স্মরণ: সোনালী কাবিনের কবি আল মাহমুদ

:: ফরিদ উদ্দীন রনি ::

একবার বাংলা একাডেমিতে তরুণ লেখক প্রকল্পে আল মাহমুদকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেখানে ২০-৩০ জন তরুণ লেখক তোলপাড় শুরু করে দেন, আল মাহমুদকে বাংলা একাডেমিতে ঢুকতে দেওয়া হবে না। তার কারণ— আল মাহমুদ ধর্মান্ধ। কট্টর ইসলামপন্থি, জামায়াত শুভাকাঙ্ক্ষী। বাংলা একাডেমির তৎকালীন প্রকল্প-পরিচালক মুহম্মদ নুরুল হুদা তখন সবাইকে শান্ত হতে বললেন এবং অনুরোধ করেন তাঁরা যেন আল মাহমুদের সাথে লেখকসুলভ আচরণ করেন। প্রয়োজনে তাঁর মতাদর্শ নিয়ে তাঁর সামনেই প্রশ্ন করে লেখকের সাথে লেখকের তর্কে বিষয়টি উত্থাপিত করতে অনুরোধ করেন পরিচালক। এবং এ-ও বলেন ‘তোমরা কি রাজনৈতিক কর্মী? লেখকের মতো করে তাকে মোকাবেলা করো।’

কিন্তু না, আন্দোলনকারীরা একাট্টা, কিছুতেই ঢুকতে দেওয়া হবে না আল মাহমুদকে। এরকম একটি অবস্থার মধ্যে আল মাহমুদ এলেন বাংলা একাডেমিতে। হট্টগোলের মধ্যে দিয়ে তিনি ঢুকলেন। সবার-পূর্ব প্রস্তুতি ছিল যে, তাঁকে বাক্যবাণে জর্জরিত করা হবে। কিন্তু তিনি আসার পর যখন বক্তৃতা শুরু করলেন, ১০ মিনিটের মধ্যেই সবাই শান্ত হয়ে গেল। মন্ত্রমুগ্ধের মতো সবাই শুনতে লাগলেন এই কবির কথা। এমনকি বক্তৃতা শেষ হওয়ার পর যাঁরা তাঁকে আসতে দেবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাঁরাই কাছে গিয়ে ফোন নম্বর, অটোগ্রাফ এবং বাসার ঠিকানা নিতে শুরু করলেন।

এই ঘটনা বলার কারণ হলো, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় ধরে সাহিত্য অঙ্গনে আল মাহমুদকে নিয়ে এক ধরনের ঘৃণার চর্চা হচ্ছে। তা হলো-আল মাহমুদ ধর্মান্ধ, কট্টর জামায়াত শুভাকাঙ্ক্ষী। এসব বলে তাঁর ব্যক্তিজীবন নিয়ে সেকুলার পাড়ায় যতখানি আলোচনা সমালোচনা হয় সেটার বিপরীতে বিন্দু পরিমাণ সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা হয় না।

আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যে যে অবদান রেখে গেছেন, তার জন্য তাকে একটিমাত্র লেখায় বর্ণনা করা একেবারেই অসম্ভব। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশের জাতীয় আত্মপরিচয় গড়ে তোলার একেবারে নেপথ্যে যারা ছিলেন তাঁদের মধ্যে আল মাহমুদ একজন। আর বায়ান্নর ভাষাশহীদদের স্মরণে তাঁর লেখা বিখ্যাত কবিতার মতো গভীর ডেফিনেশন কবিতা দ্বিতীয় কেউ লিখতে পারেনি এবং ভবিষ্যতে পারবে কি না তা হয়তো ভবিষ্যত-ই বলে দেবে!

হুমায়ূন আহমেদ যদি আধুনিক বাংলা গদ্যসাহিত্যের রাজা বলা যায়, তাহলে আল মাহমুদ নিঃসন্দেহে কবিতার জগতে একচ্ছত্র সম্রাট।

তবে বলতে হয় কবি যতটা সম্মানের প্রাপ্য তা আমরা তাঁকে দিতে পারিনি। তার প্রাপ্য সম্মানটুকু যে তিনি পাননি; তা কবিরও ধারণা ছিল একরকম। তাঁর প্রবন্ধ সঙ্কলন ‘সাহসের সমাচার’ গ্রন্থে তিনি এ কথাটি-ই বলেছেন এভাবে-

‘তোমরা আমাকে বোঝোনি। আমি বলি না বুঝবে না, বুঝবে। তবে তখন আমি আর থাকব না। তবে এটা মনে রেখো, বাংলা সাহিত্যে যারা কিছু করতে চাও, আমাকে তোমার পাঠ করতেই হবে। এটা আমার আত্মবিশ্বাস।’

কষ্ট করে নিজেই নিজের জায়গা তৈরি করেছেন। তার জন্য নানা ঘাত-প্রতিঘাত মোকাবেলা করতে হয়েছে। একবার এক সাক্ষাৎকারে কবি অভিমানের সুরে বলেছিলেন, ‘আমার কাঁধে বিরাট সংসার। আমার রোজগার দিয়ে ছেলেমেয়েদের বড় করতে হয়েছে। ভালো কোনো চাকরি আমাকে কেউ দেয়নি। প্রচুর শ্রম দিতে হয়েছে। নানা ধরনের গদ্য লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু করতে পারলাম না। বন্ধুদের, কবিদের দেয়া মানসিক চাপ উপেক্ষা করে সমাজে জায়গা করে নিতে হয়েছে আমাকে। কেউ কোনো স্পেস আমাকে দিতে চায়নি। অনেক ধাক্কা খেয়েছি, মুক্তিযুদ্ধ করেছি, জেলও খেটেছি। আমাকে বলো, একজন কবি আর কী কী করতে পারে? আমাকে স্বাধীনতা পদক দেয়া হয়নি। এখন কোনো কিছুতেই আমার আর আফসোস নেই।’

শেষের সময়ে এসে তাঁর রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে নানা জনের নানান মত ও বিতর্ক ছিল। এসব বিতর্কের ঊর্ধ্বে আল মাহমুদের কবিসত্তা! কারণ, তাঁর বড় পরিচয় তাঁর কবিতা। তিনি কবি এবং কবি।

খোদার কাছে কবির পরম ইচ্ছে ছিল, শুক্রবারে কোনো এক সময় যেন মৃত্যুর ডাক আসে! ‘স্মৃতির মেঘলাভোরে’ কবিতায় কবি বলেছিলেন-

‘কোনো এক ভোরবেলা, রাত্রি শেষে শুভ শুক্রবারে

মৃত্যুর ফেরেশতা এসে যদি দেয় যাওয়ার তাকিদ

অপ্রস্তুত এলোমেলো এ গৃহের আলো অন্ধকারে

ভালো-মন্দ যা ঘটুক মেনে নেবো এ আমার ঈদ।’

কোনো এক শুক্রবার যদি মৃত্যু এসে ‘যাওয়ার তাকিদ’ দেয় তাহলে সেই মৃত্যুকে তিনি ‘ঈদ’ হিসেবে সানন্দে গ্রহণ করবেন। তাই তো খোদা তার আরজি কবুল করেছেন, মৃত্যুর ফেরেশতা শুক্রবারেই তাঁকে নিয়েছেন।

গত ১৫ ফেব্রুয়ারি ছিলো কবির মৃত্যুবার্ষিকী। আল্লাহ তা’য়ালা যেনো তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস দান করেন।

[আলোকচিত্রী: এসএম সাইফুল ইসলাম]

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *