■ নাগরিক প্রতিবেদন ■
এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে ৫৯৩টি দুর্ঘটনায় ৫৮৮ জন নিহত হয়েছেন এবং আহতের সংখ্যা ১১২৪ জন। নিহতদের মধ্যে ৮৬ নারী এবং ৭৮ শিশু রয়েছে। বিদায়ী মাসে দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে নিহতের সংখ্যা ১৯ দশমিক ৬ জন।
এ সময়ে ২১৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২২৯ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া সাতটি নৌ-দুর্ঘটনায় আটজন নিহত এবং চারজন আহত হয়েছেন। ২২টি রেলপথ দুর্ঘটনায় ২৪ জন নিহত এবং ছয়জন আহত হয়েছেন।
রোববার (১১ মে) সকালে সংবাদমাধ্যমে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমানের পাঠানো এপ্রিল মাসের সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়। প্রতিবেদনে ৯টি জাতীয় দৈনিক,৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং নিজস্ব তথ্যের ভিত্তিতে সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
দুর্ঘটনার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এপ্রিল মাসে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের মধ্যে নারী ৮৬ (১৪ দশমিক ৬২ শতাংশ) এবং শিশু ৭৮ (১৩ দশমিক ২৬ শতাংশ)। এছাড়া ২১৮টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ২২৯ জন, যা মোট নিহতের ৩৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৩৬ দশমিক ৭৬ শতাংশ। দুর্ঘটনায় ১১৬ জন পথচারী নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ১৯ দশমিক ৭২ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৭৪ জন, অর্থাৎ ১২ দশমিক ৫৮ শতাংশ।
দুর্ঘটনা সংঘটিত সড়কের বিষয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ২১৩টি (৩৫ দশমিক ৯১ শতাংশ) জাতীয় মহাসড়কে, ২৩৪টি (৩৯ দশমিক ৪৬ শতাংশ) আঞ্চলিক সড়কে, ৭৬টি (১২ দশমিক ৮১ শতাংশ) গ্রামীণ সড়কে, ৬১টি (১০ দশমিক ২৮ শতাংশ) শহরের সড়কে এবং ৯টি (১ দশমিক ৫১ শতাংশ) অন্যান্য স্থানে সংঘটিত হয়েছে।
এদিকে ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ১৭৩টি দুর্ঘটনায় ১৫৪ জন নিহত হয়েছেন। রংপুর বিভাগে সবচেয়ে কম ৩১টি দুর্ঘটনায় ৩২ জন নিহত হয়েছেন। একক জেলা হিসেবে চট্টগ্রাম জেলায় ৩৫টি দুর্ঘটনায় ৪৬ জন নিহত হয়েছে। সবচেয়ে কম নীলফামারী জেলায়। এই জেলায় কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটলেও প্রাণহানি ঘটেনি। রাজধানী ঢাকায় ৩৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৯ জন নিহত এবং ২৭ জন আহত হয়েছে।
যানবাহনভিত্তিক নিহতের চিত্র:
দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়- মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ২২৯ জন (৩৮.৯৪%), বাসের যাত্রী ২১ জন (৩.৫৭%), ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি আরোহী ৩৫ জন (৫.৯৫%), প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাস- অ্যাম্বুলেন্স আরোহী ২৬ জন (৪.৪২%), থ্রি-হুইলার যাত্রী (সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা) ১১৯ জন (২০.২৩%), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-করিমন-ভটভটি-পাখিভ্যান-মাহিন্দ্র-টমটম-আলগামন) ৩১ জন (৫.২৭%) এবং বাইসাইকেল-রিকশা আরোহী ১১ জন (১.৮৭%) নিহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনা সংঘটিত সড়কের ধরন:
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ২১৩টি (৩৫.৯১%) জাতীয় মহাসড়কে, ২৩৪টি (৩৯.৪৬%) আঞ্চলিক সড়কে, ৭৬টি (১২.৮১%) গ্রামীণ সড়কে এবং ৬১টি (১০.২৮%) শহরের সড়কে এবং ৯টি (১.৫১%) অন্যান্য স্থানে সংঘটিত হয়েছে।
দুর্ঘটনার ধরন:
দুর্ঘটনাসমূহের ১৪৬টি (২৪.৬২%) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ২৩৭টি (৩৯.৯৬%) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১১৯টি (২০.০৬%) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেয়া, ৭৪টি (১২.৪৭%) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ১৭টি (২.৮৬%) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহন:
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে- ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-পুলিশ ভ্যান-ট্রাক্টর-ট্রলি- লরি-তেলবাহী ট্যাংকার-ড্রাম ২৪%, যাত্রীবাহী বাস ১৩.৯০%, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-অ্যাম্বুলেন্স-জীপ ৬%, মোটরসাইকেল ২৪.৬৫%, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা) ২৩.৪৯%, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন (নসিমন-করিমন-ভটভটি-পাখিভ্যান-টমটম-মাহিন্দ্র-আলগামন)৩.৭৯%, বাইসাইকেল-রিকশা ২.২১% এবং অজ্ঞাত যানবাহন ১.৮৯%।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা:
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা ৯৪৯টি। (বাস ১৩২, ট্রাক ১৩৯, কাভার্ডভ্যান ১৬, পিকআপ ২৩, ট্রাক্টর ১১, ট্রলি ৯, লরি ৯, ড্রাম ট্রাক ১৭, পুলিশ ভ্যান ১, তেলবাহী ট্যাংকার ৩, মাইক্রোবাস ১৯, প্রাইভেটকার ২৮, অ্যাম্বুলেন্স ৬, জীপ ৪, মোটরসাইকেল ২৩৪, থ্রি-হুইলার ২২৩ (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ৩৬ (নসিমন-করিমন-ভটভটি-পাখিভ্যান-টমটম-মাহিন্দ্র-আলগামন), বাইসাইকেল-রিকশা ২১ এবং অজ্ঞাত যানবাহন ১৮টি।
দুর্ঘটনার সময় বিশ্লেষণ:
সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাসমূহ ঘটেছে ভোরে ৫.৯০%, সকালে ২৮.৮৩%, দুপুরে ১৯.২২%, বিকালে ১৭.২০%, সন্ধ্যায় ৭.২৫% এবং রাতে ২১.৫৮%।
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান:
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ২৯.১৭%, প্রাণহানি ২৬.১৯%, রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ১০.৭৯%, প্রাণহানি ১১.২২%, চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ২০.৫৭%, প্রাণহানি ২২.৪৪%, খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ১৪.৬৭%, প্রাণহানি ১৪.৬২%, বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৬.৪০%, প্রাণহানি ৫.৯৫%, সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৫.৭৩%, প্রাণহানি ৬.৪৬%, রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ৫.২২%, প্রাণহানি ৫.৪৪% এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ৭.৪১%, প্রাণহানি ৭.৬৫% ঘটেছে।
ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ১৭৩টি দুর্ঘটনায় ১৫৪ জন নিহত হয়েছেন। রংপুর বিভাগে সবচেয়ে কম ৩১টি দুর্ঘটনায় ৩২ জন নিহত হয়েছেন। একক জেলা হিসেবে চট্টগ্রাম জেলায় ৩৫টি দুর্ঘটনায় ৪৬ জন নিহত হয়েছে। সবচেয়ে কম নীলফামারী জেলায়। এই জেলায় কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটলেও প্রাণহানি ঘটেনি।
রাজধানী ঢাকায় ৩৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৯ জন নিহত এবং ২৭ জন আহত হয়েছে।
নিহতদের পেশাগত পরিচয়:
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায়, পুলিশ সদস্য ২ জন, সেনা সদস্য ১ জন, আনসার সদস্য ২ জন, বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক ১৩ জন, চিকিৎসক ১ জন, প্রকৌশলী ১ জন, সাংবাদিক ৩ জন, আইনজীবী ২ জন, বিভিন্ন ব্যাংক-বীমা কর্মকর্তা ও কর্মচারী ৯ জন, বিভিন্ন এনজিও কর্মকর্তা-কর্মচারী ১২ জন, ঔষধ ও বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বিক্রয় প্রতিনিধি ২৪ জন, স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যবসায়ী ৩৬ জন, ইউপি সদস্য ১ জন-সহ স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ২১ জন, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কর্মচারী ১ জন, ইমাম-মুয়াজ্জিন ৮ জন, বিআরবি ক্যাবলস এর কর্মচারী ২ জন, মেকানিক ৫ জন, পোশাক শ্রমিক ৪ জন, তাত শ্রমিক ২ জন, ইটভাটা শ্রমিক ৬ জন, রাজমিস্ত্রি ৪ জন, কাঠমিস্ত্রি ২ জন, রঙ মিস্ত্রি ২ জন, টাইলস মিস্ত্রি ২ জন, প্রতিবন্ধী ২ জন এবং দেশের বিভিন্ন স্কুল-মাদরাসা ও কলেজের ৭৯ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে। উল্লেখ্য, চলমান এসএসসি পরীক্ষার্থী নিহত হয়েছে ২৪ জন এবং আহত হয়েছে ৩৭ জন।
সড়ক দুর্ঘটনার প্রধান কারণসমূহ:
১. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন; ২. বেপরোয়া গতি; ৩. চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; ৪. বেতন-কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট না থাকা; ৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল; ৬. তরুণ-যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো; ৭. জনসাধারণের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা; ৮. দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা; ৯. বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি; ১০. গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।
সুপারিশসমূহ:
১. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে; ২. চালকদের বেতন-কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট করতে হবে; ৩. বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে; ৪. পরিবহন মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; ৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্ব রাস্তা (সার্ভিস রোড) তৈরি করতে হবে; ৬. পর্যায়ক্রমে সকল মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে; ৭. গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে; ৮. রেল ও নৌ-পথ সংস্কার করে সড়ক পথের উপর চাপ কমাতে হবে; ৯. টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে; ১০. সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
দুর্ঘটনা পর্যালোচনা ও মন্তব্য:
গত মার্চ মাসে ৫৮৭টি দুর্ঘটনায় ৬০৪ জন নিহত হয়েছিলেন। প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছিলেন ১৯.৪৮জন। এপ্রিল মাসে প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছেন ১৯.৬ জন। এই হিসেবে প্রাণহানি কমেছে ০.৬১%। অর্থাৎ প্রাণহানি কমার লক্ষণ নেই। অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে অতিরিক্ত গতির কারণে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে। এই গতি নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তির মাধ্যমে নজরদারী এবং চালকদের মোটিভেশনাল প্রশিক্ষণ দরকার। যানবাহনের বেপরোয়া গতি এবং পথচারীদের অসচেতনতার কারণে পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়ছে। এজন্য সরকারি উদ্যোগে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জীবনমুখি সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে।
পেশাগত সুযোগ-সুবিধা বিশেষ করে, নিয়োগপত্র, বেতন ও কর্মঘন্টা নির্দিষ্ট না থাকার যানবাহনের অধিকাংশ চালক শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ। তারা সবসময় অস্বাভাবিক আচরণ করেন এবং বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালান। ফলে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হন। তাই, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে হলে পরিবহন শ্রমিকদের পেশাগত সুযোগ-সুবিধা এবং সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।