গাজীপুরে সাংবাদিক তুহিন হত্যার ঘটনায় আটক ৫

■ গাজীপুর প্রতিনিধি ■

গাজীপুরে দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ পত্রিকার গাজীপুর প্রতিনিধি মো. আসাদুজ্জামান তুহিনকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যার ঘটনায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন বাসন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শাহীন খান বলেন, সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন হত্যাকাণ্ডে পাঁচজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। তবে সিসি ক্যামেরা বিশ্লেষণ যাদের পাওয়া গেছে আটকদের মধ্যে তারা কেউ নেই। তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম-পরিচয় প্রকাশ করতে অনীহা প্রকাশ করেন তিনি।

গাজীপুর মেট্টোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) উপকমিশনার রবিউল হাসান বলেন, সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরা বিশ্লেষণ করে শনাক্ত করা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের গ্রেফতার করা হবে। জড়িতদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে বলে তিনি জানান।

এদিকে শুক্রবার অজ্ঞাতনামা আসামিদের নামে গাজীপুর মেট্টোপলিটন পুলিশের বাসন থানায় নিহতের ভাই মো. সেলিম বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেছেন।

বৃহস্পতিবার (৭ আগস্ট) দিবাগত রাতে মহানগরীর বাসন থানাধীন ব্যস্ততম চান্দনা চৌরাস্তা মোড় এলাকার দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ পত্রিকার গাজীপুর প্রতিনিধি আসাদুজ্জামান তুহিন নামের ওই সাংবাদিককে প্রকাশ্যে, জনসম্মুখে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয়। ঘটনার পরপরই সিসি ক্যামেরার একটি ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এ ঘটনায় স্থানীয় সাংবাদিক মহলে তীব্র ক্ষোভ ও উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।

সিসিটিভির ফুটেজে পুলিশ জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৮ মিনিট। গাজীপুরের চন্দনা চৌরাস্তার পশ্চিম পাশে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে শাপলা ম্যানশনের সামনে হঠাৎ কালো রঙের জামা পরা এক নারী হেঁটে যাচ্ছেন। এসময় পেছন থেকে নীল শার্ট পরা এক ব্যক্তি ওই নারীকে টেনে ধরেন। কিন্তু নারী জোর করে চলে যেতে চাইলে তার সামনে গিয়ে গতিরোধ করেন। একপর্যায়ে ওই ব্যক্তি নারীকে চড় থাপ্পড় মারেন। ঠিক এমন সময় পাশ থেকে কয়েকজন যুবক হাতেই রা মদা ও চাইনিজ কুড়াল দিয়ে তাকে কোপানোর চেষ্টা করে। তখন ওই ব্যক্তি দৌড়ে পালিয়ে যান।

ঘটনার কিছু সময় আগে চান্দনা চৌরাস্তা এলাকায় একটি দোকানে বসে সময় কাটাচ্ছিলেন সাংবাদিক তুহিন ও তার সহকর্মী শামীম হোসেন।

ঘটনার বর্ণনা দিয়ে শামীম বলেন, চৌরাস্তা এলাকায় আমরা দু’জন একদিক থেকে অন্য পাশে হেঁটে যাচ্ছিলাম। ঠিক এমন সময় এক নারী ও পুরুষ আমাদের অতিক্রম করে যায়। তখন কয়েকজন লোক ধারালো অস্ত্র নিয়ে বলতে থাকে, ‘এই পাইছি তোরে আয়’। এ সময় তারা রাম দা বের করলে ওই লোকটা দৌঁড় দেয়। ঠিক ওই সময় সন্ত্রাসীরা ধারালো অস্ত্র নিয়ে আমাদের পাশ দিয়ে দৌঁড় দেয়। তখন আমার পাশ থেকে তুহিন মোবাইল নিয়ে ওদের পেছনে দৌড় দেন। তখন আমি ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। ফলে আমি আর তাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পরে তুহিনকে খুঁজতে এগিয়ে যাই। তখন দেখি, যারা রাম দা নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তারা হঠাৎ থেমে পেছন দিকে তাকায়।

তাকিয়ে দেখে তুহিন ওদের দিকে মোবাইল ধরে রেখেছে। এসময় ওদের সঙ্গে তুহিনের হয়তো কিছু একটা হয়েছে। তখন তুহিন দৌড়ে চান্দনা চৌরাস্তা ঈদগা মার্কেটের পূর্ব পাশে একটি দোকানে ঢুকে যায়। ঠিক ওই মুহূর্তে ওরাও ওই দোকানে ঢুকে ওকে কুপিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায়।

অপরদিকে নারীর সঙ্গে যেই ব্যক্তির ঝামেলা হয়েছিল সেই বাদশা মিয়া আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছেন। বাদশা মিয়া বলেন, ওই মেয়েসহ একটা টিম আছে, ওরা আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে গেছে।

এদিকে, গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে বাদশা মিয়া নেই। তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।

গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার ড. মো. নাজমুল করিম খান জানান, হানিট্র্যাপে করে একটি মেয়েকে দিয়ে ট্রাপ করানো হতো। তারা বিভিন্ন মানুষকে টার্গেট করে ট্র্যাপে ফেলে টাকাসহ বিভিন্ন মালামাল ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটাতো। এরকম কয়েকটি গ্রুপ কাজ করতো বিভিন্ন জায়গায়। ঘটনার দিন বাদশা নামের এক লোককে ট্র্যাপে ফালানোর চেষ্টা করলে ওই লোক বুঝে ফেলে। পরে তাদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। একপর্যায়ে ওই নারীর সহযোগী আগে থেকে ওৎপাতা ৫-৭জন ছেলে এসে ওই লোককে কোপাতে শুরু করে। এসময় ওই লোক যখন দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছিল এ ঘটনা ওই সাংবাদিক মোবাইলে ধারণ করছিল। পরে তাকে চিনে ফেলে তাকে কুপিয়ে হত্যা করে। ইতোমধ্যে হামলাকারীদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের ধরতে বিভিন্ন স্থানে অভিযান অব্যাহত আছে।

‘ছেলে বলেছিল, তোমাকে আগামী মাসে চোখের ডাক্তার দেখাব’

‘আমার ছেলে তুহিন কালকে (বৃহস্পতিবার) বলেছিল, “আমি তোমাকে আগামী মাসে চোখের ডাক্তার দেখাব। ডাক্তার অপারেশন করানোর কথা বললে, অপারেশন করাব। আম্মা কোনো চিন্তা করো না। তুমি ভালো হয়ে যাবে।’’’ বুক চাপড়ে আহাজারি করতে করতে এসব কথা বলছিলেন গাজীপুরে দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনের ৭৫ বছর বয়সী মা সাবিহা খাতুন।

আজ শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলার ৬ নম্বর ফুলবাড়িয়া ইউনিয়নের ভাটিপাড়া গ্রামে তুহিনের বাড়িতে গিয়ে তাঁর মাকে এমন বিলাপ করতে দেখা যায়। তিনি মো. হাসান জামাল ও সাবিহা খাতুন দম্পতির ছেলে। পাঁচ ভাই ও দুই বোনের মাঝে সবার ছোট তুহিন।

আসাদুজ্জামান তুহিনের স্ত্রীর নাম মুক্তা আক্তার। তাঁদের দুটি শিশুসন্তান রয়েছে। বড় ছেলে তৌকিরের বয়স সাত এবং ছোট ছেলে ফাহিমের বয়স তিন বছর।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাতে গাজীপুরের চান্দনায় দুর্বৃত্তরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে তুহিনকে কুপিয়ে হত্যা করে। তাঁর মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লে আজ সকাল থেকে আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশীরা তাঁর গ্রামের বাড়ি ভাটিপাড়া আসতে শুরু করেন।

ছেলের নির্মম মৃত্যুর খবরে পাগলপ্রায় বৃদ্ধ বাবা মো. হাসান জামাল। ক্ষণেক্ষণেই মূর্ছা যাচ্ছিলেন তিনি। আহাজারি করতে করতে হাসান জামাল বলেন, ‘কী অপরাধ করেছিল আমার ছেলে? কী অন্যায় করেছিল সে? কেন এমন হলো। আমি কারও ক্ষতি চাই না। তোমরা আমার ছেলেকে এনে দাও।’

তুহিনের বোন সাইদা আক্তার রত্না বলেন, ‘মাঝে মাঝে আমাদের খোঁজখবর নেয়। আমার ভাই কোনো দিন কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। কখনো খারাপ ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা দিত না। কেন আমার ভাইকে হত্যা করা হলো। আমার ভাইয়ের কী অপরাধ ছিল। আমার ভাইকে যারা হত্যা করেছে, তাদের ফাঁসি চাই।’ এসব কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন রত্না।

বাড়িতে উপস্থিত স্বজনেরা জানান, আসাদুজ্জামান তুহিন ২০০৫ সালে ফুলবাড়িয়া আল হেরা স্কুল থেকে এসএসসি, ২০০৭ সালে সিলেট এম সাইফুর রহমান কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর গাজীপুরের ভাওয়াল কলেজ থেকে অনার্স করে সেখানে ভাই জসিম উদ্দিনের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। পরে একটি ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি নেন। পাশাপাশি ২০১২ সালে সংবাদপত্রে কাজ শুরু করে ওষুধ কোম্পানির চাকরি ছেড়ে দেন। এরই মধ্যে ২০০৯ বা ১০ সালের দিকে হঠাৎ বড় ভাই জসিম ক‍্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

তুহিন গাজীপুরে বসবাস করতেন। তাঁর অপর ভাই সেলিমও সেখানে থাকেন। সেলিম পরিবহনশ্রমিকের কাজ করেন। দ্বিতীয় ভাই জাহাঙ্গীর আলম কক্সবাজারের টেকনাফে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন এবং অন‍্য ভাই শাজাহান মিয়া সিলেটে বসবাস করেন। তাঁদের দুই বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় বর্তমানে গ্রামের বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা ও মা বসবাস করেন। তাঁরা বার্ধক‍্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত। ছেলেরাই তাঁদের দেখভাল করে আসছিলেন।

হত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধন

গাজীপুরে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিন হত্যার প্রতিবাদে মানববন্ধন ও সভা হয়েছে। আজ সকালে গাজীপুর প্রেসক্লাবের সামনে এই কর্মসূচির আয়োজন করে সাংবাদিক ইউনিয়ন। কর্মরত সাংবাদিকেরা হত্যার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানান। তাঁরা বলেন, গাজীপুরে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজি ও ছিনতাইকারীদের মদদদাতাদেরও চিহ্নিত করতে হবে। আসামিরা চিহ্নিত হয়েছে, তাদের সিসিটিভি ফুটেজে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এরপরও গ্রেফতার করতে না পারা প্রশাসনের ব্যর্থতা।

গাজীপুর সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি দেলোয়ার হোসেনের সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন সাংবাদিক ফজলুল হক মোড়ল, ফারদিন ফেরদৌস, মাসুদ রানা, মাজহারুল ইসলাম, মাহমুদা শিকদার, আমিনুল ইসলাম, শরীফ আহমেদ, শাহ শামসুল হক, আজিজুল হক, রেজাউল করিম প্রমুখ।

শেয়ার করতে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *