ফয়েজ আহমদের কালজয়ী ‘সত্যবাবু মারা গেছেন’

:: ফয়েজ আহমদ ::

রিপোর্টিংয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত বা অনবধানতাবশত যতটুকু ভুলভ্রান্তি থাকে, তার চাইতে বহুগুণ অধিক সঠিক তথ্য স্থান পায়। অর্থাৎ রিপোর্টের যে অংশটুকু মিথ্যা বলে প্রতীয়মান হবে, তার চাইতে হয়তো বহুগুণ সত্য ওই রিপোর্টে পাওয়া যাবে। অপরদিকে এই ভুল ও মিথ্যার কোনোটার জন্যই বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার দায়ী নন। হয়তো দেখা যাবে, পত্রিকার নীতি বা পত্রিকা মালিকের রাজনীতিই এই অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির জন্য দায়ী। কিন্তু তবুও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল রিপোর্টারকে তার প্রতিটি শব্দের জন্য পাঠকের কাছে জবাবদিহি করার উদ্দেশ্যে প্রস্তুত থাকতে হয় (একটি ভুল বা একটিমাত্র মিথ্যা মূল্যবান একটি রিপোর্টকে ধ্বংস করে দিতে পারে)।

প্রকৃতপক্ষে রিপোর্টিং সাংবাদিকতা পেশার এমন একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, যার উত্পাদিত ফসলের ওপর নির্ভর করেই প্রধানত পত্রিকার অগ্রগতি। বিদেশি বা দেশি সংবাদ যা কিছু প্রকাশিত হয়, তার সবটাই মূলত রিপোর্টিং এবং এমনকি পত্রিকায় যে সম্পাদকীয় কলাম বা উপ-সম্পাদকীয় প্রকাশ পায়, তাও কোনো না কোনো রিপোর্টের তথ্য নির্ভর করে—ফিচার, তথ্যপ্রধান নিবন্ধ বা অনুসন্ধানমূলক রিপোর্টিং, সবই তো রিপোর্ট। সে কারণে এই গুরুত্বপূর্ণ পেশায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিটিও সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অবলম্বন করেন। আর সেই একই কারণে তাঁর ভুল ও মিথ্যাকে পত্রিকার ক্রেতা ও পাঠক বিশেষ গুরুত্ব সহকারে সমালোচনা করে থাকেন। তবে তথ্যের সম্পূর্ণতা ও অবহেলার দরুন রিপোর্টার ভুল করতে পারেন। রিপোর্টের ভুল ও মিথ্যাকে যদি উদ্দেশ্যমূলকভাবে প্রচার ও প্রতিষ্ঠার প্রয়াস থাকে, তবে আমাদের রাষ্ট্রের মতো পশ্চাত্পদ দেশের সাধারণ মানুষ শুধু যে বিভ্রান্তিতেই ভুগবে তা নয়, ক্রমান্বয়ে সংবাদবিমুখ হয়ে পড়বে! তা হবে সমাজের জন্য ক্ষতিকর।

কিন্তু এমনও হতে পারে যে, এই ভুল ও মিথ্যার সঙ্গে রিপোর্ট রচয়িতা রিপোর্টারের কোনো সম্পর্ক নেই। রাষ্ট্রব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় প্রচার, অর্থনৈতিক মন্দা বা ঊর্ধ্বগতি, রাজনীতি, প্রচলিত সংবাদ লেখন পদ্ধতি বা মালিকের উদ্দেশ্যই মূলত এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী বলে গণ্য হতে পারে।

যে কোনো পত্রিকার রিপোর্টার ও রিপোর্টকে সমাজে পাঠক সম্প্রদায় সহজেই শনাক্ত করতে সক্ষম—কারণ জনসভা, বিমানবন্দর, সংবাদ সম্মেলন, সরকারি দফতর, রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে শুরু করে নৈশভোজ ও সন্ধ্যার পার্টি পর্যন্ত সর্বত্র রিপোর্টারের পদচারণা। প্রকৃতপক্ষে তারা পত্রিকা বা সংবাদ সংস্থার প্রতিনিধিরূপে চিহ্নিত। কিন্তু পত্রিকার মালিকের ব্যক্তিগত অভিরুচি, তাঁর রাজনীতি, সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও নির্দেশনামা ইত্যাদির মধ্যে যখন একজন রিপোর্টার বর্ধিত হন, তখন যে তিনি সর্বদা স্বাধীন বিচার-বিবেচনাপ্রসূত বিষয়গত রিপোর্ট করতে পারবেন, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। বিশেষ করে বর্তমানে আমাদের দেশে প্রধানত দু’ধরনের মালিকানায় পত্রিকা প্রকাশিত হয়—সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ব্যক্তিমালিকানায়। সুতরাং রিপোর্টাররাও একই রিপোর্টকে নিজ নিজ মালিকানার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখবেন। আবার ব্যক্তিমালিকানায় কোনো পত্রিকা ধনবাদী বিশ্বের সমর্থক, কোনোটি সাম্যবাদী দুনিয়ার সোভিয়েত ও তার সমর্থকদের প্রচারক, কেউবা চীন ও তার নীতিধর্মী বিশ্বের পৃষ্ঠপোষক। সরকারি পত্রিকাগুলো সরকারের ক্ষণস্থায়ী ও দোদুল্যমান বৈদেশিক, রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক নীতির মারপ্যাঁচে এক এক সময় বিভ্রান্ত হয়ে ওঠে। সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকাগুলোকে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রচার অস্ত্ররূপে ব্যবহার করেন। কোনো কোনো মালিক পত্রিকার শক্তি প্রয়োগ করে নিজের বা অপরের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেন। কেউবা নিজ পত্রিকার অস্ত্র উঁচিয়ে ব্যবসা করেন, কোটিপতি হয়ে বিলেতি হীরের আংটি পরে পার্টিতে যান।

এই পরিস্থিতিতে একজন রিপোর্টারের অবস্থান কোথায়? তিনি তো সরকারি বা মালিকের নীতি ও বক্তব্য উপেক্ষা করতে সক্ষম নন। তাঁকে বিশেষ সমাজব্যবস্থা, ব্যক্তিবিশেষ বা দেশের প্রতি সমর্থনের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রাসঙ্গিক রিপোর্ট রচনা করতে হয়ে থাকে। এই অবস্থায় কোনো রিপোর্টার যদি আধুনিক কবির মতো উদভ্রান্ত হয়ে প্রশ্ন করেন—সত্য কোথায়? তার উত্তর মেলা তো দুষ্কর।

তবে একথা সত্যি যে, রিপোর্টাররা সত্যেরই সন্ধান করতে গিয়ে পথে নামেন। সেই সত্যের সন্ধানেও বিপর্যয় ঘটতে পারে এবং সে বিপর্যয় ত্রুটিপূর্ণ সংবাদ লেখন পদ্ধতি বা সংশ্লিষ্ট সংবাদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে উদাসীনতা বা প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনের উপযুক্ত প্রচেষ্টার অভাব থেকে হতে পারে। ঊনসত্তর সালে যশোর সীমান্তে ভারতের পথে এক সম্ভ্রান্ত মহিলা শুল্ক বিভাগ কর্তৃক আটক হন। চেকপোস্টে অফিসাররা ওই মহিলার কাছে ছয় হাজার পাকিস্তানি টাকার নোট ও কিছু অলঙ্কার পান। এই টাকা ও অলঙ্কার কাস্টমসের কাছে নিয়ম অনুযায়ী ঘোষণা না করে তিনি আইন লঙ্ঘন করেছিলেন বলে দাবি করা হয়। কর্তৃপক্ষ সেই টাকা ও অলঙ্কার আটক করে রাখে।

সেই সম্ভ্রান্ত মহিলা ছিলেন বরিশালের সিনিয়র সাব-জজ মি. সান্যালের স্ত্রী। মেয়ের বিয়ের জন্য সঞ্চিত অর্থ ও অলঙ্কার নিয়ে তিনি কলকাতায় যাচ্ছিলেন। নিশ্চিতভাবে এ কাজ আইনের লঙ্ঘন ছিল।

কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ একটি বিরাট চোরাচালানের কেসরূপে ঘটনা চিহ্নিত করে নিজেদের কৃতিত্ব প্রকাশের উদ্দেশ্যে মহিলার নামের সঙ্গে স্বামী জজ সান্যালের নাম উল্লেখসহ রিপোর্টারদের কাছে খবরটা পৌঁছে দেন। মি. সান্যাল বিচার বিভাগের কাছে সারাজীবন একজন সত্, নিষ্ঠাবান ও প্রথম শ্রেণীর বিচারক হিসেবে পরিচিত ও সম্মানিত। পরের দিন ঢাকার কয়েকটি পত্রিকায় এই চোরাচালানের কাহিনী বের হলো মি. সান্যালের নাম ও সম্মানকে বিশেষভাবে বিপন্ন করে এবং জড়িয়ে। পাঠকের চোখে জজ পত্নীর এই ঘটনার জন্য জজ সাহেবকেই যেন দোষী মনে হতে লাগল—কর্তৃপক্ষ কর্তৃক সরবরাহকৃত তথ্য এমনই উদ্দেশ্যমূলক ছিল। সংশ্লিষ্ট রিপোর্টার আনুপূর্বিক বিবেচনা না করে এবং এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে সে সম্পর্কে সচেতন না থেকেই পত্রিকায় রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন।

সাব-জজ সান্যাল বাবু পত্রিকায় খবর পড়ে পরের দিন কোর্টে এলেন। দৃঢ় চরিত্রের সেই বিচারককে তাঁর সহকর্মীরা স্বাভাবিকভাবে কর্মরত দেখেছিলেন। কোর্ট শেষ হয়ে যাওয়ার অল্প আগে তিনি তরুণ জেলা জজের কক্ষে প্রবেশ করলেন। জেলা জজ সাহেব সান্যাল বাবুকে নিষ্ঠা ও সততার জন্য শ্রদ্ধা করতেন। সান্যাল বাবু স্বাভাবিক কণ্ঠে বললেন : কাগজ দেখেছেন নিশ্চয়ই।

জেলা জজ আসাফদ্দৌলা বললেন : আপনি এ ব্যাপারে জড়িত বা দোষী কী করে? কাগজে আপনার নাম এভাবে জড়ানো সঠিক হয়নি। তাছাড়া আইনের দৃষ্টিতে আপনাকে কোনোভাবেই অভিযুক্ত করা যায় না। গৃহে ফেরার সময় সান্যাল বাবু বলে গেছেন : সব বিচার বিভাগের সততার ওপর কলঙ্ক এসে পড়েছে। যে জন্য মানুষ বাঁচে, তাই আমি হারিয়েছি। কলঙ্কময় এ জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার অর্থ নেই।

তিনি একটু থেমে বললেন : বিশ্বাস করুন, এ ব্যাপারে আমি কিছুই জানতাম না।

পরের দিন ভোরে সমগ্র বরিশাল শহরে একটি শোকের খবর ছড়িয়ে পড়ল—জজ সান্যাল বাবু আত্মহত্যা করেছেন। শোবার ঘরে ঝুলন্ত অবস্থায় লাশের পা দুটো ছিল গোটানো—যাতে মাটিতে পা না লাগে। পাশের টেবিলে একটি চিরকুট ছিল, সেই গতকালকের গর্বিত উক্তি—এ লজ্জার পর কলঙ্কময় জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার অর্থ নেই। মানুষ যা নিয়ে বেঁচে থাকে, তাই আমি হারিয়েছি।

এ জাতীয় দৃষ্টান্ত ছাড়াও সত্য যাচাই না করার দরুন রিপোর্টারদের নানা ধরনের ভুল হতে পারে এবং সে ভুল মিথ্যা বলে পরিগণিত হলে কিছুই করার নেই। চুয়ান্ন সালে প্রদেশের সাধারণ নির্বাচনের সময় আমি দৈনিক ইত্তেফাকে এমন এক বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছিলাম। একজন যুক্তফ্রন্ট সমর্থক অতি উত্সাহী ব্যক্তি এসে জানালেন যে, ঢাকায় কালো পতাকা দেখানোর জন্য কোনো কালো কাপড়ই তন্ন তন্ন করে খুঁজে পেলাম না। মুসলিম লীগ নেতাদের সর্বত্র এমন ব্যাপকভাবে কালো পতাকা দেখানো হচ্ছে যে তাঁরা তো পালাচ্ছেনই, বাজার থেকে কালো কাপড়ও উধাও হয়েছে। অমনি কোনো দিক বিবেচনা না করে নির্বাচনের তোড়ে নিউজ লিখলাম—ঢাকার বাজারে কালো কাপড়ের অভাব ইত্যাদি। বক্স হয়ে এই নির্বাচনী প্রচারণা বের হলো। কিন্তু পরে দেখা গেল, এই সংবাদ সত্যি নয়। সঠিক অনুসন্ধানের অভাবজনিত এই ভুলকে মিথ্যা বলা যেতে পারে।

ভুল নয় মিথ্যাও নয়—সাংবাদিক নীতিমালার দিক থেকে সঠিক কি-না, সেটাই বিবেচ্য। সাতান্ন সালে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান খুলনায় ডকইয়ার্ড উদ্বোধন করতে যান। আমরা কিছুসংখ্যক রিপোর্টার ছিলাম তাঁর সঙ্গে। পিআইডিসি’র চেয়ারম্যান গোলাম ফারুক, যাকে সে সময় কেন্দ্রের উচ্চপদস্থ বাঙালি জয়েন্ট সেক্রেটরি মিজানুর রহমান ‘কিং ফারুক’ বলে ডাকতেন, এই উদ্বোধনের আয়োজন করেন। গোলাম ফারুকের চালচলন ছিল রাজসিক এবং বাঙালিদের সঙ্গে ব্যবহার ছিল প্রজার প্রতি রাজার ব্যবহার। সে কারণেই তাঁকে ব্যঙ্গ করে বলা হতো ‘কিং ফারুক’। উদ্বোধনের পর একটি গেস্ট হাউসে রিপোর্টারদের নিয়ে কর্মকর্তারা উচ্ছল পরিবেশে পানাহার শুরু করলেন। ঢাকায় আমাদের রিপোর্ট যেতে শুরু করেছে ফোনে বা টেলিগ্রামে। উদ্বোধনের সময় থেকেই একটা বিশেষ খবর আমাকে আলোড়িত করে তুলছিল। নিটকবর্তী অপর একটি গেস্ট হাউসে গিয়ে টেলিফোন করলাম ঢাকায় আমার অফিসে—সংবাদ। খবরটা ছিল : ডকইয়ার্ড উদ্বোধনের দিন থেকেই এই প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকগণ বিভিন্ন দাবির ভিত্তিতে ধর্মঘট শুরু করেছে; কিন্তু উদ্বোধনের মূল খবরটা আমি দিইনি এপিপি দিয়েছে বলে।

পরের দিন সকাল বেলায় সংবাদে এই ধর্মঘট সংক্রান্ত খবরটাই প্রাধান্য পেয়েছিল বেশি, উদ্বোধনের খবরের চেয়ে। অন্যান্য কাগজ এ ব্যাপারে মার খেয়ে গেল। মুখ্যমন্ত্রী অসন্তুষ্ট হলেন, আমি কৃতিত্বের জন্য গর্ববোধ করলাম। কিন্তু পরবর্তীকালে দেখেছি, মূল সংবাদ বাদ দিয়ে একই অবস্থান থেকে কেবল পার্শ্ব সংবাদ প্রেরণ সাংবাদিক নীতিমালাসম্মত হয়নি।

আটষট্টি সালে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ (স্টেট বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য) দায়ের হওয়ার পর ট্রাস্টভুক্ত সরকারি কাগজগুলো সরাসরি সাংবাদিক নীতিমালা ভঙ্গ করে বসল। সরকারের অলিখিত নির্দেশে ও সামরিক বাহিনীর জনসংযোগ বিভাগের তদারকিতে এসব পত্রিকা কয়েকটি আলোকচিত্র ছাপিয়ে পাঠকদের চোখে আঙুল দিয়ে বলে দিল—‘এই সেই পেট্রোল পাম্প’ (গ্রীন রোডের মোড়ে), ‘এই সেই বাড়ি’ (গ্রীন স্কোয়ারে) ইত্যাদি। অর্থাত্ এই পেট্রোল পাম্পের মালিকই অভিযুক্ত। অর্থাত্ এই বাড়িতে ষড়যন্ত্র হয়েছিল। সরকারি অভিযোগের সূত্র ধরে, পরবর্তীকালে কোর্টে মিথ্যা প্রমাণিত হতে পারে, এ ধরনের চিত্র প্রকাশ করা যায় না বলে অন্যতম কৌঁসুলি আবদুস সালাম খান ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ এনেছিলেন। কিন্তু প্রধান বিচারপতি এসএ রহমান কর্ণপাত করেননি (গণঅভ্যুত্থানের সময় বাংলা একাডেমীর পাশে অবস্থিত বিচারপতি রহমানের অস্থায়ী সরকারি বাসস্থান বিক্ষুব্ধ জনতা পুড়িয়ে দিয়েছিল এবং তিনি লম্ববান প্রত্যঙ্গ গুটিয়ে বাঙালি বাবুর্চির সহায়তায় লক্ষ্মণ সেন প্রদর্শিত দ্বার পথে পালিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন)।

পরে সরকার পক্ষের প্রধান কৌঁসুলি সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মঞ্জুর কাদেরকে এসব আলোকচিত্র ছাপানো ন্যায়সঙ্গত বা নিরপেক্ষ বিচারের পরিপন্থী হয়েছে কি-না সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, সরকার পক্ষ তো এ ছবি ছাপায়নি, পত্রিকাগুলো নিজেদের উদ্যোগে করেছে। তাঁর এই অস্বীকৃতির (মিথ্যার) পর পত্রিকার ওপরই সব দোষ এসে পড়ে। অথচ, সরকারই চাপ দিয়ে অলিখিত নির্দেশে ছবিগুলো ছাপিয়েছে।

এমন অনেক সংবাদ আছে যা রিপোর্টাররা জনস্বার্থের প্রয়োজনে প্রকাশ করতে আগ্রহী নন; এমনকি অনেক লঘু খবরও। একবার বার্মার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে শাহবাগ হোটেলের ব্যাঙ্কোয়েট হলে সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়। ঢাকাস্থ বার্মার কন্সাল ও প্রাদেশিক গভর্নর স্ব স্ব দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। এক পাশে অবস্থিত নিচু মঞ্চের ওপর সন্ধ্যার কিছু পরে গভর্নর মোনায়েম খান এলেন; তাঁর পাশে দাঁড়ালেন বার্মার কন্সাল। এক কদম পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন এডিসি (সম্ভবত সে সময়) মেজর মশরুর; পরবর্তীকালে ব্রিগেডিয়ার ও আরও পরে রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন।

পরস্পরের শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর কন্সাল ও গভর্নর দু’গ্লাস ‘কোমল পানীয়’ হাতে তুলে দাঁড়ালেন। এবার আনুষ্ঠানিকভাবে ‘টোস্ট’ বা কল্যাণ কামনার পালা। ইংরেজিতে আমাদের গভর্নর মোনায়েম খান বার্মার কল্যাণ ও উন্নতি এবং দু’দেশের মধ্যে গভীর বন্ধুত্ব কামনা করে শেষ করলেন এই বলে—পিপলস্ রিপাবলিক অব চায়না! টুং (গ্লাসে গ্লাসে টোকা, এটাই রেওয়াজ)। শত শত অতিথি স্তম্ভিত। মুখে কারও রা নেই। বেচারা মশরুর ত্বরিত এক কদম এগিয়ে গভর্নরের কানে কানে বললেন : বার্মা। অপ্রতিভ গভর্নর মোনায়েম পুনরায় সেই শব্দটি মন্ত্রমুগ্ধের মতো উচ্চারণ করলেন : বার্মা। তখন এই ক্ষুদ্র ও লঘু ঘটনা সম্পর্কে কেউ রিপোর্ট করেননি। হয়তো তাঁর বয়সের কথা বিবেচনা করে, নয়তো অশোভন হবে মনে করে। নয়তো সদাক্ষুব্ধ গভর্নরের ভয়ে। কিন্তু পৃথিবীর অন্য কোনো উন্নত দেশে বন্ধু রাষ্ট্রের জাতীয় দিবসে এ জাতীয় ভুলকে কোনো সমালোচনা না করেই ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখা হতো না, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

অপরদিকে শত শত দৃষ্টান্ত এমন আছে যা রিপোর্টাররা প্রকাশ করতে উত্কণ্ঠিত; কিন্তু সরকারি মিথ্যা প্রচার ও সংবাদ হননের চাপে রিপোর্টাররা অসহায় হয়ে পড়েন। তাদের চোখের সম্মুখে যে ঘটনা, তারও সঠিক রিপোর্ট করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। দুর্ভিক্ষ, মহামারী ও বন্যায় মৃত্যু, এমনকি ঘূর্ণিঝড়ে মৃত্যুর সংখ্যা পর্যন্ত সরকার সঠিকভাবে প্রকাশ করতে নারাজ। অর্থাত্ প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্যও সরকারের যেন দায়ী হওয়ার আশঙ্কা আছে। সরকার প্রকৃতপক্ষে দুর্গত জনগণকে রিলিফ প্রদানের দায়িত্ব নিতে অনিচ্ছুক।

আমাদের দেশের যে কোনো সরকারই অহরহ মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে থাকে এবং তাদের ভয়ে ও আজ্ঞায় অনেক রূঢ় সত্য প্রকাশ পায় না। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় হরতালের এক দিন (২৪ জানুয়ারি) ছাত্র-জনতার একটি বিক্ষুব্ধ মিছিল সচিবালয়ের আবদুল গনি রোডস্থ প্রথম গেটে জমায়েত হয়। মোনায়েম খানের স্বরাষ্ট্র সচিব সালাউদ্দিন আহমদ সে সময় ‘নিষিদ্ধ’ এলাকায় মন্ত্রীদের প্রধান ভবনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে উত্তেজিত কণ্ঠে গেটরক্ষকদের সতর্কতার নির্দেশ দিতে থাকেন। আকস্মিকভাবে পুলিশ মিছিলের ক্ষুব্ধ জনতার ওপর গুলি চালায়। অতি কাছে থেকে গেট আড়াল করে গুলিবর্ষণের ফলে বহুসংখ্যক আহত হয় ও তিন-চারজন সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ হারায় বলে অনুমান করা হয়। এই গুলিতেই নবকুমার হাই স্কুলের কিশোর মতিয়ুর শহীদ হয়।

সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন রিপোর্টার সচিবালয়ের ওই স্থানে গিয়ে উপস্থিত হন। তাদের সম্মুখেই মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার পর পুলিশ দু’জন গুলিবিদ্ধ বিক্ষোভকারীর দেহ টেনে গেটের ভেতরে নিয়ে আসে এবং প্রধান বিল্ডিংয়ের পাশে ফেলে রাখে। গুলিবিদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এরা মারা যাননি; সম্ভবত আহত অবস্থায় টেনে আনার ফলেই তাদের মৃত্যু ত্বরান্বিত হয়। তখন সেই গুলিতে মৃত্যুর সংক্ষিপ্ত খবর দেশবাসীকে দেয়া গেছে; কিন্তু স্বরাষ্ট্র সচিবের তত্পরতা, উত্তেজিত কণ্ঠ, ঘটনাস্থলে উপস্থিতি বা তার সম্মুখেই গুলিবর্ষণ সম্পর্কে তখন কিছু লেখা সম্ভব হয়নি। মোনায়েম খানের স্বরাষ্ট্র সচিব পরবর্তীকালে স্বাধীন বাংলাদেশের অনুমোদনে জাতিসংঘের একটি এজেন্সিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হন।

সরকারি চাপে এভাবে সত্যকে কবর দেয়ার নজির অনেক—অবশ্য একে মিথ্যার নামান্তর বলা চলে। রিপোর্টার বা পত্রিকা এসব ক্ষেত্রে অসহায় দর্শকের ভূমিকা অবলম্বন করতে বাধ্য হন।

রিপোর্টিংয়ে কোন্ কোন্ ক্ষেত্রের রচনা পদ্ধতি বা প্রকাশভঙ্গির কোন্ অভিব্যক্তি সঠিক, তা দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্নতার দরুন সর্বদা সুনির্দিষ্টভাবে নির্ণয় করা যায় না এবং এ কারণে বিভ্রান্তির মধ্যে পতিত পাঠক সঠিক খবর থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।

আটান্ন সালের গোড়ার দিকে কুমিল্লার বুড়িচং উপনির্বাচনী এলাকায় নবগঠিত ন্যাপের মনোনীত প্রার্থী ছিলেন অধ্যাপক মফিজুল ইসলাম (বহু পরে পার্লামেন্ট সদস্য)। সেই নির্বাচন ছিল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে নবগঠিত ন্যাপের প্রথম নির্বাচনী লড়াই। কেন্দ্রের প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী, প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান থেকে শুরু করে শেখ মুজিব এবং সমগ্র আওয়ামী লীগের সরকারি-বেসরকারি শক্তি ন্যাপ প্রার্থীর বিরুদ্ধে ও আওয়ামী প্রার্থীর পক্ষে প্রচারাভিযান দীর্ঘদিন অব্যাহত রাখেন। স্বাভাবিকভাবেই প্রাদেশিক সরকারের সংশ্লিষ্ট অফিসার ও কর্মচারীরাও এই অভিযানে আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করতে বাধ্য হন। নির্বাচনে সরকারি ক্ষমতা ব্যাপকভাবে ব্যবহার অবশ্য নূরুল আমীনের আমল থেকেই শুরু হয়।

সংবাদ ছিল সে সময় মওলানা ভাসানী ও নয়া পার্টি ন্যাপের সোচ্চার সমর্থক। রিপোর্টার হিসেবে এই নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে রিপোর্ট করার দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। বন্ধু কেজি মোস্তফা, বর্তমানে রাজনৈতিক অর্থে নিরুদ্দেশ—রাষ্ট্রদূত (পঁচাত্তর সালে ইরাকে রাষ্ট্রদূত ছিলেন) সে সময় সংবাদে সহকারী নিউজ এডিটর। নির্বাচনের রাতে তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন নিউজ ডেস্কের। অনেক টেলিফোন-যোগাযোগের পর আমি বুড়িচং নির্বাচনের ব্যাপক একটি রিপোর্ট লিখলাম। ওই নির্বাচনে ন্যাপ প্রার্থী অল্প ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিলেন।

কেজি মোস্তফা আমার রিপোর্ট দেখে উত্ফুল্ল হয়ে বললো : চমত্কার। তবে রাইটআপটা ঘুরিয়ে দিলে ভালো হয়। দু’মিনিটের মধ্যে করে দে।

আমি বললাম : সবই ঠিক আছে। ন্যাপ সমর্থক পত্রিকা হিসেবে এই নির্বাচনে সংবাদ যে ভূমিকা নিয়েছে, সেদিক বিবেচনা করেই লেখা হয়েছে। সংশোধনের প্রয়োজন নেই।

কেজি সে বক্তব্য মানতে রাজি নয়। তার মতে নির্বাচনে যে জয়লাভ করেছে, তার সম্পর্কেই প্রথমে লিখতে হবে—অর্থাত্ বুড়িচং নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী ন্যাপ প্রার্থীকে পরাজিত করে জয়লাভ করেছেন।

আমার রিপোর্ট ছিল, (সংক্ষেপে) কেন্দ্রীয় প্রধানমন্ত্রী, মুখ্যমন্ত্রী, তার মন্ত্রিপরিষদ সরকারি ক্ষমতা ও আওয়ামী লীগের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করার পরও নবগঠিত ন্যাপের প্রার্থী মাত্র সামান্য ভোটের ব্যবধানে আওয়ামী লীগের প্রার্থীর কাছে বুড়িচং উপনির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন।

দেখা গেল, এই বিশেষ সংবাদটির প্রকাশভঙ্গির প্রতি দু’জনের অভিগমনই আলাদা।

কেজি মোস্তফা চাইল যে, তার কথামত আমাকে সংশোধন করে দিতে হবে। কারণ তার বক্তব্যই সঠিক। আমি বললাম : পছন্দ না হলে বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিতে পার (ডেস্ক-প্রধানের এডিটিং করা বা ফেলে দেয়ার অধিকার আছে)। কাগজের নীতি অনুযায়ী এটাই রাইটআপ হবে। প্রয়োজনে সংশোধন করে নাও।
জেদি কেজি বললো : তোকেই করতে হবে।

বন্ধু কেজি-র যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ছিল গভীর, তবু দ্বিমত। আমি এক টুকরো কাগজ কেজি-র হাত থেকে টেনে নিয়ে পদত্যাগ করে রাতের অন্ধকারে রাস্তায় বের হরলাম। এখনও আমি নিশ্চিত নই; আমাদের মধ্যে কার বক্তব্য সঠিক ছিল। সাংবাদিক নীতিমালার বিভ্রান্তিও সত্যের বিভ্রান্তির সমতুল্য।

ফয়েজ আহমদের কালজয়ী স্মৃতিচারণমূলক গ্রন্থ ‘সত্য বাবু মারা গেছেন’ থেকে

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *