:: নাগরিক প্রতিবেদন ::
বিশ্বের উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ এভারেস্টে পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে ১১ বছর পর লাল-সবুজের পতাকা উড়িয়েছেন বাবর আলী। তার লক্ষ্য এখন পৃথিবীর চতুর্থ শীর্ষ পর্বত লোৎস জয় করা। এটি জয় করতে পারলে বাংলাদেশের ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায় রচনা করবেন তিনি।
রোববার (১৯ মে) বাংলাদেশ সময় সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে এভারেস্ট জয় করেন তিনি। বেসক্যাম্প টিমের বরাতে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন অভিযানের প্রধান সমন্বয়ক ফরহান জামান।
হিমালয়ের চূড়া জয়ের জন্য গত ১ এপ্রিল নেপালের উদ্দেশে রওনা দেন বাবর আলী। এর আগের দিন ৩১ মার্চ চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি।
সেদিন তিনি বলেছিলেন, সবার মতো আমিও পর্বতের উঁচু বিন্দুতে দাঁড়িয়ে পৃথিবী দেখার স্বপ্ন দেখি। আমি এভারস্টের সঙ্গে লোৎস জয় করার স্বপ্ন দেখছি। পুরো অভিযানে দুই মাস সময় লাগবে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ কিংবা শেষ সপ্তাহে চূড়ায় আরোহণ করতে পারব।
হিমালয়ের শীতিধার চূড়ার পাশে লাগোয়া পৃথিবীর চতুর্থ শীর্ষ পর্বত লোৎস। রোববার ক্যাম্প ৪-এ নেমে মাঝরাতে আবারও শুরু করবেন দ্বিতীয় লক্ষ্যের পথে যাত্রা। সব অনুকূলে থাকলে ভোরে পৌঁছে যাবেন এর চূড়ায়। ২৭ হাজার ৯৪০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত মাউন্ট লোৎস। একই অভিযানে এক সঙ্গে দুটি পর্বত জয় করা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। বাংলাদেশ থেকে আগে এভারেস্ট জয় করা হলেও একই অভিযানে এভারেস্ট এবং লোৎসে আরোহণের চেষ্টা হয়নি। সেই চ্যালেঞ্জই নিয়েছেন বাবর।
২০১৪ সাল থেকে পর্বতারোহণে পথচলা শুরু বাবরের। চট্টগ্রামের পর্বতারোহণ ক্লাব ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য তিনি। এ ক্লাবের হয়েই গত দশ বছরে হিমালয়ের নানান শিখরে অভিযান করেছেন তিনি। ২০১৭ সালে ভারতের উত্তর কাশীর নেহেরু ইনস্টিটিউট অব মাউন্টেনিয়ারিং থেকে মৌলিক পর্বতারোহণ প্রশিক্ষণ শেষ করেন। ২০২২ সালে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে হিমালয়ের অন্যতম দুর্গম ও টেকনিক্যাল চূড়া আমা দাবলাম (২২,৩৪৯ ফুট) আরোহণ করেন তিনি।
এর আগে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ২০১০ সালে বিশ্বের সর্বোচ্চ এ পর্বতশৃঙ্গ জয় করেন মুসা ইব্রাহীম। এক বছর পর ২০১১ সালে দ্বিতীয় এভারেস্ট বিজয়ী হিসেবে নাম লেখান এম এ মুহিত। ২০১২ সালে বাংলাদেশের প্রথম নারী হিসেবে এভারেস্টে আরোহণ করেন নিশাত মজুমদার। একই বছর সপ্তাহের ব্যবধানে সেখানে পা রাখেন আরেক বাংলাদেশি নারী ওয়াসফিয়া নাজরীন।
এদিকে বেসক্যাম্প ম্যানেজার এবং আউটফিট মালিকের বরাতে বাবরের সংগঠন ভার্টিক্যাল ড্রিমার্সের পক্ষ থেকে ফেসবুকের এক পোস্টে বলা হয়েছে, ‘সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এবং লাখো শুভাকাঙ্ক্ষীদের দোয়ায় প্রকৃতি মাতা বাবরকে ক্ষণিকের জন্য স্থান দিয়েছেন নিজের চূড়ায়। খানিক আগে বেসক্যাম্প ম্যানেজার এবং আউটফিট মালিক আমাদের এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এখন বাবর আছে ক্যাম্প-৪ এ নামার পথে। ওই ডেথ জোনে যোগাযোগ সম্ভব নয়। তাই অভিযানের ছবি পেতে সময় লাগবে।’
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছেন ৩৪ বছর বয়সী বাবর আলী। শুরু করেছিলেন চিকিৎসা পেশা। এরপর চাকরি ছেড়ে দেশ-বিদেশে ঘোরায় মনোযোগ দেন।
১৮ মে মাঝরাতে আবারও শুরু হয় বাবরের যাত্রা। ১৯ মে ভোরের আলোয় ২৯ হাজার ৩১ ফুট উচ্চতার মাউন্ট এভারেস্টের শীর্ষে ওড়ান বাংলাদেশের পতাকা।
পৃথিবীর সর্বোচ্চ শিখর মাউন্ট এভারেস্টে প্রথম অভিযান পরিচালিত হয় আজ থেকে শতাধিক বছর আগে। ১৯৫৩ সালের ২৯ মে নেপালের শেরপা তেনজিং নোরগেকে সঙ্গে নিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় উঠেছিলেন নিউজিল্যান্ডের পর্বতারোহী এডমন্ড হিলারি। আর ২০১০ সালের ২৩ মে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্টের শীর্ষে ওঠেন মুসা ইব্রাহীম। এরপর ২০১১ ও ২০১২ সালে দুবার এভারস্ট জয় করেন এম এ মুহিত। প্রথম বাংলাদেশি নারী হিসেবে ২০১২ সালের ১৯ মে এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণ করেন নিশাত মজুমদার। একই মাসের ২৬ মে ওয়াসফিয়া নাজরীন জয় করেন এভারেস্ট। ২০১৩ সালের ২০ মে এভারেস্টজয়ী পঞ্চম বাংলাদেশি সজল খালেদ এভারেস্টচূড়া থেকে নেমে আসার সময় মারা যান।
২০১৩ সালের পর বাংলাদেশি পর্বতারোহীদের এভারেস্ট অভিযানে নেমে আসে খরা। আজ ১১ বছরের সেই খরা কাটিয়ে এভারেস্টের চূড়ায় বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা উড়ালেন বাবর আলী। তাঁর এবারের অভিযানের লক্ষ্য শুধু এভারেস্ট নয়, এর সঙ্গে লাগোয়া পৃথিবীর চতুর্থ শীর্ষ পর্বত লোৎসেও। আজ ক্যাম্প ৪–এ নেমে মাঝরাতে আবার শুরু করবেন দ্বিতীয় লক্ষ্যের পথে যাত্রা।
ছেলের এভারেস্ট জয়ে উচ্ছ্বসিত বাবরের বাবা-মা
চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলায় জন্ম নেওয়া তরুণ বাবর আলী (৩৪)। সন্তানের এভারেস্ট জয়ে উচ্ছ্বসিত তার বাবা লিয়াকত আলী ও মা লুৎফুন্নাহার বেগম। ছেলের এ অর্জনে মা লুৎফুন্নাহার বলেন, চিকিৎসক হিসেবে বাবর পেশা শুরু করলেও তার নেশা ছিল ভ্রমণ।
ছেলের ছবি বুকে নিয়ে রোববার দুপুরে এক প্রতিক্রিয়ায় বাবরের বাবা লিয়াকত আলী বলেন, ‘আজ আমার আনন্দের শেষ নেই। আমার ছেলে বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরেছে। এই অর্জন আনন্দের-গর্বের-উল্লাসের।’ তিনি আরও বলেন, ‘গতকাল (শনিবার) রাত থেকে খবর পাচ্ছিলাম। আজ সকাল সাড়ে ৮টায় চূড়ান্ত খবর পাই, ছেলে এভারেস্ট জয় করেছে। এরপরই বিভিন্নস্থান থেকে মানুষজন বাড়িতে আসতে শুরু করে। পুরো বাড়ি আজ আনন্দে ভাসছে।’
বাবর আলীর মা লুৎফুন্নাহার বেগমের চোখে ছিল আনন্দ অশ্রু। সেটা মুছতে মুছতে তিনি বলেন, ‘ছেলের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিল, এভারেস্ট জয় করবে। বাবর খুবই মেধাবী ছাত্র ছিল। চিকিৎসক হিসেবে পেশা শুরু করলেও তার নেশা ছিল ভ্রমণ। ছেলে এভারেস্টে যাবে এজন্য মা হিসেবে বুকের ভেতরে ভয় কাজ করলেও সাহস রেখেছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘গত কয়েকদিন অনেক চিন্তা আর উৎকণ্ঠায় ছিলাম। ছেলে এভারেস্টের চূড়ায় ঠিকমত উঠতে ও নেমে আসতে পারবে কি না। সারাক্ষণ জায়নামাজে বসে দোয়া করেছি। শেষ পর্যন্ত সুস্থ অবস্থায় বাবর এভারেস্ট জয় করেছে। এটা আমাদের জন্য গর্বের।’ তবে ছেলের জন্য চিন্তায় আছেন জানিয়ে মা বলেন, ‘আমরা এখনো চিন্তায় আছি। কারণ বাবর এখনও নেমে আসেনি। ছেলে যতক্ষণ আমার বুকে না আসবে ততক্ষণ চিন্তা কাটবে না।’
গত ১ এপ্রিল থেকে শুরু হয় বাবরের মাউন্ট এভারেস্ট অভিযান। ১০ এপ্রিল এভারেস্টের বেস ক্যাম্পে পৌঁছান তিনি। ২৬ এপ্রিল বেস ক্যাম্প থেকে যাত্রা শুরু করে এভারেস্ট ক্যাম্প-২ এ পৌঁছালেও পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে ফিরে আসেন তিনি। তারপর এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার মতো উপযুক্ত আবহাওয়ার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হয়েছে বাবর আলীকে। শেষ পর্যন্ত যাত্রা শুরু হয় গত ১৪ মে। এদিন তিনি দ্বিতীয় ক্যাম্পে, ১৮ মে তৃতীয় ক্যাম্পে এবং ১৯ মে ভোরে ক্যাম্প ফোরে পৌঁছান।
বাবর আলী ১৯ মে ভোরে ‘ডেথ জোন’ নামে পরিচিত শৃঙ্গে আরোহণ করেন এবং মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেন।