২০২৩ সালে ৫১৩ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

:: নাগরিক প্রতিবেদন ::

২০২৩ সালে সারা দেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৫১৩ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। আত্মহত্যায় এবারও নারীর সংখ্যা বেড়েছে। আর শিক্ষার স্তর বিবেচনায় আত্মহত্যা বেশি স্কুলগামীদের সংখ্যা বেশি।

শনিবার (২৭ জানুয়ারি) এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে ২০২৩ সালের আত্মহত্যার এই চিত্র তুলে ধরে বেসরকারি সংস্থা আঁচল ফাউন্ডেশন। সংগঠনটির রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস ইউনিটের টিম লিডার ফারজানা আক্তার লাবনী এসব তথ্য তুলে ধরেন। 

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সবচেয়ে বেশি আত্মহননের ঘটনা ঘটেছে ঢাকা বিভাগে এ সংখ্যা ১৪৯ জন। গত বছর আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছেলে ২০৪ জন, নারী ৩০৯ জন। ২০২২ সালে আত্মহত্যা করেন ৫৩২ জন। ২০২৩ সালে ২২৭ জন স্কুল শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন। কলেজ শিক্ষার্থী রয়েছেন ১৪০ জন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ৯৮ জন ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থী ৪৮ জন।

ঢাকা বিভাগে ১৪৯ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৮৯ জন, রাজশাহী বিভাগে ৭৭ জন, খুলনা বিভাগে ৬৪ জন, বরিশাল ও রংপুর বিভাগেই ৪৩ জন করে, ময়মনসিংহে ৩৬ জন ও সিলেটে ১২ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন।

২০২৩ সালে আত্মহনন করা মোট শিক্ষার্থীর ৬০ দশমিক ২ শতাংশ নারী। তাদের আত্মহত্যার কারণ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২৮ দশমিক ৮ শতাংশ আত্মহত্যা করেন অভিমানে, ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ প্রেমঘটিত কারণে, ৮ দশমিক ৪ শতাংশ মানসিক ভারসাম্যহীনতায়, ৭ দশমিক ১ শতাংশ পারিবারিক কলহে, ৩ দশমিক ৯ শতাংশ যৌন হয়রানি, ৪ দশমিক ২ শতাংশ পড়ালেখার চাপে ও অকৃতকার্য হয়ে, ১ দশমিক ৬ শতাংশ পারিবারিক নির্যাতনে, শূণ্য দশমিক ৬ শতাংশ অপমানে ও ২ দশমিক ৯ শতাংশ কাঙিক্ষত ফল না পেয়ে আত্মহত্যা করেন।

আঁচল ফাউন্ডেশন বলছে, ২০২৩ সালে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার পেছনে বড় কারণ অভিমান। মোট শিক্ষার্থীর ১৬৫ জন অর্থাৎ ৩২ দশমিক ২ শতাংশ অভিমান থেকে, ১৪ দশমিক ৮ শতাংশ প্রেমঘটিত কারণে, ৯ দশমিক ৯ শতাংশ মানসিক সমস্যাজনিত কারণে, ৬ দশমিক ২ শতাংশ পারিবারিক কলহে, ১ দশমিক ৪ শতাংশ পারিবারিক নির্যাতনে, ৪ দশমিক ৫ শতাংশ পড়ালেখার চাপে, পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ, ১ দশমিক ৮ শতাংশ কাঙিক্ষত ফলাফল না পেয়ে, ২ দশমিক ৫ শতাংশ যৌন হয়রানি ও শূণ্য দশমিক ৮ শতাংশ অপমান বোধ করে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন।

মোট শিক্ষার্থীর ৪৪ দশমিক ২ শতাংশ স্কুলগামী গতবছর আত্মহত্যা করেন। এদের মধ্যে কলেজ শিক্ষার্থী রয়েছেন ১৪০ জন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ১৮ জন ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ৪৮ জন।

আঁচল ফাউন্ডেশন বলছে, বয়ঃসন্ধিকালে নানা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এ সময় বেশি রাগ-অভিমানের প্রবণতাও থাকে। গেল বছরের চিত্রে দেখা যায়, ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সী ৩৪১ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে ২২২ জনই মেয়ে; বিপরীতে ছেলে ১১৯ জন।

২০ থেকে ২৫ বছর বয়সীদের আত্মহত্যার হার ২৩ দশমিক ৪ শতাংশ, ২৬ থেকে ৩০ বছর বয়সী ২ দশমিক ৩ শতাংশ, আর এক-দুই বছর বয়সী শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার হার ৭ দশমিক ৮ শতাংশ।

আঁচল ফাউন্ডেশনের সভাপতি তানসেন রোজ বলেন, গত বছরের আত্মহত্যার ঘটনাগুলোর মূল কারণ দেখা যাচ্ছে অভিমান। অভিমানের কারণে আত্মহত্যার ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় পরিবারের সঙ্গে সন্তানদের সম্পর্ক কতটুকু মজবুত তা নিয়ে চিন্তার উদ্রেক করে। কিশোর বয়সে হরমোনজনিত কারণে শিক্ষার্থীরা বেশি আবেগপ্রবণ থাকে। ফলে আত্মহত্যার প্রবণতাও বেশি থাকে। ঢাকা শহরে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠার সহায়ক পরিবেশ না থাকায় আত্মহত্যার ঘটনা বেশি ঘটছে।

আবেগ প্রকাশে আস্থার জায়গা না পাওয়ায় কম বয়সি শিক্ষার্থীদের মধ্যে এবং নারীর প্রতি সমাজের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি বলে মনে করেন বক্তারা। তাই আত্মহত্যার প্রবণতা রোধে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আবেগ নিয়ন্ত্রণের দক্ষতা আনার ওপর জোর দিয়ে তারা বলছেন, শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক দক্ষতা বাড়াতে হবে, যেন তারা কখনেও নিজেদের বিচ্ছিন্ন অনুভব না করেন। আত্মহত্যা প্রতিরোধে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের সব শিক্ষার্থীকে অনুভূতি নিয়ন্ত্রণের কৌশল ও ধৈর্যশীলতার পাঠ শেখানোসহ কয়েকটি সুপারিশ করা হয়।

এসময় আত্মহত্যা ঠেকাতে কিছু সুপারিশ তুলে ধরে সংগঠনটি। সেগুলো হল, স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য প্রতি মাসে অন্তত একবার মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর জন্য একজন করে মেন্টর রাখা ও মেন্টাল হেলথ কর্নার চালু করা। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ পদ্ধতিতে মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ট্যাবু ভাঙতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন প্রচার চালু করা। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের আবেগ নিয়ন্ত্রণের কৌশল ও ধৈর্যশীলতা শেখানো। যে কোনো নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে শিক্ষার্থীদের কৌশল, মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ ও মানসিক বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে শেখানো। মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দ্রুত ও সহজলভ্য করতে টোল ফ্রি জাতীয় হট লাইন নম্বর চালু করতে হবে।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *