:: মুজতবা খন্দকার ::
সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সূত্রবিহীন খবর যাচাই না করে প্রকাশের জন্য সাংবাদিকতার ‘ভুল’ স্বীকার করেছেন ইংরেজী দৈনিক ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম। তার ভাষায় ‘এটা আমার সাংবাদিকতার জীবনে, সম্পাদক হিসেবে ভুল, এটা একটা বিরাট ভুল। সেটা আমি স্বীকার করে নিচ্ছি।’
ইংরেজী দৈনিকটির ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০১৬ সালের ৩ ফেব্রুয়ারী বুধবার রাতে বেসরকারী টেলিভিশন এটিএন নিউজে এক আলোচনা অনুষ্ঠানে প্রশ্নের মুখে মাহফুজ আনামের এই স্বীকারোক্তি আসে। মুন্নী সাহার সঞ্চালনায় এই অনুষ্ঠানে মাহফুজ আনাম গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, দায়িত্বশীলতা নিয়ে কথা বলেছিলেন। সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ডেইলি স্টারের বিতর্কিত ভূমিকার প্রসঙ্গ শুরুতেই সঞ্চালক তুললে তা অস্বীকার করেন মাহফুজ আনাম। অনুষ্ঠানের আলোচক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ‘হেড অব কারেন্ট এ্যাফেয়ার্স ও এডিটোরিয়াল পলিসি কো-অর্ডিনেটর’ গাজী নাসিরউদ্দিন আহমেদও তখন ডেইলি স্টার নিয়ে নানা অভিযোগের বিষয়টি তোলেন।
২০০৭ সালে জরুরী অবস্থা জারির পর সেনা হস্তক্ষেপে গঠিত ফখরুদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে ডেইলি স্টারের ‘সমর্থন’ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা রয়েছে। তার আগে সিপিডির উদ্যোগে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের সহযোগিতায় দেশজুড়ে নাগরিক সংলাপে ‘বিরাজনীতিকরণের’ প্রচার চালিয়ে অসাংবিধানিক সরকারের প্রেক্ষাপট তৈরি করা হয়েছিল বলে সমালোচকদের যুক্তি।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে দেশী বিদেশী নাম দিয়ে যেসব পলিসি বিষয়ক নিবন্ধ, প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়ে আসছে সেগুলো মুলত: ভুয়া। যেসব নামে এসব আর্টিকেল ছাপা হচ্ছে সেসব নামের কোনো অস্তিত্ব নাই।
এএফপির অনুসন্ধানী সাংবাদিক কদরুদ্দীন শিশির এক প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব প্রবন্ধ, নিবন্ধ বেশীরভাগ সরকারের পক্ষে লেখা হয়েছে। বিশেষ করে একটি সুষ্টু নির্বাচনের জন্য মার্কিন সরকারসহ পশ্চিমা বিশ্ব যখন সরকারকে ক্রমাগত চাপ দিচ্ছে, তখন এসব নিবন্ধ প্রকাশ করে, সরকারকে এক ধরনের রিলিফ দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। নিবন্ধের বেশীর ভাগ শেখ হাসিনার উন্নয়ন, চীন, রাশিয়া, ভারত অক্ষ শক্তি যে বাংলাদেশের কত বড় শুভান্যুধায়ী এবং মার্কিন এবং তার মিত্ররা যে খুব খারাপ, সেটাই এসব ফেক অর্টিকেলে লেখা হয়েছে।
আমাদের নিশ্চই মনে আছে,বছরের প্রথম দিকে একটি খবর বেরিয়েছিলো সরকারের উন্নয়ন প্রচারে পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় কলাম লেখক ভাড়া নিতে প্রস্তুত আছে… এই নাম গোত্রহীন ফেক লেখক পররাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের সেই প্রজেক্টের অংশ কি না এএফপির রিপোর্টে সেটা উল্লেখ করা হয়নি।
নিউইয়র্কভিত্তিক একটি মিডিয়া হাউস প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, তারা দেশে দেশে কলাম, প্রবন্ধ, নিবন্ধ সরবরাহ করে। বিশ্বের খ্যাতিমান সাংবাদিক,রাজনীতিক প্রজেক্ট সিন্ডিকেটের হয়ে লেখেন। যেমন ভারতের কংগ্রেস নেতা শশী থারুর তাদের একজন। তাদের কলাম যথেষ্ট সমৃদ্ধ। বাংলাদেশের প্রথম আলোতে প্রজেক্ট সিন্ডিকেটের সেসব লেখা প্রকাশ হতে দেখি।
কিন্তু আমার ভাবতে অবাক লাগে, আওয়ামী লীগের মত এত বড় একটি পুরোনো রাজনৈতিক দল। যাদের আছে এন্তার বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, কলামিষ্ট। শেখ হাসিনা ডাক দিলে গণভবনে ঝাপিয়ে পড়ে কাতারে কাতার। সেই দলটাকে কি না, নিজেদের সাফাই গাইতে চৌর্যবৃত্তির আশ্রয় নিতে হয়। ফেক নামে আর্টিকেল লেখাতে হয়।
সরকারের এত এত বুদ্ধিজীবী সাংবাদিক, এত এত গবেষনা প্রতিষ্ঠান। তারপরেও সরকারের পক্ষে লেখার মত কাউকে খুজে পেলোনা পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয়। শেষে কি না ফেক নাম দিয়ে তাদের পক্ষে লিখতে হলো। প্রতি সপ্তাহে আওয়ামী মোজাম্মেল বাবুর একাত্তর চ্যানেল এত এত বুদ্ধিজীবী সাংবাদিকদের নিয়ে গোলটেবিল বৈঠক করে সেই মানুষগুলো কোথায়? নূন্যতম দেশের প্রথম এবং একমাত্র এমিরেটাস এডিটর নাঈমুল ইসলাম খানইবা কোথায়?
সরকরের এ হেন দৈন্যতা! আমাকে লজ্জা দিচ্ছে।
এবার আসি দেশের প্রধান প্রধান গণমাধ্যমেরর জবাবদিহিতা এবং দৈন্যতার কথায়। গত কয়েক মাসে ভারতের বিভিন্ন পত্র পত্রিকাসহ জাপান আমেরিকার পত্রিকায় সরকারের পক্ষে যেসব প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে.. আমাদের দেশের প্রথম শ্রেনীর দৈনিকগুলো সেগুলো প্রকাশ করেছে.. পত্রিকা গুলো যা পেলো তাই ছাপালো? এর সত্যাসত্য অনুসন্ধান ছাড়াই? নাম না চিনলে গুগলে কিম্বা লিংকডইনে সার্চ দিলেই তো সব জানা যায়!
মাহফুজ আনাম স্বীকার করেছিলেন ডিজিএফআইর চাপে তখন তিনি সেসব চোথা ছাপতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু এখন কেন বাংলাদেশের প্রথম শ্রেনীর পত্রিকাগুলো এরকম অস্তিস্তহীন প্রবন্ধ ছাপছে? এখনো কি পত্রিকার সস্পাদকরা প্রেশারে আছেন?
অবশ্য সাংবাদিকতা হচ্ছে সেই পেশা যাকে তুলনা করা হয় একটি কুমির ভর্তি পুকুরে সাতার কেটে পাড়ে ওঠার সাথে। যে বা যিনি সেটা পারেন,তিনি সত্যিকার সাংবাদিক কিম্বা সম্পাদক। যেমন পেরেছিলেন,তখনও এখনো। তিনি নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবীর। তিনি এএফপিকে বলেছেন, এরকম প্রবন্ধ তার কাছেও এসেছে.. কিন্তু লেখকের পরিচয় নিয়ে তার সন্ধেহ হলে তিনি সেসব প্রবন্ধ ছাপেননি।
অথচ নুরুল কবীর একদা মাহফুজ আনামেরই শিষ্যছিলেন। আসলে, যিনি প্রফেশনালি বায়াসড, তাঁকে নিরপেক্ষ হতে বলাটা বোকামী।
এবার আসি অন্য প্রসঙ্গে। বিএনপি এখন চরম সংকটময় সময় অতিবাহিত করছে। সামনে নির্বাচন। সেই নির্বাচনে দলীয় সরকারের অধীনে না যাবার সিদ্ধান্তে অনড় দলটি। কিন্তু এখনো দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছেনা। শেখ হাসিনা অনড়। বিএনপির এই নৈতিক, যৌক্তিক আন্দোলনের সাথে জনগন ছাড়া আর খুব একটা কেউ পাশে নেই। দেশের সব মিডিয়ায় হাসিনা অনুগত ব্যবসায়ীদের হাতে। সেই সব ব্যবসায়ী কিছুদিন আগে, এক সম্মেলনে হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে শপথ নিয়েছে। মালিকরা হাসিনার পক্ষে গেলে, সেই মিডিয়া কর্মীদের মালিকের বিপক্ষে দাড়ানোটা কঠিন।
তবে সবচেয়ে আশার কথা দেশের মেইনস্ট্রিম গণমাধ্যমের প্রতি জনমনে আগের মত বিশ্বাস, শ্রদ্ধা কিম্বা আস্থা নেই বললেই চলে। গণমাধ্যমের এই জায়গা এখন দখল করেছে সোশাল মিডিয়া। কিন্তু বিএনপি বছর খানেক আগে একটি মিডিয়া সেল খুলেছে। শুরুতেই তার প্রধানকে নিয়ে প্রশ্ন ছিলো। দলের প্রতি তার কমিটমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন আছে। আরো প্রশ্ন আছে ,তিনি মিডিয়াটা ঠিকমত বোঝেন কি না তা নিয়ে।
সোশাল মিডিয়ায় বিএনপির আজ যে শক্ত অবস্থান সেটা ইনডিভিজুয়ালদের কারনে নিজেদের ব্যক্তিগত ভালোবাসা আর কমিটমেন্টের জায়গা থেকে। সরকারের নানা কালাকানুন, ভয়ভীতি, গুম, খুনকে পরোয়া না করে তারা লিখছে, সত্যটা তুলে ধরছে।
তারেক রহমানের একটা ভালো এবং কার্যকর উদ্যোগ ছিলো মিডিয়া সেল। কিন্তু ভুল লোককে দায়িত্ব দেয়ায় সে উদ্যোগটা ঠিক মত কাজে দিচ্ছেনা দলকে। আমি জানি মিডিয়া সেলকে নিয়ে লেখায় আমার প্রতি অনেকেই নাখোশ। তাতে অবশ্য আমার কিছু যায় আসেনা। সত্য কথা বলতে আমি কখনো দ্বিধা করিনি; কখনো করবো না।
লেখক: বার্তা সম্পাদক, এনটিভি