সিপাহী-জনতার বিপ্লব-সংহতির মূলধারা

:: মারুফ কামাল খান ::

স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিনটি ছিলো ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর। সিপাহী-জনতার বিপ্লব ও সংহতি দিবস হিসেবে এই তারিখটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসে উজ্জ্বল ও ভাস্মর হয়ে আছে।

কিন্তু কেন? এই প্রশ্নের জবাব নতুন প্রজন্মের জানা দরকার। কারণ, গত কয়েক বছর ধরেই ৭ নভেম্বরের ঐতিহাসিক ঘটনাবলীকে বিকৃত করে এবং সত্যের সঙ্গে মিথ্যা মিশিয়ে তুলে ধরছে একটি রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মহল। সেই মিথ্যা, বিকৃতি ও বিভ্রান্তির পর্দা সরিয়ে ৭ নভেম্বরের প্রকৃত উজ্জ্বল ইতিহাস তুলে না ধরলে দেশপ্রেমের শাণিত চেতনায় নতুন প্রজন্মের তরুণরা উদ্বুদ্ধ ও উজ্জীবিত হতে পারবে না। বিভ্রান্তির মেঘ এসে ঢেকে দেবে সত্যের প্রখর সূর্যকে।

১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সুবহে সাদেকের সময় রাজপথে সূচিত সৈনিক-জনতার সংহতির মধ্য দিয়ে যে বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছিল তাতে পরাস্ত হয়েছিলো একদল কুচক্রী। সেদিন শুধু নয়, ওই ঘটনার পর অনেক দিন পর্যন্ত তাদেরকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানাবার সাহস এ দেশের কোনো রাজনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর ছিলো না। সময়ের বিবর্তনে অনেক পরে এসে বিশেষ গোষ্ঠীটি ৭ নভেম্বরের ইতিহাস বিকৃতভাবে প্রচার শুরু করে। আরো পরে শুরু হয় সিপাহী জনতার বিপ্লব ও সংহতির বিরুদ্ধে বিষোদ্গার। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ৭ নভেম্বরের বৈরী গোষ্ঠীটি দুঃসাহসী ও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সরকারের সমর্থক এই চক্রটি সিপাহী জনতার বিপ্লব ও সংহতি দিবসকে ‘সৈনিক হত্যা দিবস’ নামে অভিহিত করতে থাকে। অবশ্য ক্ষমতাসীন হওয়ার প্রথম বছরে এই সরকার ৭ নভেম্বর জাতীয় ছুটি বাতিল করার সাহস পায়নি। পরে তারা কেবল ওই ছুটিই বাতিল করেনি, সিপাহী জনতার বিপ্লব ও সংহতি দিবস উদযাপনে বাঁধা দেয়ার পাশাপাশি তারা এখন সিপাহী জনতার বিপ্লব ও সংহতি দিবসের প্রতিপক্ষে প্রকাশ্যেই অবস্থান নিয়েছে। একই সঙ্গে বর্তমান সরকার তাদের দালাল আরেকটি গোষ্ঠীর মাধ্যমে ৭ নভেম্বরের ইতিহাস ও ঘটনাবলীকে বিকৃত করেও প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। জাসদের এককালীন সশস্ত্র শাখা গণবাহিণীর নেতা অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল আবু তাহেরকে ৭ নভেম্বরের হিরো এবং শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিত্রিত করাই ওই প্রচারণার আসল উদ্দেশ্য। এ ধরণের বিভ্রান্তি, মিথ্যা প্রচার ও ইতিহাস বিকৃতি যখন চলছে এবং সিপাহী জনতার বিপ্লবে পরাজিত শক্তির সমর্থকরা আজ যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসে ৭ নভেম্বরের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করতে চাইছে, সেই মুহূর্তে এই দিনটিকে বিশেষভাবে স্মরণ করা এবং বিপ্লব-সংহতির শিক্ষা ও চেতনাকে আরো দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরা খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে।

৭ নভেম্বর তাহেরের অনুসারী কতিপয় বিপথগামী সৈনিক ‘সিপাহী-জনতা ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই’ স্লোগান দিয়ে পিলখানার সামরিক অফিসারদের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের মতোই অফিসার হত্যায় মেতেছিলো। বিপ্লবের যে মূলধারা অর্থাৎ সাধারণ সৈনিকেরা কেউই এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। জিয়াউর রহমান মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই আত্মঘাতী তৎপরতা সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করেন। তার বীরোচিত ভূমিকায় সশস্ত্র বাহিনীতে রক্তক্ষয়ী তৎপরতা দ্রুত থেমে যায়। কাজেই ৭ নভেম্বরকে সৈনিক হত্যা দিবস বলাটা সত্যের বিকৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। সাধারণ সৈনিক নয়, ৭ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনীর কিছু অফিসার নিহত হয়েছিলেন অর্ন্তঘাতকদের হাতে। এর জন্য দায়ী কর্ণেল তাহের ও তার অনুগতরা। সে কারণেই তাদের বিচার ও সাজা হয়েছে। তাই ৭ নভেম্বরকে অফিসার হত্যা দিবস বললেও তার একটা যুক্তি খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। আর এই অফিসারদের হত্যাকে সমর্থন না করলে কর্ণেল তাহের গংয়ের বিচার ও বিচারের প্রদত্ত সাজার প্রতি সমর্থন জানাতে হয়। কিন্তু ৭ নভেম্বরের বিপ্লব-বিদ্বেষী মহল যুক্তির ধারেকাছে না গিয়ে প্রচারণার ধূম্রজাল সৃষ্টি করে বলে চলছে, তাহেরও ভালো,খালেদও ভালো এবং ৭ নভেম্বরের হত্যা মন্দ কিন্তু হত্যাকান্ড থামালেন যে জিয়া, তিনিও মন্দ। সত্যিই বড় বিচিত্র এই দেশ! এ দেশেই এক মুখে এতো কথা বলা সম্ভব।

সংক্ষিপ্ত পটভূমি

৭ নভেম্বরের বিপ্লব ও সংহতির স্বরূপ ও অনিবার্যতা বুঝতে হলে এর সংক্ষিপ্ত পটভূমি জানা দরকার। এ জন্য আমাদের ফিরে তাকাতে হবে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রাম এবং চূড়ান্ত পরিণতিতে সংঘটিত সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের দিকে। আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম ছিলো এক সুদীর্ঘ ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, সেই প্রক্রিয়া ধাপে ধাপে সামনে এগিয়েছে।ইতিহাসের নানা বাঁকে সেই প্রক্রিয়া থেকে অনেকে ছিটকে পড়েছেন, কেউ কেউ করেছেন বিশ্বাসভঙ্গ। একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ও অবসানের সময়েও এর সঙ্গে জনগণের নির্বাচিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের একটি বড় অংশ বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো। ফলে সূচনায় মুক্তিযুদ্ধ নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছিলো। আবার শেষ মুহূর্তে এসেও নেতৃত্বের পর্যায়ে কোন্দলের কারণে একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল। তাই আমাদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে থমকে দিয়ে ভারতের সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়া হয় বিজয়ের গৌরব। রাজনৈতিক নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ‘ভারতের দয়ার দান’ হিসেবে পরিগণিত হতে থাকে। অথচ এই মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের অগণিত মানুষ জীবন দিয়েছে, যুদ্ধে পঙ্গু হয়েছে, কোটি কোটি মানুষ সহ্য করেছে অবর্ণনীয় নির্যাতন, অসংখ্য নারী হারিয়েছে সম্ভ্রম। তাদের সীমাহীন ত্যাগ ও বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধে ভারত সরাসরি জড়িয়ে পড়ে। ভারতের সঙ্গে গোপন এক অধীনতামূলক মিত্রতা চুক্তিতে সই করে সেদিনের প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার তথাকথিত যৌথকমান্ডের নামে মুক্তিবাহিনীকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডের আওতায় ন্যস্ত করে। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ভারতীয় বাহিনীর কাছে দখলদার পাকিস্তানী বাহিনীর আত্মসমর্পনের পর বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ ভারতের কর্তৃত্বে চলে যায়। তারপর প্রবাসী সরকারকে ঢাকায় এনে ক্ষমতায় বসানো হলেও তাদের কার্যকলাপ তদারকির জন্য মাথার ওপর বসিয়ে দেয়া হয় ভারতীয় উপদেষ্টাদের। মোট কথা, নয় মাস যুদ্ধ করে ১৯৭১ সালের শেষ প্রান্তে বিশ্বের মানচিত্রের বাংলাদেশ নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলেও এই রাষ্ট্রটির সত্যিকার অর্থেই কোনো সার্বভৌমত্ব ছিলো না। ভারতীয় বিশেষজ্ঞরা প্রকাশ্যেই ঢাকার মাটিতে দাঁড়িয়ে বলতেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি, প্রতিরক্ষা, সংস্কৃতি, জাতীয় স্বার্থ তথা সবকিছুই হবে ভারতীয় স্বার্থের পরিপূরক। কিন্তু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এ দেশের মানুষ লড়েছিলো একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র কায়েমের জন্য, ভারতীয় স্বার্থের পরিপূরক কোনো দেশ গড়ার জন্য নয়

মুজিবের প্রত্যাবর্তন : বিশ্বাসভঙ্গ

বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়ে রুশ-ভারত অক্ষবলয়ে প্রবেশ করেছিলো। তবে মার্কিনীরা বিশ্বাস করতো, শেখ মুজিব আমেরিকার স্বার্থ পরিপন্থী কিছু করবেন না। পাকিস্তানীরাও পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে আশা করতে থাকে যে, যা-হবার হয়ে গেছে, এখন দুটি স্বাধীন রাষ্টের মধ্যে কনফেডারেশন ধরনের একটা বন্ধন গড়ে তোলার ব্যাপারে শেখ সাহেবেই পালন করতে পারবেন উপযুক্ত ভূমিকা। এসব প্রস্তাবে রাজি হয়েই মুজিব স্বদেশে ফেরেন। কিন্তু দেশে ফেরার পর থেকেই মুজিব তার স্বভাবসুলভ কায়দায় স্বাধীনতার দীর্ঘ সংগ্রাম ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে সাফল্যের সব কৃতিত্ব একাই আত্মস্থ করার চেষ্টা করেন। তবে রুশ-ভারত বলয় থেকে বেরিয়ে আসার লক্ষ্যে তিনি চাতুর্যের সঙ্গে কিছু পদক্ষেপ নিতে থাকেন। রুশ-ভারতঘেঁষা বলে পরিচিত তাজউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে তিনি সরকারপদ্ধতি বদল করে নিজেই প্রধানমন্ত্রী হন। কিছুদিনের মধ্যেই তাজউদ্দিনকে তিনি মন্ত্রিসভা থেকেও ড্রপ করে দিয়ে খন্দকার মোশতাক আহমাদ ও অন্যান্য মার্কিনপন্থীদের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েন। বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের জন্যও তিনি ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করেন এবং সফল হন। কারন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন এবং জাতিসংঘ তখন বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাউপস্থিতির বিরোধিতা করছিল।মুজিব পাকিস্তান সফরে যান ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে এবং পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোকেও তিনি ঢাকায় স্বাগত জানান। চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে তিনি গোপনে লবি শুরু করেন। পাকহানাদার বাহিনীর সদস্যদের বিচারের দাবিও তিনি ত্যাগ করেন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধীদের জন্য ঘোষণা করেন সাধারণ ক্ষমা। এগুলো সবই ছিলো পাকিস্তান ও মার্কিন প্রশাসনকে দেয়া তার অঙ্গীকার বাস্তবায়নের পদক্ষেপ। কিন্তু বেশি দূর এগুনো সম্ভব ছিলো না তার পক্ষে। কেননা সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ তখন রুশ-ভারত প্রভাব বলয়ে আষ্ট্রেপৃষ্ঠে বাঁধা। ক্ষমতাসীন দল ও প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ এবং অবস্থানগুলো তখন ভারতপন্থীদের কব্জায়। ফলে শেখ মুজিবকেই তাদের কাছে আত্মসমর্পিত হতে হলো। ওয়াদা ভাঙলেন শেখ মুজিব। ভোল পাল্টালেন। নিজের আজন্মলালিত বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সাজলেন সমাজতন্ত্রী। ভারতীয়রা কখনোই তাকে পুরোপুরি বিশ্বাস করত না। ভারতে না গিয়ে ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ কালোরাতে পাকিস্তানী আর্মির হাতে গ্রেফতারবরণসহ তার কিছু কর্মকান্ডে তারা ইতোমধ্যেই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছিলো। এবার তিনি বিশ্বাস হারালেন মার্কিন প্রশাসনের। জনতার আস্থা তিনি আগেই হারিয়েছিলেন। শাসকদলের অযোগ্যতা, অদক্ষতা, লুণ্ঠন, শোষণ, নির্যাতন ও সন্ত্রাসের কারণে মুজিবের পায়ের তলার মাটি আলগা হয়ে গিয়েছিল। মার্কিন সমর্থন হারিয়ে মুজিব আরও বেশি করে ঝুঁকে পড়লেন তদানীন্তন সোভিয়েত বলয়ের দিকে। ইতিহাসের পাতা এরপর দ্রুত উল্টে যেতে থাকে। সমাজতন্ত্র কায়েমের নামে গণতন্ত্র এবং মৌলিক মানবিক অধিকারকে হরণ করে মুজিব একদলীয় বাকশালী স্বৈরশাসন কায়েম করেন। হরণ করেন বাক-ব্যক্তি, সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা। চারটি দৈনিক সংবাদপত্র সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে চালু রেখে বাকি সকল দৈনিক ও অসংখ্য সাপ্তাহিক এবং সাময়িক পত্রিকার প্রকাশনা নিষিদ্ধ করেন। প্রতিরক্ষা বাহিনীসহ সকল রাষ্ট্রীয় সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের শীর্ষস্থাথানীয় কর্মকর্তা ও পেশাজীবীদের একমাত্র রাজনৈতিক দল বাকশালে যোগদান বাধ্যতামূলক করা হয়। সংসদ ও সরকারের মেয়াদ নির্বাচন ছাড়াই তিন বছরের জন্য বাড়িয়ে নেয়া হয়। গণতান্ত্রিক পন্থায় রাষ্ট্রক্ষমতায় রদবদলের সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্রের ধাঁচে একটি স্বেচ্ছাচারী প্রশাসন ও শাসন ব্যবস্থা চালু করা হয়।

মার্কিনী প্রতিশোধ : অস্থিতির জন্ম

ইতোপূর্বে সশস্ত্র বাহিনীর সমান্তরাল বাহিনী হিসেবে প্রভূত ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে গঠন করা হয়েছিল জাতীয় রক্ষীবাহিনী। এ কারণে প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা নিজেদের উপেক্ষিত ভাবতে শুরু করেছিলেন। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এবং অভ্যন্তরীণ কিছু বিক্ষিপ্ত ঘটনায়ও সেনাবাহিনীর অনেক সদস্য সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন। তারা যখন দেখলেন যে, সরকার পরিবর্তনের শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ীভাবে পাকাপোক্ত করার সব আয়োজন শেখ সাহেব সম্পন্ন করেছেন, তখন তারা ক্রুব্ধ হয়ে ওঠেন। সেনাবাহিনীর এই উত্তেজিত অংশটিকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের মার্কিনপন্থী অংশটি এক রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। মুজিব এবং তার দু’জন নিকটআত্মীয় পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ অভ্যুত্থানে নিহত হন। মুজিবের দীর্ঘকালের ঘনিষ্ট বন্ধু ও রাজনৈতিক সহচর খন্দকার মোশতাক আহমাদ রাষ্ট্রপতি পদে বসেন। আচমকা ও অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটে যাওয়া এই পটপরিবর্তনকে দেশের সাধারণ মানুষ মেনে নিয়েছিলেন। কেননা আওয়ামী বাকশালী স্বৈরশাসনে তারা ছিলেন অতিষ্ঠ। কিন্তু এই অভ্যুত্থান শাসনব্যবস্থায় স্থিতি আনার বদলে আরো বেশী সংঘাত ও অস্থিরতার জন্ম দিয়েছিলো। সদ্য ক্ষমতাচ্যুত বাকশালের রুশ-ভারতপন্থী অংশটি এই পরাজয়কে মেনে নিতে পারেনি। তারা পাল্টা আঘাত হানার প্রস্তুতি নিতে থাকে। মুজিব বাকশাল করে সব দল নিষিদ্ধ করেছিলেন। আর সিভিল পলিটিশিয়ান মোশতাকের নেতৃত্বাধীন আধাসামরিক সরকার বাকশালও বাতিল করে। ফলে দেশ থেকে রাজনৈতিক দলতো বটেই, রাজনীতিও বিলুপ্ত হয়ে যায়। এই রাজনীতিহীন সময়ে স্বার্থান্বেষী বিভিন্ন মহল সশস্ত্রবাহিনীকে তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের মাধ্যম হিসেবে বেছে নেয়। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতীক প্রতিরক্ষা বাহিনীর শৃঙ্খলা এবং চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে পড়ে। এ ধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযোগে সেনাবাহিনীর উচ্চাভিলাষী ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ তার অনুগত কতিপয় অফিসারের সমর্থনে খন্দকার মোশতাককে হটিয়ে ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে বিদ্রোহ করেন। ৩ নভেম্বর সংঘঠিত ওই বিদ্রোহের হোতারা সেনাবাহিনীপ্রধান জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করেন। চেইন অব কমান্ড ভেঙ্গে সম্পূর্ণ বেআইনীভাবে অধস্তন কর্মকর্তা খালেদ সেনাপ্রধান পদ থেকে জিয়াকে অপসারিত করেন এবং নিজেকে নয়া সেনাপ্রধান ঘোষনা করেন।

খালেদের উদ্দেশ্য ফাঁস

উচ্চাভিলাষী খালেদ বিভিন্ন মতাবলম্বী পক্ষকে তাদের মনমতো কথাবার্তা বলে তার দলে ভেড়াবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু অচিরেই তার কার্যকলাপে অনেকেই বুঝতে পারে যে, ক্ষমতা দখলই তার আসল উদ্দেশ্য।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের পেছনে খালেদের সক্রিয় সমর্থন থাকা সত্ত্বেও ৩ নভেম্বর তিনি মুজিব ভক্তদের বুঝিয়েছিলেন যে, মোশতাকের সরকার অবৈধ। এই সরকারকে আঘাত করে মুজিব হত্যার বদলা নিতে চান তিনি। তার কথায় মুজিবভক্তরা বলেছিলেন, মোশতাককে অপসারণের পর মুজিবের ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুলকে ক্ষমতায় বসাতে হবে। কিন্তু মোশতাককে অপসারণের সঙ্গে যুগপৎভাবে ঘটে যায় রহস্যঘেরা জেলহত্যাকান্ড। একদল সৈন্য জেলে ঢুকে নজরুলসহ বিলুপ্ত বাকশালের চার শীর্ষনেতাকে খুন করে। এই হত্যাকান্ডের ব্যাপারে খালেদ অজ্ঞতা প্রকাশ করলেও অনেকেই তাকে সন্দেহ করতে থাকে।

ব্রিগেডিয়ার খালেদ ১৫ আগস্টের অভ্যুত্থানের সঙ্গে জড়িত সামরিক অফিসারদের সঙ্গে এই মর্মে সমঝোতায় পৌঁছান যে, তাদের নিরাপদে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হবে এবং পরে বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনে চাকরির বন্দোবস্ত করা হবে। এদের মধ্যে কর্নেল ফারুক তার আত্মীয় ছিলেন। সেই সমঝোতা অনুযায়ী ওই অফিসারদের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা হিসেবে খালেদের স্ত্রীকে তাদের সঙ্গে বিমানে তুলে দেয়া হয়। বেগম খালেদ তাদেরকে নিরাপদে ব্যাংককে পৌঁছে দিয়ে আসেন।

কিন্তু এতসব কৌশল ও চাতুরির আশ্রয় নিয়েও খালেদ সবখানে তার নিজের কর্তৃত্বকে সংহত করতে পারেনি। তিন দিন ধরে রেডিও-টেলিভিশন স্টেশন চালু করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। সামরিক শাসন বলবৎ করা সত্ত্বেও ক্ষমতার শীর্ষপদে তিনি এক মুহূর্তের জন্যও বসতে পারেননি। বঙ্গভবন দখল করতে গিয়ে ক্যান্টনমেন্টেই তার কর্তৃত্ব আলগা হয়ে যায়। সাধারণ সৈনিক ও অফিসাররা খালেদের রহস্যজনক কার্যকলাপের ব্যাপারে প্রকাশ্যেই ক্ষোভ, সংশয় ও সন্দেহ প্রকাশ করতে থাকেন। এ ধরনের পরিস্থিতিতে সশস্ত্র বাহিনীতে রক্তক্ষয় ও সংঘাত এড়াতে জেনারেল ওসমানীর হস্তক্ষেপে একটি মাঝামাঝি পদক্ষেপ নেন খালেদ। প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে বসানো হয়। সীমাহীন চাপের মধ্যে তড়িঘড়ি করে করে এই সিন্ধান্ত নেয়া ছিলো সেনাপ্রধান পদে খালেদের বসার মতই অবৈধ। মোশতাক সরকারকে অবৈধ আখ্যা দিয়ে খালেদ নিজেও একই ধরনের অবৈধ কাজ করেন। তাকে সিএমএলএ হিসেবে মেনে নিতে সেনা কমান্ডারদের আপত্তি বুঝতে পেরে তিনি একজন সিভিলিয়ান বিচারপতিকে সিএমএলএ বানান। কিন্তু এতেও শেষ রক্ষা হয়নি তার। রুশ-ভারতপন্থীরা পুনরুত্থানের পথ খুঁজছিল। খালেদের বিদ্রোহে উল্লসিত হয়ে ওঠে তারা। মুজিব ভক্তরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সমবেত হয়ে সভা করে। সেখান থেকে মুজিবের ফটো নিয়ে মিছিল করে তারা ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে নিহত নেতার বাসভবনে গিয়ে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। ওই সমাবেশ থেকে খালেদের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করা হয়। মিছিলে খালেদের মা এবং ভাই (আওয়ামীলীগ সরকারের সাবেক ভূমি প্রতিমন্ত্রী মরহুম রাশেদ মোশাররফ) শরিক হন। এই খবর প্রচারিত হলে সেনাবাহিনীসহ সবখানে ক্ষোভের সঞ্চার হয়। সৈনিক ও অফিসাররা বিভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করে পারস্পরিক যোগাযোগ স্থাপন ও মতবিনিময় করে খালেদের ক্ষমতার স্বপ্নকে গুঁডিয়ে দেয়ার সিন্ধান্ত নেন।

বিপ্লব ও সংহতি

৭ নভেম্বর প্রথম প্রহর থেকে সারা দেশের সেনা ছাউনিগুলোর চেহারা বদলে যায়। সৈনিকেরা অস্ত্রহাতে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে বেরিয়ে আসেন রাজপথে। প্রত্যেক ক্যান্টনমেন্ট থেকে একদল করে সশস্ত্র সৈন্যকে পাঠিয়ে দেয়া হয় রাজধানীর দিকে। রাত্রির শেষপর্বে তারা ঢাকায় এসে পৌঁছে। মধ্যরাত্রির পর ঢাকা সেনানিবাসেও শুরু হয়ে যায় সৈনিকদের অভ্যুত্থান। ব্যারাক থেকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে তারা বেরিয়ে আসেন। বন্দী সেনাপ্রধান জিয়াকে মুক্ত করে কাঁধে তুলে সাধারণ সৈনিকরা বেরিয়ে আসেন রাজপথে। অবস্থা বেগতিক দেখে বঙ্গভবন থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পালাতে গিয়ে ঢাকার রাজপথে সৈনিকদের হাতে ধরা পড়েন খালেদ তার কয়েকজন দোসরসহ। ক্রুব্ধ সৈনিকেরা তাদেরকে গুলি করে হত্যা করেন। এর অল্প কিছু আগে খালেদের সমর্থক কর্নেল মালেক, শাফায়াত জামিল, জাফর ইমাম, মেজর হাফিজ প্রমুখ কয়েকজন অফিসার পরিস্থিতি অনুধাবন করে তাকে ছেড়ে নিরাপদে পালিয়ে গিয়েছিলেন।

“বাংলাদেশ জিন্দাবাদ, কুচক্রিরা নিপাত যাক, জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ” ধ্বনি দিয়ে সৈনিকেরা ৭ নভেম্বর সুবহে সাদেকের সময়ে রাজপথে নেমে এলে তাদের প্রতি স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানাতে সারা দেশের জনগণ রাজপথে নেমে আসেন। শ্রেণীপেশা নির্বিশেষে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা দেশরক্ষার সৈনিকদের সঙ্গে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে স্লোগান তোলেন।সেনাদলগুলিকে বিপুল করতালি দিয়ে অভিনন্দিত করতে থাকে রাজপথের দু’পাশে অপেক্ষমাণ লাখো মানুষ। জনসমুদ্র থেকে বর্ষিত পুষ্পবৃষ্টিতে ছেয়ে যায় ট্যাংক, সাজোয়া যান। কামানের নলে সাধারণ মানুষেরা মালা পরিয়ে দেন। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য!বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পর আর এমন দৃশ্যের অবতারণা কখনো হয়নি।

তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মিল

স্বাধীনতা যুদ্ধ ও ৭ নভেম্বরের ঘটনার মধ্য তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
এক. জাতীয় ইতিহাসের এই দুটি ক্রান্তিকালেই সৈনিক এবং সাধারণ জনতা মিলিত হয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশের জন্য জীবনবাজি রেখে বিপ্লবে নেমেছে।

দুই. উভয় সময়েই সাধারণ সৈনিক ও জনগণ এগিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন দায়িত্বশীল নেতারা ব্যর্থ হওয়ার প্রেক্ষাপটে। একাত্তরে দোদুল্যমান শেখ মুজিব স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা ও নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হন। পঁচাত্তরে বঙ্গভবনে থেকে খন্দকার মোশতাক ব্যর্থ হন জাতিদ্রোহী চক্রান্তকে নস্যাৎ করতে।

তিন. উভয় ঘটনাতেই জিয়াউর রহমানের ভূমিকা ছিলো অনন্যসাধারণ। ’৭১-এ ২৫ মার্চের গণহত্যার সূচনায় জনগণের নির্বাচিত নেতারা আত্মসমর্পণ ও পালানোর পথ বেছে নিলে নেতৃত্বশূণ্য ও আক্রান্ত জনগণ মারাত্মক অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। সেই ঘোর দুঃসময়ে ইথারে ভেসে এসেছিলো একটি কণ্ঠ : ‘আমি মেজর জিয়া বলছি…।’ চট্টগ্রামের কালুরঘাট রেডিও স্টেশন মারফত স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করে জিয়া জাতিকে দিয়েছিলেন বরাভয় আর পথনির্দেশ। শুধু মৌখিক ঘোষণা নয়, শুরু করে দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধ। একইভাবে ’৭৫-এর ৭ নভেম্বর প্রত্যুষেও জনগণ আবার বেতার তরঙ্গে শুনলো সেই একই কণ্ঠ : ‘আমি জিয়া বলছি’। জাতীয় দুর্যোগের কান্ডারী জিয়ার নির্দেশনা কান পেতে শুনলো সবাই। এর আগে কুচক্রীদের সঙ্গে গোপনে হাত মিলিয়ে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে গুটিকয়েক উচ্চাভিলাষী এবং বিভ্রান্ত সামরিক অফিসার ক্ষণস্থায়ী এক ক্যুদেতায় সেনাপ্রধান জিয়াকে বেআইনীভাবে অপসারণ ও বন্দী করলে সাধারণ সৈনিকেরা ওই চক্রান্তের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন। সেনা ছাউনি ছেড়ে বেরিয়ে রাজপথে নেমে এসে তারা জনসাধারণের সঙ্গে সংহতি রচনা করেন। তারাই বন্দী জিয়াকে মুক্ত করে তার হাতে তুলে দেন দেশ পরিচালনার ভার। অবশ্য দূরদর্শী ও দেশপ্রেমিক জিয়াউর রহমান তাৎক্ষণিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ না করে স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক সশস্ত্রবাহিনীকে চক্রান্ত ও সংঘাতমুক্ত করে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনাকেই আশু কর্তব্য বলে নির্ধারণ করেছিলেন। দৃঢ়তা ও কঠোরতার সঙ্গে তিনি সেই জাতীয় কর্তব্য পালনে সফল হয়েছিলেন বলেই আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনী আজ এতোটা শক্তিশালী হতে পেরেছে। তবে সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। মূলকথা হচ্ছে, একাত্তরে স্বাধীনতার ঘোষণা এবং ’৭৫-এ সিপাহী, জনতার বিপ্লব- এই উভয় ঘটনার কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন একজনই। তার নাম জিয়াউর রহমান।

ছদ্মবেশী চক্রান্ত

১৯৭৫ সালে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীতে সংঘাত সৃষ্টির পেছনে দেশের ভেতর থেকে মহলবিশেষের উস্কানি ছাড়াও সীমান্তের বাইরে থেকে ইন্ধন যোগানো হয়েছিল। ব্রিগেডিয়ার খালেদের ক্যুদেতার সাফল্য নিয়ে সংশয় দেখা দিলে সীমান্তের বাইরের চক্রান্তকারীরা তাদের সেকেন্ড ফ্রন্টকে সক্রিয় করে তোলে। খালেদের বিরুদ্ধে সাধারণ সৈনিকদের ক্ষোভ আঁচ করতে পেরে জাসদের গণবাহিনী এবং তথাকথিত বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার গুটিকয়েক লোক তাদের অনুভূতির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে দলে ভিড়ে যায়। তাদের নেতা ছিল সেনাবাহিনী থেকে বহু আগে শেখ মুজিব কর্তৃক অপসারিত কর্ণেল তাহের। এই চক্রের উদ্দেশ্য ছিল অন্তর্ঘাত সৃষ্টি করা। সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মিত্র সেজে এরাই চক্রান্তমূলকভাবে সেনাবাহিনীকে নেতৃত্বহীন করার জন্য অফিসার হত্যা শুরু করে। ৭ নভেম্বরের প্রথম প্রহরে এদের কয়েকজন রেডিও থেকে বিভ্রান্তিকর অপপ্রচার শুরু করে যে, কর্ণেল তাহের হলেন সিপাহী-জনতার বিপ্লবের নেতা। কিছুক্ষণের মধ্যে সাধারণ সৈনিকরা গিয়ে তাদের তাড়িয়ে দিলে বিপ্লবের বাণী সঠিকভাবে প্রচারিত হতে থাকে। অবসরপ্রাপ্ত কর্ণেল তাহের এরপর জিয়াউর রহমানের কাছে গিয়ে তাকে রেডিও স্টেশনে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। সেখানে উপস্থিত ব্রিগেডিয়ার আমিনুল হক তৎক্ষণাৎ বাধা দেন এবং কর্ণেল তাহেরকে ভারতের এজেন্ট ও বিশ্বাসঘাতক হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে চলে যেতে বলেন। ব্রিগেডিয়ার হকের আশঙ্কা ছিলো, তাহেরচক্র রেডিও স্টেশনে নেয়ার কথা বলে পথিমধ্যে জিয়াউর রহমানকে হত্যার পরিকল্পনা এঁটেছিলো। কয়েক বছর আগে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত স্মৃতিচারণে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল মঈনুল ইসলাম চৌধুরী (বর্তমানে মরহুম) এসব তথ্য তুলে ধরেছেন।

মোট কথা, ৭ নভেম্বরের রাতেই তাহের চক্রের অসৎ উদ্দেশ্য ফাঁস হয়ে গিয়েছিলো। চক্রান্তের দায়ে পরে তাদের বিচার ও সাজা হয়েছিলো।

এক সাপ দুই মাথা

বহুদিন প্রতিপক্ষ হিসেবে ‘মক ফাইট’ করার পর আওয়ামী লীগ ও জাসদ আজ এক হয়েছে। সাম্প্রতিককালে তাদের উভয় পক্ষের ভূমিকা ও কথাবার্তায় পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, তাদের আসল গোড়া এক জায়গায়। ঠিক তেমনই খালেদ ও তাহেরও ছিলেন একটি দুমুখো সাপের দুটি মাথা। তাই আওয়ামী লীগ ও জাসদ মিলে আজ খালেদ ও তাহের উভয়ের স্তুতি করছে আর নিন্দাবাদ করছে জিয়াউর রহমানের । এতে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন উঠে ৭ নভেম্বরে তাহের যদি খালেদের বিরুদ্ধে সত্যিই বিপ্লব সংঘটিত করে থাকেন তা হলে দুজনকেই সমর্থন করা যায় কি করে? তাদের দাবি অনুযায়ী তাহের যদি ৭ নভেম্বরের হিরো হয়ে থাকেন, তাহলে খালেদ ছিলেন ভিলেন। এই পরষ্পরবিরোধী দুই পক্ষকেই সমর্থন করার মাজেজাটা আসলে কি?

আ. লীগ-জাসদের মিলিত ভাষা থেকে আজ খোলাসা হয়ে যাচ্ছে যে, ৭ নভেম্বরের বিপ্লবে তাহের গং অন্তর্ঘাত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ঢুকেছিলো। তাহের ও খালেদ উভয়চক্রই ছিলো একই সূত্রে বাঁধা। তাদের উভয়ের তৎপরতার পেছনে যে অভিন্ন উদ্দেশ্য ছিলো,সেটা হলো : বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনোখানে বন্ধক দেয়া।

অফিসার হত্যা দিবস

৭ নভেম্বর তাহেরের অনুসারী কতিপয় বিপথগামী সৈনিক ‘সিপাহী-জনতা ভাই ভাই, অফিসারদের রক্ত চাই’ স্লোগান দিয়ে পিলখানার সামরিক অফিসারদের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের মতোই অফিসার হত্যায় মেতেছিলো। বিপ্লবের যে মূলধারা অর্থাৎ সাধারণ সৈনিকেরা কেউই এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। জিয়াউর রহমান মুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই আত্মঘাতী তৎপরতা সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করেন। তার বীরোচিত ভূমিকায় সশস্ত্র বাহিনীতে রক্তক্ষয়ী তৎপরতা দ্রুত থেমে যায়। কাজেই ৭ নভেম্বরকে সৈনিক হত্যা দিবস বলাটা সত্যের বিকৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। সাধারণ সৈনিক নয়, ৭ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনীর কিছু অফিসার নিহত হয়েছিলেন অর্ন্তঘাতকদের হাতে। এর জন্য দায়ী কর্ণেল তাহের ও তার অনুগতরা। সে কারণেই তাদের বিচার ও সাজা হয়েছে। তাই ৭ নভেম্বরকে অফিসার হত্যা দিবস বললেও তার একটা যুক্তি খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। আর এই অফিসারদের হত্যাকে সমর্থন না করলে কর্ণেল তাহের গংয়ের বিচার ও বিচারের প্রদত্ত সাজার প্রতি সমর্থন জানাতে হয়। কিন্তু ৭ নভেম্বরের বিপ্লব-বিদ্বেষী মহল যুক্তির ধারেকাছে না গিয়ে প্রচারণার ধূম্রজাল সৃষ্টি করে বলে চলছে, তাহেরও ভালো,খালেদও ভালো এবং ৭ নভেম্বরের হত্যা মন্দ কিন্তু হত্যাকান্ড থামালেন যে জিয়া, তিনিও মন্দ। সত্যিই বড় বিচিত্র এই দেশ! এ দেশেই এক মুখে এতো কথা বলা সম্ভব।

অপহরণের সাজানো নাটক

৭ নভেম্বর কর্ণেল তাহের ও গণবাহিনীর ভূমিকা বুঝতে হলে আরেকটি ঘটনার কথা মনে রাখা দরকার। ১৯৭৫ সালের শেষ দিকের কোনো একদিনে জাসদের গণবাহিনীর একটি দল ঢাকার ভারতীয় দূতাবাসে সশস্ত্র অভিযান চালিয়ে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেনকে অপহরণের চেষ্টা চালায়। দূতাবাসে নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত বাংলাদেশী নিরাপত্তা বাহিনীর সময়োচিত পদক্ষেপে সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। গোলাগুলিতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। ওই অভিযানে কর্ণেল তাহেরের দুই সহোদর ভাই অংশ নিয়েছিলেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে জাসদের গণবাহিনীর ওই সশস্ত্র অ্যাডভেঞ্চারটি ছিলো সুপরিকল্পিত এবং গভীর ষড়যন্ত্রমূলক। বাংলাদেশে ১৯৭৫ সালের পটবদলের পর ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ভারত সামরিক অভিযান চালাতে পারেনি পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের হুঁশিয়ারির কারণে। পরবর্তীতে বাংলাদেশে ভারতীয় সামরিক অভিযানের অজুহাত সৃষ্টির অসদুদ্দেশ্যেই রাষ্ট্রদূত সমর সেনকে অপহরনের এই পাতানো খেলার আয়োজন করা হয়েছিলো। নিরাপত্তা বাহিনী সেটি ভন্ডুল করে দেয়। এ চক্রই সামরিক বাহিনীকে নেতৃত্বশূন্য করা, রক্তপাত ঘটানো ও দেশকে রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে সিপাহী-জনতার বিপ্লবের অনুগামী হয়েছিল বন্ধুবেশে। কিন্তু তাদের সে চক্রান্তও সফল হয়নি।

নয়া মহাসড়ক রচনা

৭ নভেম্বরের শিক্ষা হচ্ছে, জাতীয় দুর্যোগে-দুঃসময়ে ব্যবধানের দেয়াল ভেঙে দিয়ে সৈনিক-জনতাকে এক হয়ে দাঁড়াতে হবে। গড়ে তুলতে হবে লৌহদৃঢ জাতীয় ঐক্য ও সংহতি।

ওই মহান বিপ্লবের আরেকটি শিক্ষা হচ্ছে, সশস্ত্র বাহিনীর শীর্ষ পদ করায়ত্ত্ব করেও জাতিদ্রোহী চক্রান্তে লিপ্ত হলে পার পাওয়া যায়না। এ দেশের সাধারণ সৈনিকেরা দেশপ্রেমের জ্বলন্ত বহ্নিশিখা বুকে নিয়ে জাতীয় স্বার্থ ও স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জাগ্রত প্রহরায় নিয়োজিত। তারা প্রয়োজনে ছাউনী ছেড়ে রাজপথে নেমে জনতার সঙ্গে মিতালী গড়তেও জানেন।

সশস্ত্র বাহিনীতে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষ সৃষ্টির বিরুদ্ধেও ৭ নভেম্বর এক চরম হুঁশিয়ারী। হত্যা-কু-ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে উচ্চাভিলাষী সেনা অফিসারদের ক্ষমতা দখলের প্রয়াসের বিরুদ্ধেও ৭ নভেম্বরের বিপ্লব ছিলো এক মহাপ্রতিরোধ। ষড়যন্ত্র করে চেইন অব কমান্ড ও সেনাশৃঙ্খলা লঙ্ঘন করে খালেদচক্র ক্ষমতা দখলের যে চক্রান্ত করেছিল সৈনিক-জনতার বিপ্লবে তা পরাজিত হয়। বিপ্লবী সৈনিক-জনতা সেনাপ্রধান জিয়াকে মুক্ত করে এনে এক অরাজক ও নেতৃত্বশূন্য পরিস্থিতিতে জিয়ার হাতে তুলে দেন দেশের শাসনভার। প্রকাশ্য রাজপথে লাখো সৈনিক-জনতার পুষ্পবর্ষণে অভিষিক্ত হয়ে ক্ষমতার অভিষেক ঘটে তার। বিপ্লবের তরঙ্গাভিঘাতে ভেসে যায় ক্ষমতা দখলের চক্রান্ত।

৭ নভেম্বর বিপ্লবের তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। এই বিপ্লবের প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশে ফিরে আসে প্রকাশ্য রাজনীতি, গঠিত হয় রাজনৈতিক দল, পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও বহুদলীয় গণতন্ত্রের ধারা। এই বিপ্লবের মধ্য দিয়ে চক্রান্তমুক্ত হয়ে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ও ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বিপ্লবের ধারায় ভারতীয় স্বার্থের পরিপূরক অবস্থান থেকে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব অর্জিত হয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ নামের যে জাতিরাষ্ট্র বা নেশনস্টেটটি জন্ম নিয়েছিল সেই রাষ্ট্রের নাগরিকরা রাষ্ট্রভিত্তিক, আধুনিক ও বাস্তবসম্মত এক জাতীয় পরিচয় অর্জন করে। আত্মপরিচয় লাভের মাধ্যমে নবউদ্দীপ্ত ও আত্মোপলব্ধির মাধ্যমে নবোত্থিত এই বাংলাদেশী জাতিসত্তার অভিষেকের দিন ৭ নভেম্বর। আর সিপাহী-জনতার মিলিত বিপ্লবের মহান শিক্ষা ও তাৎপর্যকে আত্মস্থ করে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, স্বকীয়তা, মর্যাদা, নিজস্ব সংস্কৃতি ও গৌরব নিয়ে সামনের দিকে এই জাতিসত্তাকে এগিয়ে চলার প্রশস্ত নতুন মহাসড়ক গড়ে দিয়ে গেছেন জিয়াউর রহমান।

লেখক: জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *