধিকবার সতর্ক করার পরেও শেখ মুজিবুর রহমান এই বিষয়ে কিছুটা নির্লিপ্তই ছিলেন বলা চলে। এসম্পর্কে তৎকালীন বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল এম খলিলুর রহমান বলেছেন- ‘‘একদিন দুপুরবেলায় তিনি আমাকেও ডাকলেন তাঁর অফিসে। কিন্তু তখন তাঁর খাওয়ার সময় হয়ে গেছে বলে তিনি গেলেন অফিসের একই আঙিনায় অবস্থিত তাঁর অফিসিয়াল বাসস্থান গণভবনে। সেখানে তিনি রাত যাপন করতেন না। কেবল দুপুরের খাবার খেতেন এবং বিকেলে সভা, সাক্ষাৎকার ইত্যাদিতে থাকতেন। রাত যাপন করতেন ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কে। এখানে উল্লেখ্য যে অনেকবার আমরা তাঁকে বলেছি নিরাপত্তাজনিত সুবিধার্থে তাঁর গণভবনেই বাস করা উচিত। কিন্তু তিনি শোনেননি। অনেকেই মনে করেন, যদি তিনি গণভবনে বাস করতেন, তাহলে ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট গুটি কয়েক জুনিয়র অফিসার ওইভাবে সহজে তাঁকে হত্যা করতে পারত না।” (সূত্রঃ কাছে থেকে দেখা ১৯৭৩-১৯৭৫, মেজর জেনারেল এম খলিলুর রহমান, পৃষ্ঠা- ২১৭)

একবার লে. কর্নেল হামিদ শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সাক্ষাতে গিয়েছিলেন। এর বর্ণনায় তিনি লিখেছেন- ‘‘বিদায় নেওয়ার প্রাক্কালে তাঁকে শুধু একটি কথা বললাম, স্যার, আপনার বাসায় সিকিউরিটি বলতে কিছুই নেই। আমি সরাসরি ঢুকে পড়লাম। বদ মতলবেও তো কেউ ঢুকে পড়তে পারত।” (সূত্রঃ তিনটি সেনা অভ্যুত্থান ও কিছু না বলা কথা, লে. কর্নেল এম. এ. হামিদ, পৃষ্ঠা- ২৫)

শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর সেই বাড়িতে গিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেছেন- ‘‘গাড়ির ভিতরে বসে বাড়ির দিকে তাকালাম। আমার জীবনে প্রথম এ ঐতিহাসিক বাড়ি দর্শন। অত্যন্ত সাধারণ কাঠামোর এক‌টি অসম্পূর্ণ তিন তলা মধ্যবিত্ত বাঙালি পরিবারের বাড়ি। প্রায় সম্পূর্ণ প্লটেই বাড়িখানা নির্মিত। ধানমন্ডির অন্যান্য বাড়ির তুলনায় নিতান্তই ছোট জায়গার উপরে তৈরি। এর আশেপাশের বাড়িগুলোও প্রায় গায়ে গায়ে লাগানো। বাড়িগুলো এতো ঘন যে, রাষ্ট্রপতির সামান্য নিরাপত্তা দেয়াও এখানে দুরূহ ব্যাপার।” (সূত্রঃ বাংলাদেশ রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-৮১, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন, পৃষ্ঠা- ৪১)

ইন্দিরা গান্ধী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মাধ্যমে অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, এমনকি শেখ মনিও তাঁকে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। অধ্যাপক আবু সাইয়িদ বিষয়টির বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে- ‘‘১৯৭৫ সনের আগস্টের প্রথম সপ্তাহ। সি. আই. এর শক্তিধর ব্যক্তিত্ব জর্জ গ্রিফিন তখন কলকাতায়। একটি দল বাংলাদেশ থেকে বেড়াতে কলকাতায় গেল। গোপনে যোগাযোগ করল গ্রিফিনের সাথে। ঐ দলের মধ্যে ছিল মেজর (অব.) ডালিম। দলের অন্যান্যদের একদিন সে কথা প্রসংগে বলেই ফেলেছে এ মাসেই আর্মি ক্যু হবে। ক্ষমতা আমাদের হাতে আসবে। ঢাকায় ফিরে এসে দলসংগীদের একজন এ কথা বললে, ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে ঐ দিন রাতে আমি তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী ও বাকশালের সেক্রেটারি জেনারেল এম, মুনসুর আলীকে বিষয়টি রিপোর্ট করি।

প্রধানমন্ত্রী সেদিন যশোহর ক্যান্টনমেন্টে সেনাবাহিনী পরিদর্শন করে এসেছেন। উৎপাদনশীল কাজে সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে বক্তব্য রেখেছেন। তাদের দ্বিতীয় বিপ্লবের ক্যাডার হওয়ার উপদেশ দিয়ে এসেছেন। তিনি বেশ ক্লান্ত ছিলেন। আমার এই রিপোর্ট শোনার পর তিনি স্প্রিং-এর মতো চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠলেন। আমার হাত ধরে লনে নিয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করাতে বলেছিলাম, খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে ক্যু সংগঠিত হবে। তিনি নির্বাক হয়ে গেলেন।

বহুক্ষণ পায়চারী করার পর তিনি বললেনঃ ক্যু করলে মোশতাক করবে না- করবে তাজউদ্দিন। (সূত্রঃ ফ্যাক্টস এন্ড ডকুমেন্টস, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, পৃষ্ঠা- ১১০)

আলতাফ পারভেজ তাঁর বইতে লিখেছেন, জিয়াউর রহমানও অন্তত ১৫ দিন পূর্বে শেখ মুজিবুর রহমানকে এক‌টি বিদ্রোহের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু এসব সতর্কবাণীকে খুব একটা আমলে নেয়া হয়নি।

আমীন আহম্মেদ চৌধুরী এ সম্পর্কে বলেন- ‘‘মূলত এরশাদই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে সামরিক আইনের মাধ্যমে দেশ শাসন করেছিলেন। এর আগ পর্যন্ত সামরিক আইনের মাধ্যমে কেউ দেশ শাসন করেননি। জিয়া সামরিক আইন জারি করেননি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর মোশতাক ক্ষমতায় এসে সামরিক আইন জারি করেন। জিয়া তাঁর অধীনে ছিলেন। পরে তিনি সায়েমের অধীনে ছিলেন। পরে যদিও জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছেন, কিন্তু প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে তিনি নিজে কোনো ফরমান জারি করেননি। খালেদ মোশাররফও কোন সামরিক ফরমান জারি করেননি। এরশাদ প্রথম থেকেই সামরিক ফরমান জারি করে দেশ শাসন করেন। জিয়া দ্রুত সামরিক আইন প্রত্যাহার করে গণতন্ত্রে ফিরে গিয়েছিলেন।’’ (সূত্রঃ ১৯৭১ ও আমার সামরিক জীবন, আমীন আহম্মেদ চৌধুরী, পৃষ্ঠা- ১৭৬)

এখানে উল্লেখ্য, ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি খন্দকার মোশতাক জারি করেন ২৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭৫ সালে।

ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন এসম্পর্কে বলেছেন- ‘‘ ১৫ ই আগস্ট ১৯৭৫ সকাল ১০ টায় তৎকালীন ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল সাফায়াত জামিল আমাকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গেইট থেকে ফিল্ম রোল আনতে বললে আমি তাঁর নির্দেশ পালন করতে ড্রাইভারসহ গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিলাম। আমি শংকিত ছিলাম যে, হয়তো তৎকালীন আওয়ামী লীগের বিশাল সংগঠন, যুবলীগ, ছাত্রলীগ কর্মীদের ইট-পাটকেলের মুখে পড়তে হবে। আওয়ামী লীগের লক্ষ লক্ষ নেতা-কর্মী রয়েছে। পাকিস্তানি কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার জন্য মুক্তিপাগল মানুষ সংগ্রাম করেছে। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে এদেশের স্বাধীনতার জন্য যারা প্রাণ দিতে কণ্ঠাবোধ করেননি, সেই সব নিবেদিত প্রাণ বঙ্গবন্ধু-ভক্তদের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের মুখে পড়তে হবে। যারা তাঁর সাথে সংগ্রাম করেছে তাদের মত ত্যাগী মানুষ, আর যারা ক্ষমতায় গিয়ে নিজেদের ভাগ্য গড়েছেন তারাও প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন। কিন্তু প্রতিবাদ কিংবা প্রতিরোধের কিছুই প্রত্যক্ষ করলাম না। শুধু দেখলাম পুরো রাস্তা জনশূন্য। আমি আরও ভেবেছিলাম, যারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য ছিলেন, তাঁদের কেউ নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মাহুতি দিয়ে বিশ্ববাসীর সামনে এ হত্যার প্রতিবাদ করবেন। ভিয়েতনাম যুদ্ধে এমনই হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার প্রতিবাদে মিছিল হবে, ককটেল ইত্যাদি ফুটবে। কোনো কিছুই সেদিন হয়নি। ঢাকা মহানগরী তখন নীরবতা পালন করছিল। একমাত্র কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম তাঁর অনুসারীদের নিয়ে এ হত্যার প্রতিবাদ করতে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে নবগঠিত প্রায় পাঁচ হাজার সদস্য ছিল। তারা এ নৃশংস হত্যার প্রতিবাদে সেদিন একটি গুলিও ছোড়েননি।’’ (সূত্রঃ বাংলাদেশ রক্তাক্ত অধ্যায় ১৯৭৫-৮১, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন, পৃষ্ঠা- ১৯)

এম খলিলুর রহমান এসম্পর্কে বলেছেন- ‘‘এবার আসা যাক রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে। রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করা হলো প্রত্যুষে। এই অপ্রত্যাশিত হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ দলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হওয়ার কথা। জাতির ও দেশের এই চরম বিপদ মুহুর্তে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষমতাসীন দলের উচিত ছিল দ্রুত ও দৃঢ়তার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং তদানুসারে এক‌টি মুহুর্তও নষ্ট না করে পরিকল্পিত কার্যক্রম গ্রহণ করা। কারণ, তখন প্রতিটি মুহুর্ত ছিল অত্যন্ত মূল্যবান। প্রতিটি সংগঠনের মূল শক্তি হলো তার ‘চেইন অব কমান্ড’, অর্থাৎ জ্যেষ্ঠতা অনুসারে দায়িত্ব বর্তানো। সেই পুরোনো কথা, ‘রাজার মৃত্যু হয়েছে, রাজা দীর্ঘজীবী হোক’। সিংহাসন কখনো খালি থাকে না। কার অবর্তমানে শাসনক্ষমতা কার কাছে বর্তাবে, রাজার মৃত্যুর পর কে রাজা হবেন, তা থাকে পূর্বনির্ধারিত।

রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের আকস্মিক ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে তাঁর সাংবিধানিক উত্তরসূরির ক্ষমতা গ্রহণ অর্থাৎ গদিতে বসা এবং প্রশাসন বিশেষ করে সশস্ত্র বাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের পাঁচ-ছয় ঘন্টার মধ্যেও এ ব্যাপারে তাঁদের কোন সক্রিয়তা লক্ষ করা যায়নি। পরে জানা গেছে, নেতৃস্থানীয় দু-একজন নাকি পরস্পরের কাছে করণীয় সম্পর্কে জানতে জানতে চেয়ে টেলিফোন করেছিলেন। প্রায় সবাই নাকি উত্তর দিয়েছেন, ‘যা ভালো মনে করো, করো’। আওয়ামী লীগের কোন নেতাই সেদিন একত্রে বসে পরামর্শ করার উদ্যোগ নেননি, কিংবা তাঁদের আদেশ-নির্দেশ দেওয়ার কাজটি করেননি। ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। চেইন অব কমান্ডবিহীন কিছু বিচ্ছিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়ে ষড়যন্ত্রকারী মোশতাক যা খুশি তা-ই করতে পেরেছেন। মন্ত্রীরাও যে কেবল পুলিশের ভয়ে শপথ গ্রহণ করেছেন, তা-ই নয়, ১৫ আগস্ট থেকে আরম্ভ করে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ, অর্থাৎ যত দিন মোশতাক গদিতে ছিলেন, তত দিন তাঁরাও সরকারে ছিলেন।

এই চেইন অব কমান্ডবিহীন সংগঠনকে বস্তুত কোন সংগঠনই বলা যায় না। রাজনৈতিক কোন সংগঠন তো নয়ই। অর্থাৎ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের মূল্য ছিল প্রায় শূন্য। জাতিকে নেতৃত্ব দিয়ে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও দেশের সংবিধান রক্ষা করা তো দূরের কথা, নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখতেও তারা তখন অক্ষম ছিল। এটা নিশ্চয়ই ভাববার বিষয়। কারণ ১৯৬০ এর দশকে এই আওয়ামী লীগই রাজনৈতিক দল হিসেবে এতটা সুসংগঠিত ছিল যে বলতে গেলে তারা এককভাবেই আন্দোলন করে আইয়ুবের লৌহ শাসনের ভিত নড়বড়ে করে তুলেছিল। শেষ পর্যায়ে এদের সঙ্গে যখন পশ্চিম পাকিস্তানের উঠতি মধ্যবিত্ত শ্রেণীও আন্দোলনে যোগ দিল, তখন আইয়ুব গদি ছাড়তে বাধ্য হলেন। অতঃপর সামরিক শাসক হিসেবে এলেন ইয়াহিয়া খান। তাঁর পক্ষে সাধারণ নির্বাচন দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। নির্বাচনে সুসংগঠিত আওয়ামী লীগ গোটা পাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। এর আগে ১৯৬৬ সালে আইয়ুবের আমলে ‘ছয় দফা’ ঘোষণা ও তার পক্ষে পূর্ব পাকিস্তানে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে জনমত গঠন করাও ছিল দলটির এক বিরাট সাফল্য। আর এর সবই সম্ভব হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব ও সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে। সেদিন আওয়ামী লীগের সুদৃঢ় সংগঠন যেমন পুরো জাতির প্রশংসার বিষয় ছিল, তেমনি সামরিক শাসকগোষ্ঠীরও সমীহের কারণ ছিল। এই সংগঠনটি ‘৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ও যুদ্ধে জয়লাভ পর্যন্ত সুদৃঢ় ছিল। একক নেতৃত্বে ও সফলতার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাই সংগঠনের এই শক্তির প্রমাণ। কিন্তু স্বাধীনতার পরপরই সংগঠন তার দক্ষতা হারাতে আরম্ভ করে এবং ১৯৭৫ সালে এর সাংগঠনিক শক্তি এতটাই হ্রাস পায় যে দল হিসেবে এর ‘রাজনৈতিক মূল্য’ শূন্যের কোঠায় নেমে আসে।’’ (কাছে থেকে দেখা ১৯৭৩-১৯৭৫, মেজর জেনারেল এম খলিলুর রহমান, পৃষ্ঠা- ২২৯-২৩০)

– যারা শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ ৩২ নাম্বারে পড়ে থাকা অবস্থাতেই মোশতাকের মন্ত্রীসভায় শপথ নিলেন, যেই সংসদ সদস্যেরা স্বপদে বহাল রইলেন, যারা শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করলেন, যেসকল বাহিনী প্রধানেরা মোশতাকের প্রতি আনুগত্যের ঘোষণা দিলেন, যারা হত্যার ষড়যন্ত্র প্রক্রিয়ায় ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন, যারা হত্যাকাণ্ডকে জাস্টিফাই করে কলাম লিখলেন, যারা শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন, যারা তার চামড়া দিয়ে ডুগডুগি বাজাতে চেয়েছিলেন, যারা শেখ মুজিবুর রহমানকে মৃত্যকে ফেরাউনের পতন বলে আখ্যায়িত করেছিলেন, আজ মনে হয় এদের সবাইকে বাদ দিয়ে আওয়ামীলীগের যাবতীয় ক্ষোভ শুধুই জিয়াউর রহমানের ওপর। তাঁর ওপর যাবতীয় দোষ চাপিয়েই যেন তারা আত্মতৃপ্তি অনুভব করে! কারণ খুবই পরিষ্কার, কারণটা পুরোপুরিভাবেই রাজনৈতিক।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *