■ আশুলিয়া প্রতিনিধি ■
সাভারের আশুলিয়ায় পোশাক শ্রমিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে এক শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া ৪ জন গুলিবিদ্ধসহ অন্তত ৩০ শ্রমিক আহত হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্তত ৫টি গাড়ি।
দুপুরে আশুলিয়ার টঙ্গাবাড়ি এলাকার মন্ডল নিটওয়্যার কারখানার সামনে এ ঘটনা ঘটে।
নিহত পোশাক শ্রমিকের নাম কাউসার হোসেন খাঁন (২৭) তিনি টঙ্গাবাড়ি এলাকার ম্যাংগো টেক্স লিমিটেডের সুইং অপারেটর। আর গুলিবিদ্ধ দুই শ্রমিকের নাম রাসেল মিয়া ও নয়ন। তারা অপর দুটি পোশাক কারখানার শ্রমিক।
কেয়া বেতন পরিশোধ ও বন্ধ কারখানা খুলে দেয়ার দাবিতে সকাল থেকে টঙ্গাবাড়ি এলাকায় ম্যাংগো টেক্স লিমিটেডসহ কয়েকটি গার্মেন্টসের শ্রমিকরা বিক্ষোভ করেন। দুপুরের দিকে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে ও কারখানায় ভাঙচুরের চেষ্টা চালায়। এ সময় সেখানে দায়িত্বে থাকা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদেরকে সরে যেতে মাইকিং করে। কিন্তু শ্রমিকরা তাদের কথা না শুনে সড়কে যানচলাচল বন্ধ করে দেয় ও বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কয়েকটি গাড়ি ভাংচুর করে। এসময় উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। শ্রমিকরা ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে যৌথ বাহিনীর কয়েক সদস্যকে আহত করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাবার বুলেট ও কয়েক রাউন্ড গুলি ছুড়ে। এতে ম্যাংগো টেক্স লিমিটেডের শ্রমিক কাউসার হোসেন খাঁন, রাসেল মিয়া ও নয়ন গুলিবিদ্ধ হন। পরে তাদেরকে দ্রুত উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য সাভারের এনাম মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে নিলে কর্তব্যরত চিকিৎসক কাউসারকে মৃত ঘোষণা করেন। হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ অন্য দুই শ্রমিকের চিকিৎসা চলছে। এ ঘটনায় ওই এলাকায় চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। তবে কারা গুলি করেছে তা জানাতে পারেনি শ্রমিকরা।
ন্যাচারাল ডেনিমসের শ্রমিক সুমন বলেন, ‘সকালে আমাদের কারখানায় সবাই কাজ করছিল। আমাদের কারখানায় কোনো ধরনের আন্দোলন হয়নি। তবে মণ্ডল গ্রুপের শ্রমিকরা কারখানার সামনে আন্দোলন শুরু করলে আমাদের শ্রমিকরা সংহতি জানিয়ে মণ্ডলের সামনে যায়। সেখানে আরও কয়েকটি কারখানার শ্রমিকরা যোগ দেয়। এ সময় শ্রমিকদের লাঠিচার্জ শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এক পর্যায়ে গুলি ছুড়লে ৫ জনের গুলি লাগে। পরে আমি তাদের মধ্যে দুজনকে হাসপাতালে নিয়ে আসি। এ ছাড়া প্রায় ৩০ জন শ্রমিক আহত হয়েছে। তারা বিভিন্ন হাসপাতাল চিকিৎসা নিচ্ছে।
বিক্ষুদ্ধ শ্রমিকরা জানান, গত ২৭ আগস্ট এক নোটিশের মাধ্যমে বার্ডস গ্রুপ লে-অফ ঘোষণা করে নোটিস দেয়। নোটিসে রাশিয়া—ইউক্রেন যুদ্ধ ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে কারখানায় কাজ না থাকায় অব্যাহতভাবে আর্থিক লোকসানের মধ্য দিয়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা জানায়। নোটিসে ২৮ আগস্ট থেকে গ্রুপটির আর এন আর ফ্যাশনস লিমিটেড, বার্ডস গার্মেন্টস লিমিটেড, বার্ডস ফেডরেক্স লিমিটেড এবং বার্ডস এ অ্যান্ড জেড লিমিটেডের সকল শাখার কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
ন্যাচরাল ডেনিম কারখানার এইচআর অ্যাডমিন সবুজ হাওলাদার বলেন, ‘আমাদের কারখানায় কোনো সমস্যা ছিল না। সকাল থেকেই শ্রমিকরা শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করছিল। হঠাৎ শ্রমিকদের কাছে গুজব আসে, পাশের মণ্ডল গার্মেন্টসের শ্রমিক মারা গেছে। এটা শুনেই সব শ্রমিক একসঙ্গে কারখানা থেকে বেরিয়ে মণ্ডল গার্মেন্টসের সামনে চলে যায়। পরে ওখানে কী ঘটেছে আমার জানা নেই।’
এ ব্যাপারে শিল্পপুলিশ-১ এর পুলিশ সুপার সারোয়ার আলমের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।
সাভার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. জুয়েল মিয়া সংঘর্ষে শ্রমিক মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ওসি বলেন, সংঘর্ষ চলাকালে এক পোশাকশ্রমিক নিহত হয়েছেন। তবে তিনি কীভাবে মারা গেছেন, তা আমরা নিশ্চিত না।
এ বিষয়ে এনাম মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের ডিউটি ম্যানেজার এনামুল বলেন, গুলিবিদ্ধ হয়ে ওই শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চল পুলিশ-১ এর একজন কর্মকর্তা বলেন, বিক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেশ কয়েকটি গাড়ির কাচ ইটপাটকেল ছুড়ে ভেঙে ফেলেছে। শিল্প পুলিশের এসপি, র্যাবের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ কয়েকজন আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাবার বুলেট ব্যবহার করা হয়েছে।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট ও সোয়েটার্স শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের আইনবিষয়ক সম্পাদক খায়রুল মামুন বলেন, গত কয়েক দিনে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলের সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আজকে একজন শ্রমিক নিহত ও একাধিক শ্রমিকের আহতের ঘটনা কাম্য নয়। যেখানে সমস্যা সমাধান হয়ে যাচ্ছিল, সেখানে খতিয়ে দেখা প্রয়োজন মন্ডল নিটওয়্যারে কেন এ ধরনের ঘটনা ঘটল। দ্রুত এ সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে, না হলে এ শিল্প খাতটি গভীর সংকটের মুখে পড়বে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
শিল্পাঞ্চল আশুলিয়ায় সোমবার খোলা দেখা গেছে অধিকাংশ তৈরি পোশাক কারখানা। এর মধ্যে শ্রম আইনের ১৩(১) ধারায় ১১টি, ও সাধারণ ছুটির কারণে ৭টিসহ মোট ১৮টি কারখানা বন্ধ রয়েছে।
শিল্প পুলিশ বলছে, যেকোনো ধরনের সহিংসতা এড়াতে, শিল্পাঞ্চল ঘিরে রয়েছে যৌথবাহিনীর সমন্বয়ে পুলিশ, আর্মস পুলিশ, শিল্প পুলিশ, বিজিবি ও সেনা সদস্যদের তৎপরতা।
নিহত শ্রমিকের পরিবারকে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ, বিজিএমইএর দুঃখপ্রকাশ
আশুলিয়ায় সংঘর্ষে শ্রমিক কাউসার হোসেন খাঁন নিহতের ঘটনায় দুঃখপ্রকাশ করেছে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)। একই সঙ্গে তাঁর পরিবারকে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে। নিহত ওই শ্রমিক জিরাবো এলাকার ম্যাঙ্গো টেক্স লিমিটেড কারখানায় কাজ করতেন।
আজ সোমবার এক বিজ্ঞপ্তিতে বিজিএমইএর সচিব ফয়জুর রহমান এ তথ্য জানিয়েছেন।
ফয়জুর রহমান বলেন, শ্রম আইন অনুযায়ী তাঁর (নিহত শ্রমিকের) সকল পাওনাদি অতি দ্রুত পরিশোধ করা হবে। পোশাক শিল্প অধ্যুষিত এলাকায় সুষ্ঠু আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতা একান্তভাবে কামনা করছে বিজিএমইএ।
ফয়জুর রহমান আরও বলেন, এদিন সকালে টঙ্গী-আশুলিয়া-ইপিজেড সড়কের জিরাবো এলাকার মন্ডল গ্রুপ -এর কারখানায় সেনাবাহিনীর উপস্থিতিতে শ্রমিকদের দাবি নিয়ে মালিকপক্ষের সঙ্গে শ্রমিক প্রতিনিধিদের আলোচনা চলছিল। এ সময় কিছু বহিরাগত ব্যক্তি মন্ডল গ্রুপের দুজন শ্রমিকের মৃত্যুর গুজব তুলে কারখানার বাইরে অবস্থান নেন। পরে অন্য কারখানার শ্রমিকেরাও সেখানে জড় হতে থাকেন। এক পর্যায়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও শ্রমিকেরা মুখোমুখি অবস্থান নেন।