সীতাকুণ্ডের বিস্ফোরণে নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৪৯

:: নাগরিক প্রতিবেদন ::

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে সোনাইছড়ী ইউনিয়নে বিএম কনটেইনার ডিপোতে শনিবার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৪৯ জনে দাঁড়িয়েছে। এ ঘটনায় সাড়ে ৪ শতাধিক আহত হয়েছেন।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন মো. ইলিয়াস চৌধুরী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।

এদিকে সীতাকুণ্ড উপজেলা প্রশাসনের তথ্য কেন্দ্র সূত্র ৪৫ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছে। প্রশাসনের একটি চার্টে বলা হয়েছে, এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত আহত হয়েছেন অন্তত ২০০ জন। 

একের পর এক মরদেহ আসছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে। সমকালকে এ তথ্য জানিয়েছেন চমেক পুলিশ ফাঁড়ির সহকারী উপ পরিদর্শক (এএসআই) মো. আলাউদ্দিন।

নিহতদের মধ্যে আটজন ফায়ার সার্ভিসের কর্মী রয়েছেন। এছাড়া ফায়ার সার্ভিসের অন্তত ২০ জনসহ দুই শতাধিক লোক আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। নিখোঁজ রয়েছেন অনেকে।

শনিবার রাতে প্রথমে আগুন লাগার পর রাত পৌনে ১১টার দিকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। রাত থেকে রোববার বেলা সোয়া ১১টা পর্যন্ত ৩৩ জনের মরদেহ পাওয়া যায় বলে নিশ্চিত করে কর্তৃপক্ষ।

চমেক হাসপাতালে সরেজমিনে দেখা গেছে, চমেক হাসপাতালে একের পর এক অগ্নিদগ্ধ মরদেহ আসছে। বেলা সোয়া ১১টা পর্যন্ত ৩৩টি মরদেহ আসে। এরপর ১২টার পরে এক অ্যাম্বুলেন্সে করে আরও চারটি মরদেহ আসে। পরে আরও একটি আসে। হাসপাতালের চিকিৎসক, স্বেচ্ছাসেবক ও পুলিশ এ তথ্য জানিয়েছে।

আগুন নেভানো ও বিস্ফোরণের ঘটনায় ২৬টি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের টিম কাজ করছে। এছাড়া চট্টগ্রাম, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কুমিল্লা, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী থেকে অফিসাররা যোগ দিয়েছেন। শনিবার রাতে শত শত আহত মানুষকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ( চমেক), চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালসহ নগরীর বিভিন্ন হাসপাতালে প্রেরণ করা হয় এবং এসব হাসপাতালে তাদের চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে।

অ্যাম্বুলেন্সে করে মরদেহ আসছে। কোনো অ্যাম্বুলেন্সে দুটি, আবার কোনো অ্যাম্বুলেন্সে চারটি পর্যন্ত মরদেহ আনতে দেখা গেছে। মরদেহ আসা অব্যাহত রয়েছে। তাই নিহত সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।

ফায়ার সার্ভিসের ৮ জন নিহত

এখন পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের আটজন কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। এ ছাড়াও গুরুতর অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন আরও অন্তত ১৫ জন। তাদের মধ্যে কুমিরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের কর্মী গাউসুল আজম ও সীতাকুণ্ডু স্টেশনের রবিউলকে হেলিকপ্টারে ঢাকায় শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আনা হয়েছে। গাউসুলের শরীরের ৮০ শতাংশ এবং রবিউলের ৫০ শতাংশ দগ্ধ হয়েছে বলে জানা গেছে।

সীতাকুণ্ড ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. নুরুল আলম আজ রোববার বিকেলে বলেন, তাঁদের পাঁচজনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁরা হলেন টিম লিডার নিপুন চাকমা (৪৫), ফায়ার সার্ভিসের কর্মী ফরিদ উদ্দিন (২২), সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী (২৫), রবিউল ইসলাম (২৪) ও মো. রমজান।

আর কুমিরা ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা জানান, তাঁদের পাঁচজনের লাশ পাওয়া গেছে। তাঁরা হলেন রানা মিয়া (২২), আলা উদ্দিন (৩৫), মনিরুজ্জামান (৩০), শাকিল তরফদার (২৪) ও টিম লিডার মিঠু দেওয়ান (৫৫)। দুজন এখনো নিখোঁজ আছেন। নিখোঁজ ব্যক্তিদের মধ্যে আছেন টিম লিডার ইমরান হোসেন (৩৫) ও শফিউল ইসলাম (২২)।

ফায়ার সার্ভিসের মিডিয়া সেলের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা মো. শাজাহান শিকদার বলেন, কন্টেইনারে রাসায়নিক পদার্থ থাকার বিষয়ে ফায়ার সার্ভিসকে অবহিত করা হয়নি। আগুন নেভাতে সেখানে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন বলেন, ‘প্রায় ২৫ বছর ধরে ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কাজ করছি। এত বছরে কখনও এক দুর্ঘটনায় এত মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেনি। আমার জানা মতে, এর আগে কখনো একটি ঘটনায় এত অগ্নিনির্বাপক কর্মীর মৃত্যু হয়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘আগুন নেভাতে ঢাকা থেকে ফায়ার সার্ভিসের ১৪ সদস্যের বিশেষ দল হ্যাজম্যাট সীতাকুণ্ডু গিয়েছে। এর নেতৃত্ব দিচ্ছেন সহকারী পরিচালক (প্রশিক্ষণ) মনির হোসেন। তারা ইতোমধ্যে সেখানে কাজ শুরু করেছে। আগুন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে না এলেও আয়ত্ত্বের মধ্যে আছে। নতুন করে আগুন আর বাড়ছে না।’

২২ ঘণ্টায়ও আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি

বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন লাগার ২২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও সেই আগুন এখনো নিয়ন্ত্রণে আনা যায়নি। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে দমকল বাহিনী কর্মীদের। আগুন নেভাতে গিয়ে কনটেইনার বিস্ফোরণে ইতোমধ্যে ফায়ার সার্ভিসের ৮ কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৫ জন।

রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত আগুন নেভাতে চেষ্টা করছে ২৬টি ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের টিম।এ ছাড়া চট্টগ্রাম, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কুমিল্লা, ফেনী, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালী থেকে অফিসাররা যোগ দিয়েছেন। পাশাপাশি সেনাবাহিনীর ২৫০ জন সদস্য সেখানে উদ্ধার অভিযানে কাজ করছে বলে জানিয়েছে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর)।
 
ফায়ার সার্ভিস জানায়, কনটেইনার ডিপোটিতে বিপুল পরিমাণ রাসায়নিক ‘হাইড্রোজেন পার অক্সাইড’ ছিল। হাইড্রোজেন পার অক্সাইড একটি রাসায়নিক যৌগ। এ কারণে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না।

কেমিক্যাল কনটেইনার থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে ধারণা করা হচ্ছে। আগুন লাগার পর পর কন্টেইনারগুলো একের পর এক বিস্ফোরিত হতে থাকে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে কন্টেইনার ডিপোর আশে পাশের ৪-৫ কিলোমিটার এলাকায় ব্যাপক কম্পনের সৃষ্টি হয়। প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় শতাধিক বিভিন্ন বাড়ি-ঘর ও মসজিদের দরজা এ জানালার কাঁচ ভেঙে যায়। এ ঘটনায় জনমনে আতংকের সৃষ্টি হয়।

বিস্ফোরণে পুরো এলাকায় রাসায়নিকের বিষাক্ত ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়েছে। এতে উদ্ধারকর্মীরা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাদের নিরাপদে নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের আরও ইউনিট আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেয়। তবে ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক (ডিজি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন।

রোববার চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে ভয়াবহ আগুনের ঘটনায় ঘটনাস্থল পরিদর্শনকালে চট্টগ্রাম বিস্ফোরক অধিদপ্তরের পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন বলেছেন, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড একটি রাসায়নিক যৌগ। এটি যদি উত্তপ্ত করা হয়, তাহলে তাপীয় বিয়োজনে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড ভয়ংকর বিস্ফোরক রূপ নেয়। কর্তৃপক্ষ লোকালয়বেষ্টিত ডিপোর ভেতরে কোনো ধরনের অনুমোদনের তোয়াক্কা না করে বিপজ্জনক রাসায়নিক মজুত করে রেখেছিল, যার ফলে বিস্ফোরণে ঘটেছে বড় ধরনের দুর্ঘটনা।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *